পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত 'এই রাত তোমার আমার' আসবে এ মাসের শেষে। তার প্রাক্কালে ছবি নিয়ে কথোপকথনে অপর্ণা সেন। বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
কেমন আছেন? অনেকদিন পর ছবির প্রচারে আপনাকে আবার দেখতে পেলাম।
- ভালোই আছি। কিছু শারীরিক ইস্যু আছে, সেটা সবসময়ই থাকবে, কিছু করার নেই।
‘এই রাত তোমার আমার’ বন্ধুত্বের ছবি, বার্ধক্যের ছবি না কি কমপ্যানিয়নশিপের ছবি?
- আমি তো বলব, ভালোবাসার ছবি।
পরমব্রত যখন প্রথম এই ছবির ভাবনা নিয়ে আসে, আপনার প্রাথমিক রিঅ্যাকশন কী ছিল?
- যখন প্রথম গল্পটা শুনি, আইডিয়াটা ভালো লাগে। আরও যেটা ভালো লেগেছিল সেটা হল একটা রাতের গল্প। আমি আর অঞ্জন রয়েছি অর্থাৎ অভিনয়ের দারুণ সুযোগ রয়েছে। অঞ্জনের সঙ্গে টানা কাজ করা, অর্থাৎ কেবল আমি আর ও থাকব ছবিজুড়ে– সেটাই একটা লোভনীয় প্রস্তাব। হি ইজ ওয়ান অফ দ্য বেস্ট অ্যাক্টর উই হ্যাভ। ডিরেক্টর-অ্যাক্টর হিসাবে আমাদের কেমিস্ট্রিটা ভালো ছিলই। কিন্তু অভিনেতা হিসাবে আমাদের কেমিস্ট্রি এত ভালো হবে আগে বুঝিনি। আসলে আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসটা খুব বেশি। উই ট্রাস্ট ইচ আদার।
এই দীর্ঘ কেরিয়ারে কাজের জায়গায় বহুবার পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছেন নানাভাবে। কিন্তু কোনও পরিচালক আপনাদের রোম্যান্টিক জুটি হিসাবে কাস্ট করেনি। অবাক লাগে না?
- আসলে অঞ্জনের থেকে আমি খানিকটা বড়। সেই জন্য কেউ ভাবেনি কি না কে জানে? অঞ্জনকে মৃণালকাকা (সেন) ছাড়া নায়কের চরিত্রে কেউ সেভাবে কাস্ট করেনি। কিন্তু ওর ট্যালেন্টটা এত বেশি সেখানে আর কতদিন ইগনোর করবে! আর সৌমিত্রর কারণেই হোক বা উত্তমবাবুর কারণেই হোক, বয়স্ক নায়কের একটা চল এসেছিল। সেই সময় অঞ্জনকে নায়ক করে ছবি হতও না। আর এখন যখন চারদিকে ট্যালেন্টের অভাব সেখানে যদি একজন অভিনেতা একা গোটা ছবি নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, তখন তাকে ডাকা হয়। এখন দেখবে পরানদাকে কাস্ট করতে চায় সবাই। কারণ, জানে ছবিটাকে আরেকটা মাত্রা দেবে আর সেই কারণেই আমার ধারণা, এই ছবিতে আমাদের কাস্ট করা।
আপনি তো সব ধরনের ছবিতেই অভিনয় করেছেন!
- সে তো ছোটবেলায় যখন চেহারা-টেহারা ভালো ছিল।
আপনাকে এখনও গ্ল্যামারাস দেখতে...
- না, না, সে তুমি যাই বলো, সিনেমাতে এখন আমাকে কাস্ট করার মতো চেহারা নেই। বয়স্ক রোল হলে, তাও ঠিক আছে।
অঞ্জন দত্তর সঙ্গে আপনার বহুদিনের পরিচয়। কেমন বন্ধুত্ব আপনাদের? মতভেদ, ঝগড়া হয়েছে?
- মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আড্ডা হয়। কখনও আমি আর কল্যাণ ওদের বাড়িতে গেলাম। ডিনার করলাম। তুমুল আড্ডা হল। কখনও ওরা এল। হয়তো জয়তী বা নীল এল, অঞ্জন এল না। অঞ্জনকে পাওয়া খুব কঠিন। ভীষণ কঠিন। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আসব’ বলে আর আসে না, ফাঁকি দেয়। এটা ওর অভ্যেস। আমি কিন্তু ফাঁকি দিই না সাধারণত। অঞ্জন অবলীলায় সেটা করে। তখন হয়তো রাগ করে বললাম, তোকে আর আমি বলব না। তখন হয়তো অঞ্জন রাগ ভাঙাতে ফোন করল। রাগটাগের প্রশ্নই ওঠে না, সেটা নয় কিন্তু হ্যাঁ, বন্ধুত্ব আছে। দরকারে-অদরকারে ফোন হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে সম্প্রতি যেটা ঘটল, শুটিং বন্ধ হল- সেই ব্যাপারে আমরা ঐক্যবদ্ধ হলামসেখানে আমাদের এক মানসিকতা। সে সব তো আছেই। কাজ ভালো লাগলে পরস্পরকে ফোনও করি।
এই ছবির কেন্দ্রে- ‘জয়িতা’ এবং ‘অমর’। তাদের পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকীর রাতের কথোপকথন ঘিরে ছবি এগোয়। আরও একটু বিশদে জানতে চাইব।
- পঞ্চাশ বছর যদি দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকে, তাহলে তো তাদের জীবনে অনেক ওঠাপড়া থাকবে। তার মধ্যে ভালোবাসা আছে, কিছু বঞ্চনা আছে, কিছু নালিশ আছে, বন্ধুত্ব আছে, বিশ্বাস আছে আবার অবিশ্বাসও আছে। এইরকম ধরনের সম্পর্ক যে কোনও দম্পতিরই হয়। তো বলা যেতে পারে, এই রাতটা একটা বোঝাপড়ার রাত।
পরিচালক হিসাবে বয়স্ক এই দম্পতির পালসটা কতটা সূক্ষ্মভাবে ধরতে পেরেছেন পরমব্রত?
- খুব ভালোভাবেই ধরতে পেরেছে বলে আমি মনে করি। তাছাড়া পরমব্রত প্রথম থেকেই বলেছিল, ও আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে, আমাদের ইনপুট নিয়েই ছবিটা করতে চায়। আমাদের যেখানে অসুবিধে লেগেছে আমরা সবাই বসে আলোচনা করেছি।
‘জয়িতা’ অসুস্থ তাই ‘অমর’ ঘর সামলায়। ‘জয়িতা’র পছন্দ নয়, সে মনে করে, বাড়ির কাজে ‘অমর’ অপটু।
এই যে মেয়েরা ‘গোছানো’ আর ছেলেরা ‘অগোছালো’ -এই স্টিরিওটাইপ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই জেন্ডার রোল সমস্যার নয় কি?
- আমি ভীষণ গোছানো স্বামীও দেখেছি, যেখানে স্ত্রী অগোছালো তবে সেটা একসেপশন। এটা ঠিক, খুব লাভিং কাপলদের মধ্যেও এটা নিয়ে ক্ল্যাশ হয়। আমার আর কল্যাণের মধ্যেও এটা নিয়ে চলে। ‘আহা! এখানে ফেলছ, ওখানে কেন রাখছ, এখনও মানুষ করতে পারলাম না তোমাকে’– এটা চলতেই থাকে। তার জন্য ভালোবাসা কম থাকে তা নয়। এখানে জয়িতা আর অমরের মধ্যেও তাই। এবং এই চরিত্র দুজন যে সময়কার সেখানে এটা ম্যাটার করবে বলে মনে হয় না। আর তুমি যে জেন্ডার-স্টিরিওটাইপের কথা বলছ সেটা ঠিক। তোমরা নতুন প্রজন্ম, তোমরা বদলাও। তোমরা পরিবর্তন আনো। (হাসি)
সম্পর্ক দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বাস-অবিশ্বাস থাকে, বঞ্চনা থাকে, স্বীকারোক্তি থাকে। আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কী বলে– স্বীকারোক্তি কি পুরনো ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারে?
- স্বীকারোক্তি পুরনো দুঃখে প্রলেপ দিতে পারে কি না আমি ঠিক জানি না।
তাহলে স্বীকারোক্তি কী করে? কেন আসে? কোন কাজে লাগে?
- আসলে আমার মনে হয়, স্বীকারোক্তিটা বেশির ভাগ সময় যে স্বীকার করছে তার প্রয়োজনে হয়। তার গিল্ট থেকে হয়। তার নিজেকে নির্ভার করার ইচ্ছা থেকে আসে। অনেক সময়ে সেই স্বীকারোক্তির ফলে অন্যজন খুব আহতও হয়। সেটা হয়তো না বললেই ভালো হত। কিন্তু চেপে রাখার যে কষ্ট সেটাও একটা ব্যাপার। অপ্রিয় সত্যি বলার দরকার নেই, এটাও আমরা ভাবি। আবার যে অন্যায়টা করছে তার মনটা ছটফট করতে থাকে স্বীকার করার জন্য, মার্জনা পাওয়ার জন্য। কিন্তু সত্যিই সম্ভব হয় কি না কে জানে!
আপনি এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন কখনও?
- নিশ্চয়ই পড়েছি কিন্তু এক্ষুনি উদাহরণ দিতে পারব না। কত সময় এমন মনে হয়েছে, না বললেই তো হত, বেশ ভালো ছিলাম। আবার বলার পর অনেক সময় দেখেছি বাতাসটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, খোলসা হয়ে গিয়েছে। অন্যভাবে পরস্পরকে বুঝে পথ চলার রাস্তা খুলে গিয়েছে।
আপনিই একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সম্পর্কের ভিত বন্ধুত্বের হওয়া প্রয়োজন।
- এটা আমি আমার জীবন দিয়ে বিশ্বাস করি। আমার মেয়েরা দূরে থাকে, তাদের সঙ্গে যদি গভীর বন্ধুত্ব না থাকে, তাহলে ওদের জন্য এটা জাস্ট একটা দায়িত্ব পালন হয়ে থেকে যেত। মায়ের সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছাটা থাকত না। আর আমি জেনারেশন গ্যাপ বুঝতে পারি না। আমার দিদিমা-ঠাকুরমা বা বাবা-মায়ের সঙ্গেও সেই গ্যাপ হয়নি। আমার মেয়ে এবং নাতি-নাতনিদের সঙ্গেও গ্যাপ নেই। হয়তো আমি মানুষটা আধুনিক।
একেবারেই তাই। এবং বৈবাহিক জীবনেও বন্ধুত্ব না থাকলে সেটা সুস্থভাবে টিকিয়ে রাখা মুশকিল। কল্যাণ রায়ের সঙ্গে সেই বন্ধুত্ব কতটা গভীর?
- বন্ধুত্ব তো আছেই। আমাদের মানসিকতা, আইডিওলজি বা মূল্যবোধ একরকমের। তাছাড়াও আমাদের রুচির মিল আছে। আমি জানি, পছন্দ করে কিছু কিনলে কল্যাণের সেটা পছন্দ হবে। ধর একটা দামি পেন্টিং কিনতে চাই, দুজনের মতে মিল না হলে তো কিনতে পারব না। কল্যাণ একবার আমাকে বলেছিল, ‘থ্যাংক গড আমাদের পছন্দটা একরকমের। বড়বড় গোলাপফুল দেওয়া পর্দা, চাদর পাতলে, আমি তোমার সঙ্গে থাকতাম না।’ ম্যারেজ ইজ দ্য মোস্ট কমপ্লেক্স অ্যান্ড ডিফিকাল্ট থিং ফর পিপল টু মেক ইট ওয়র্ক।
সে তো একশোবার!
- দুজন মানুষের ব্যাকগ্রাউন্ডে মিল থাকলে ভালো। আমি কিন্তু গরিব বা বড়লোক অর্থাৎ অর্থনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা বলছি না। আমি বলছি, রুচি বা মূল্যবোধ এক হলে সহজ হয় মানিয়ে নেওয়াটা। আমি ধর কাউকে খুব ভালোবাসি, বিয়ে করে দেখলাম সেই বাড়িতে পুজোআচ্চার চল, ছেঁায়াছুঁয়ির ব্যাপার আছে, আমাকেও পুজো করতে হচ্ছে– আমি তো মানিয়ে নিতে পারব না। সেটাই আর কী!
দীর্ঘ সম্পর্কে থাকতে থাকতে বয়স বাড়লে আমরা অনেক সময় পরস্পরের প্রতি নন-জাজমেন্টাল হয়ে যাই। ত্রুটি না ধরার আসল কারণ কি অভ্যেস ছাড়ানো মুশকিল বলে?
- কিছুটা কমপ্রোমাইজ তো আমাদের মেনেই নিতে হয় তা না হলে থাকতে পারব না। এবার মানুষ যদি খুব বদলাতে থাকে তাহলে হয়তো জাজমেন্টাল হতেই হয়। চোখের সামনে যদি আমূল বদলে যায় তখন ভাবতেই হবে। এখন আমি যদি দেখি কল্যাণ হঠাৎ
করে ‘রাইটিস্ট’ হয়ে গেল, ‘ভক্ত’ হয়ে গেল- তখন তো আমি জাজমেন্টাল হব, তাই না (হাসি)।
অঞ্জন দত্তর সঙ্গে এই ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
- আমি অঞ্জনকে বলেছিলাম, ‘তোর সঙ্গে আমার কমফর্ট লেভেল দুশো ভাগ’। অঞ্জনও সেটা স্বীকার করে নিয়েছিল। এই ছবিতে হয়তো ইনটিমেট দৃশ্য নেই। কিন্তু অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছে, শুইয়ে দিচ্ছে, বমি পরিষ্কার করে দিচ্ছে- এই ধরনের নানা দৃশ্য আছে। আমাকে ভর দিয়ে যেতে হচ্ছে। অনেক সময় একটা শারীরিক ইনহিবিশন থাকে। আমার সেটা অঞ্জনের সঙ্গে কখনও মনে হয়নি। কেন মনে হয়নি জানি না। হয়তো ওকে অনেকদিন ধরে চিনি তাই, বহুদিনের চেনা বন্ধু হলে যা হয়।