রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ইতিহাসের চুন-সুরকি দিয়ে গড়া মনুষ্য অবয়ব দেখছেন কখনও? যাঁর হাতে ধরা ভারতীয় ক্রিকেটের বট-অশ্বত্থ যুগ, শিরা-উপশিরায় যাঁর পুরাকালের দিন-রাত?
না দেখে থাকলে যান, চলে যান আদিয়ারের কারাপাদাম গার্ডেন্সের ২ নম্বর ফার্স্ট ক্রস স্ট্রিটের বাড়িতে। দেখে আসুন তাঁকে, ভারতবর্ষের ক্রিকেটের এক আদিপুরুষকে!
জাতীয় ক্রিকেট দল এককালে পাকিস্তান গিয়ে যে হোটেলের বদলে ট্রেনের কামরায় নিশিযাপন করেছিল টানা তিন রাত, হোটেল বলে এক বস্তুর অভাবে, সে গল্প শুনেছেন কখনও?
না শুনে থাকলে যান, চলে যান আদিয়ারের কারাপাদাম গার্ডেন্সের ২ নম্বর ফার্স্ট ক্রস স্ট্রিটের বাড়িতে। সে বাড়ির তিরানব্বই বছরের ‘যুবক’ সব মনে করতে পারেন আজও, বলতে পারেন হুবহু!
দেশে-বিদেশে খেলতে গেলে বিরাট কোহলিরা যে অর্থ দৈনিক ভাতা পান, তার ইংরেজি নাম সর্বজনবিদিত। ‘ডেইলি অ্যালাওয়েন্স’ তো আর নতুন শব্দ নয়। কিন্তু এক সময় সেই ভাতার নাম যে ছিল ‘স্মোক পে’, জানা আছে আপনার?
না জানা থাকলে যান, চলে যান আদিয়ারের কারাপাদাম গার্ডেন্সের ২ নম্বর ফার্স্ট ক্রস স্ট্রিটের বাড়িতে। ফিটফাট, কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক নিমেষে বলে দেবেন এ শব্দের উৎপত্তি ও সে সময়ে বিস্তৃতি ঠিক কোন কারণে?
প্রকৃত ক্রিকেটপোকাদের বাদ দিলে চেন্নাইয়ের আদিয়ারের কারাপাদাম গার্ডেন্সের ২ নম্বর ফার্স্ট ক্রস স্ট্রিটের বাসিন্দার নাম বললে সচরাচর কেউ চিনবে না। সিডি গোপীনাথের নাম চন্দ্রযানের আধুনিক ভারতের শোনার কথা নয়, শোনার দায়ও নেই। কিন্তু যদি বলা হয়, ভারতের সর্বপ্রথম টেস্ট জয়ী টিমের একমাত্র জীবিত সদস্য ইনি, যদি বলা হয় ভারতীয় দলে টাইগার পতৌদির নির্বাচন এঁর হাত ধরে হয়েছিল, যদি বলা হয় জীবনের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের এক ও একমাত্র বাসনা এখন দেশের তৃতীয় বিশ্বজয় চাক্ষুষ করা, চক্ষু-কর্ণ একযোগে সচকিত সজাগ হয়ে যাবে না?
যাবে। যাওয়া উচিতও। সিডি গোপীনাথ নামক ভারতীয় ক্রিকেটের জীবিত ‘গ্রন্থাগারের’ সামনে সোফায় বসে সব শুনলে তো আরও উচিত! ১৯৫২ সালে ভারত-ইংল্যান্ড ঐতিহাসিক টেস্টের শরিক ছিলেন যিনি, যিনি খেলেছেন বিজয় হাজারের নেতৃত্বে, সাক্ষী থেকেছিলেন ভারতের প্রথম টেস্ট জয়ের!
[আরও পড়ুন: ‘বঞ্চিতদের সঙ্গে দেখা করতে চাই’, তড়িঘড়ি দার্জিলিং থেকে কলকাতায় ফিরছেন রাজ্যপাল]
‘‘সেই টেস্টে পঙ্কজ (রায়) আর পলি (উমরিগড়) সেঞ্চুরি করেছিল। কিন্তু আমি মনে করি, টেস্টটা আমাদের জিতিয়েছিল বিনু (মানকড়) আর গুলাম আহমেদের বোলিং,’’ সোফায় বসে বলতে-বলতে স্মৃতির প্রশান্ত মহাসাগরে যেন ডুব দেন গোপীনাথ। দক্ষ ডুবুরির মতো। ‘‘ইংল্যান্ড আমাদের ধর্তব্যেই রাখেনি। ভেবেছিল, নামবে আর উড়িয়ে দেবে। কিন্তু চেন্নাই টার্নারে যে ওরাই শেষে হাবুডুবু খাবে, জানত না।’’ বাহান্ন থেকে এরপর তড়িৎগতিতে চুয়ান্ন সালের পাকিস্তান সফরে রওনা হন তিরানব্বই বছরের গোপীনাথ। আবারও। ‘‘খেলাটা ছিল পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে। আমাদের বলা হল, হোটেল নেই। ট্রেনে থাকতে হবে। থেকেছিলাম তিন দিন। নিজেদের স্যুটকেস থেকে একটা শার্ট বার করতে গেলে দশটা ট্রাঙ্ক সরাতে হত।’’ লম্বা শ্বাস নিয়ে ফের শুরু করেন, ‘‘কী সব দিন ছিল! একটা টেস্ট খেলতে গেলে দশ দিন লাগত। ট্রেনে যাতায়াত সমেত। আর সব মিলিয়ে ট্রেন ভাড়া ছাড়া আমরা পেতাম আড়াইশো টাকা। টাকার জন্য খেলতাম না আমরা। দেশের জন্য খেলতাম। ওই অর্থকে তাই অ্যালাওয়েন্স বলা হত না। বলা হত, স্মোক পে! আসলে বোর্ডের তখন অর্থ ছিল না। আপনাদের কলকাতায় গিয়ে খেলতে গিয়ে এক দক্ষিণী পরিবারের অতিথি হয়ে থেকেছি। তখন এ সবের চল ছিল। যখন যে শহরে খেলা, সেই শহরে সহৃদয় পরিবারদের আহ্বান করা হত। ক্রিকেটারদের ক’টা দিন বাড়িতে রাখার আবেদন সহ। বললাম না, বোর্ডের অর্থ ছিল না তখন। হোটেল বুকিং করবে কী ভাবে?’’
কলকাতা, কলকাতার সঙ্গেও বড় আত্মার টান গোপীনাথের। তিরানব্বইয়ে পৌঁছেও ভুলতে পারেননি বাংলার স্নেহ, বাংলার উষ্ণতা। ‘‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমার প্রথম নামা কিন্তু কলকাতায়। রানও করেছিলাম। কলকাতার দর্শক ক্রিকেটের প্রকৃত সমঝদার। হাজারো ব্যর্থ হলেও ইডেন সব সময় ক্রিকেটারের সাফল্যকেই মনে রেখে দেবে,’’ এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন গোপীনাথ। কলকাতা যাঁকে এক পরম বন্ধুও উপহার দিয়েছিল, নাম যাঁর ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ফিকে হাসি নিয়ে দেশের হয়ে আট টেস্ট খেলা গোপীনাথ বলে চলেন, ‘‘কমনওয়েলথ টিমের হয়ে ইডেনেই আমার প্রথম টেস্ট। উলটো দিকে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফ্র্যাঙ্ক খুব সহৃদয় লোক ছিল, বলেছিল তোমার প্রথম টেস্ট, প্রথম ডেলিভারিটা তোমায় মারার বল দেব। পরেরটায় আউট করব!’’
বিমোহিত লাগে সমস্ত শুনতে-শুনতে। অস্ফুটে জিজ্ঞাসা করি, আধুনিক ক্রিকেট দেখেন না? ‘‘দেখি তো,’’ দ্রুত প্রত্যুত্তর আসে। ‘‘টেস্ট বাদে ওয়ানডে ক্রিকেট পছন্দ করি। কিন্তু টি-টোয়েন্টি একদম নয়। ওটা ক্রিকেট না, ক্রিকেটের নামে জগঝম্প কেবল।’’ আর ক্রিকেটার, ক্রিকেটারদের মধ্যে ভাল লাগে কাকে? কাদের? ‘‘শচীনকে দারুণ লাগত। বিরাটকে ভাল লাগে। রোহিতকেও। তবে ওদের কাছে একটা বিশেষ আবদার আছে আমার।’’
[আরও পড়ুন: বিহারে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় জলে ডুবে মৃত পাঁচ কিশোরী-সহ ২২ জন! শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর]
শশব্যস্তে প্রশ্ন করি, ‘‘কী?’’ ‘‘দেখা হলে বলবেন, বুড়ো মানুষটার একটা শেষ ইচ্ছে আছে। ওদের হাতে বিশ্বকাপ দেখার। দেশের তৃতীয় বিশ্বকাপ। খুব বেশি কিছু করিনি আমি দেশের হয়ে। তবে যতটুকু যা করেছি, বিশ্বকাপ তার রিটার্ন গিফট হলে মন্দ হয় না।’’ বলা শেষ করে উঠে দাঁড়ান সিডি গোপীনাথ। তিরানব্বইয়ের ঋজু শরীর নিয়ে আস্তে-আস্তে অদৃশ্য হয়ে যান বাড়ির গহনে, ছোকরা সাংবাদিকের এক আকাশ বিস্ময়কে পিছনে ফেলে। ইতিহাসের আকরকে আরও আঁকড়ে ধরে!