দুলাল দে: সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিক প্রশ্নটা ‘করব কী করব না’ করে শেষ পর্যন্ত করেই ফেললেন। ম্যাচের আগে সাধারণত প্রতিপক্ষ ছাড়া অন্য দলের কথা বলতে পছন্দ করেন না কোচরা। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান (Brazil) কোচ তিতে একটু অন্যরকম। মুখে সব সময় একটা ভুবনভোলানো হাসি থাকে। রিচার্লিসন যাঁকে ব্যাখ্যা করেন, ‘‘উনি আমাদের বাবার মতো। সবার সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক। ড্রেসিংরুমে সবসময় একটা দারুণ পরিবেশ তৈরি করে রাখেন।’’ ফলে সার্বিয়ার (Brazil vs Serbia) ম্যাচের আগে প্রথাগত সাংবাদিক সম্মেলনে এক আর্জেন্টাইন সাংবাদিক যখন প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন, শুনে হেসে ফেললেন তিতে। জিজ্ঞাসা করা হল-প্রবল শত্রু আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচে হারের পর সতর্ক থাকবে ব্রাজিল?
সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নটা উঠল বলে উত্তরটা দিলেন। নাহলে মেসিদের অবস্থা দেখে এমনিতেই সতর্ক হয়ে গিয়েছেন নেমাররা। তিতে বললেন, ‘‘অবশ্যই। আর্জেন্টিনা একটা বড় নাম। সব সময় আর্জেন্টিনার ফুটবলকে সম্মান করি। সেরকম সব দেশের ফুটবলকেই সম্মান করি। প্রতিপক্ষ হিসেবে কেউ ছোট বা বড় নয়। আর্জেন্টিনার হার অবশ্যই সমস্যাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। তবে সমর্থকরা আমাদের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন, তাঁদের হতাশ করব না।’’
বিশ্বকাপের (Qatar World Cup) শুরুতেই মেসিদের অস্বাভাবিক পরাজয়ে কেঁপে উঠেছে পুরো বিশ্বফুটবল। সৌদির কাছে মেসিদের হারতে হলে, যে কোনওদিন যে কোনও দলের যা কিছু ফল হতে পারে। আর এদিন জার্মানির বিরুদ্ধে জাপানের খেলা দেখার পর মনে হচ্ছে এই বিশ্বকাপে সব কিছুই অনিশ্চিত। আর সেই কারণেই বৃহস্পতিবার মাঠে নামার আগে রীতিমতো সতর্ক ব্রাজিল। এমনকী তুকতাকের রাস্তায়ও চলে গেলেন নেমাররা!
বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের খেলার সময় রড্রিগোর হাত ধরে ইয়ুরজিনহো নামে একজন নাপিত এসেছিলেন ব্রাজিল হোটেলে। তাঁর হাতে চুলে কেটে সেই ম্যাচেই দারুণ খেলেন নেমাররা। এমনকী গোলও পান রড্রিগো। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় ইয়ুরজিনহোর ডাক পড়েছে ব্রাজিল শিবিরে। ব্রাজিলের সাংবাদিকদের থেকে যেটুকু জানা গেল, তাতে এবারের বিশ্বকাপ পাওয়ার জন্য সব কিছু করতে তৈরি নেমার। রড্রিগোকে বলেছেন, জরুরি ভিত্তিতে ইয়ুরজিনহোকে ব্রাজিল থেকে উড়িয়ে আনতে। নেমারের ইচ্ছে। তাই গতকালই দোহায় ব্রাজিল শিবিরে এসে পৌঁছেছেন ইয়ুরজিনহো। আর এদিনই নেমার, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রড্রিগোরা চুলের নতুন স্টাইল করে ফেললেন। সার্বিয়ার বিরুদ্ধে একেবারে নতুন স্টাইলের চুল নিয়ে নাঠে নামবেন নেমার, ভিনিসিয়াস জুনিয়ররা।
[আরও পড়ুন: জয়ের উল্লাসের মাঝেও স্টেডিয়ামে সাফাই অভিযান, কাতারে মন জিতলেন জাপানি সমর্থকরা]
কিন্তু শুধুই কি তুকতাক? ও গ্লোবোর এক সাংবাদিক বললেন, ‘‘নেমার ওরকমই। খুব সিরিয়াস হয়ে বসে আছে দেখবেন না। ওর মনের মধ্যে কী চাপ চলছে কিছুতেই বুঝতে দেয় না। আজকাল ব্রাজিলের সাংবাদিকদেরও সঙ্গেও কম কথা বলে। তবে তিতের কোচিংয়ে সবাই বেশ খোশমেজাজে থাকে। টিমের উপর কোনও চাপ তৈরি হতে দেন না আমাদের কোচ।’’
বিকেলে মূল মিডিয়া সেন্টারে সার্বিয়া ম্যাচের অধিনায়ক থিয়াগো সিলভাকে সঙ্গী করে সাংবাদিক সম্মেলনে এসেছিলেন কোচ তিতে। আর সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করেই ছুটলেন প্র্যাকটিসে। এদিন প্র্যাকটিস মানে, খেলার আগে অত্যন্ত স্বাভাবিক প্র্যাকটিস। যা দেখে কারও বোঝার উপায় নেই, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে কোনও ফর্মেশনে ঝঁপিয়ে পড়বে ব্রাজিল। ৩৮ বছরের থিয়াগো সিলভা দলের অধিনায়ক। দানি আলভেজের পর দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফুটবলার।
এদিন প্র্যাকটিসে দেখা গেল, শুরুর দিকে নেমারের কাঁধে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করছেন। মাঠে যাওয়ার আগেই সাংবাদিক সম্মেলনে নেমার নিয়ে বলেও গিয়েছেন। ২০১৪ বিশ্বকাপে নিজের দেশে জার্মানির বিরুদ্ধে ম্যাচটা খেলতে পারেননি চোটের জন্য। নেমারও কোমরে চোট পেয়ে তখন মাঠের বাইরে। আর তারপরেই সেই অভিশপ্ত ১-৭ গোলে হার। এদিন থিয়াগো সিলভা বলছিলেন, ‘‘২০১৪ বিশ্বকাপে চোটের জন্য নেমার বাইরে চলে যায়। ২০১৮-তে সবে চোট থেকে উঠে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল আধা ফিট অবস্থায়। আর এবার নেমার চোট-আঘাত থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ। এবার নেমারকে অন্য ভূমিকায় দেখা যাবে।’’
সন্ধ্যায় প্র্যাকটিসে মাঠের ধারে নেমাররের সঙ্গে একান্তে দলের অধিনায়ক এই কথাগুলিই বলছিলেন কি না জানা নেই। তবে নেমারকে দেখা গেল, দলের সকলের সঙ্গে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মজা করতে। মেসির পরাজয়ে তিনিও যে সমান চাপে বুঝতেই দিতে চান না নেমার। চাপের প্রসঙ্গটা তুললেন থিয়াগো সিলভা এবং তিতে দু’জনেই। থিয়াগো সিলভা বলছিলেন, ‘‘৩৮ বছরে পৌঁছে আর চাপ হয় না। আমার তো মনে হয়, ফুটবল কেরিয়ারের সেরা মুহূর্তের মধ্য দিয়ে চলেছি। আর আমাদের দলটাও দারুণ। সবাই সবাইকে বিশ্বাস করে। সম্মান করে। ভাল খেলার জন্য এরকমই পরিবেশ চাই।’’ আর তিতে বললেন, ‘‘দেখুন, ব্রাজিল ফুটবলের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। আগের বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের কাছে হারার পরেও আমি এবারের কোচের দায়িত্ব আছি। তবে এটাকে চাপ হিসেবে দেখছি না।’’
তিতে এবং থিয়াগো সিলভা যখন সাংবাদিক সম্মেলন করছেন, তখন সবে জার্মানি-জাপান ম্যাচ শুরু হয়েছে। আর্জেন্টিনার প্রসঙ্গ উঠতেই তিতে শুধু বললেন, ‘‘আমরা সব ম্যাচেই দেখতে পাচ্ছি কী হচ্ছে।’’ তিনি যখন এই কথা বলছেন, তখন অবশ্য জার্মানিকে হারায়নি জাপান। আর সন্ধ্যায় যখন ফুটবলারদের হালকা অনুশীলন করিয়ে ছেড়ে দিলেন, তখনই নেমাররা জানতে পারলেন, আর্জেন্টিনার পর এবার ছোট দলের কাছে হারতে হয়েছে জার্মানিকে। ফলে বিশ্বফুটবলের ঐতিহ্যশালী দলগুলির সম্মানরক্ষার ভার এবার তাঁর পায়ে। কিন্তু সৌদির পর জাপান ম্যাচের ফল দেখে সার্বিয়া কোচ ড্রাগন স্টোইকোভিচ আবার হুঙ্কার ছেড়ে বসে আছেন। বলেছেন, ‘‘ব্রাজিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার হলেও, আমরা আর ভয় পাচ্ছি না।’’ অর্থাৎ নাম দিয়ে আর কিছু হবে না। নামার আগে ছোট দলগুলি আর হেরে নামতে চাইছে না। এটাই যা চাপ আজ নেমারদের জন্য।