সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: দীর্ঘ রোগভোগের পর শুক্রবারই চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছেন মনোজ কুমার। যাঁর প্রয়াণে শোকের ছায়া দেশের বিনোদুনিয়া থেকে রাজনৈতিকমহলেও। মাত্র পয়ত্রিশটি সিনেমাতেই বলিউডে কাঁপন ধরানো ভারত কুমার যে রাজনীতি সচেতন ছিলেন, তাঁর অভিনীত, পরিচালিত সিনেমাগুলিই তার প্রমাণ। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর অনুরোধে 'জয় জওয়ান জয় কিষাণ' স্লোগানের উপর ভিত্তি করে পরিচালক হিসেবে শিকে ছিড়েছিলেন 'উপকার' সিনেমা দিয়ে। তারও আগে ভগৎ সিংয়ের জীবনকাহিনি অবলম্বনে তৈরি ছবির চিত্রনাট্য লেখার জন্য জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন মনোজ। আর জীবনের প্রথম পুরস্কার স্বরূপ প্রাপ্ত সেই টাকার গোটাটাই তুলে দিয়েছিলেন ভগৎ সিংয়ের পরিবারের হাতে। আসলে সিনেমার মাধ্যমেও যে জনসচেতনতা গড়ে তোলা যায় কিংবা দেশবাসীকে একতার বার্তা দেওয়া যায়, সেই পাঠ শুধু হিন্দি কেন গোটা দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে দিয়েছিলেন মনোজ কুমার। সেইসূত্রেই তাঁর 'ভারত কুমার' নামটি সার্থক। দু' দশক যোগ দেন আগে বিজেপিতে। অভিনেতার প্রয়াণের পর শোকপ্রকাশ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এবার প্রয়াত ভারত কুমারের স্ত্রী শশী গোস্বামীকে এক আবেগঘন চিঠি পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী।

ভারতীয় সিনেমায় মনোজ কুমারের অপরিসীম অবদানের কথা উল্লেখ করে মোদি লিখেছেন, "তাঁর ছবি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও প্রাণ সঞ্চার করেছিল। শ্রী মনোজ কুমার সিনেমার মাধ্যমে দেশের গর্বকে তুলে ধরেছিলেন গোটা বিশ্বের আঙিনায়। তাঁর অনেক ছবি দেশবাসীর মনে জাতীয়তাবাদ সঞ্চার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একদিকে যেমন, মনোজ কুমারের সিনেমা স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল, ঠিক তেমনই দেশের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্ন দেখিয়েছিল আপামর ভারতবাসীকে। ভারতীয় মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে তৈরি তাঁর ছবি এবং সেই ছবির গানগুলিই প্রমাণ করে তিনি কত বড় দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর এই সৃষ্টিগুলি চিরকাল মানুষের মনে রয়ে যাবে। মনোজ কুমারের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং ওঁর সঙ্গে গল্প করার মুহূর্ত কোনওদিন ভুলব না। ওঁর চলে যাওয়া সিনেশিল্পের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।"
রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হয়েও দেশের মানুষের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সিনেমাকে 'অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন যে মানুষটি, তিনি মনোজ কুমার। সেই তালিকায় অবশ্য অনেক পরিচালক, অভিনেতার নাম ঠাঁই পেলেও দেশাত্মবোধক ছবির সমার্থক হয়ে ওঠে মনোজ কুমার নামটিই। এমনকী সিনেমার পর্দায় দেশের মানুষদের কথা তুলে ধরার জন্য নিজের বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলেন পরিচালক তথা অভিনেতা। আর সেই জন্যই তাঁর অভিনীত 'উপকার' সিনেমার চরিত্রের নামানুসারে তাঁকে 'ভারত কুমার' আখ্যাও দেওয়া হয়। সেই ‘মুকুট’ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সযত্নে আগলে রেখেছিলেন হরিকৃষ্ণ গিরি গোস্বামী ওরফে মনোজ কুমার। ভারতের রাজনীতি এবং সমাজের প্রতিফলন কয়েক দশক আগেই মনোজ কুমার তাঁর সিনেমার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁকে ‘ভবিষ্যৎদ্রষ্টা’, বললেও অত্যুক্তি হয় না।
অতীতে এক সাক্ষাৎকারে মনোজ কুমার বলেছিলেন, “দেশপ্রেম আমার রক্তে রয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার কাছ থেকে দেশপ্রেম এবং সাহিত্যচর্চার প্রতি আনুরাগ্য পেয়েছি, আর মা শিখিয়েছেন নৈতিক মূল্যবোধ।” সেই আদর্শকে পাথেয় করেই অভিনেতা-পরিচালক তাঁর ফিল্মি কেরিয়ারে একাধিক দেশাত্মবোধক সিনেমা উপহার দিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে ‘উপকার’ দিয়ে শুরু, এরপর ‘রোটি কাপড়া অউর মকান’ (১৯৭৪), ‘শহিদ’ (১৯৬৫), ‘পূরব অউর পশ্চিম’ (১৯৭০), ‘ক্রান্তি’ (১৯৮১)-র মতো সিনেমাগুলি সেই তালিকার শীর্ষে। এই ‘ক্রান্তি’ ছবিটির জন্যই মুম্বইয়ের জুহুর বাংলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন মনোজ। পরিকল্পনা ছিল, সেই জমিতে একটি থিয়েটার গড়ে তুলবেন, কিন্তু ‘ক্রান্তি’ তৈরির পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে অর্থাভাব। তাই ছবিটি বানানোর জন্য সেই সাধের বাংলোটি বিক্রি করে দেন অভিনেতা-পরিচালক। তার সেই কসরতের দাম পালটা ভালোবাসা দিয়ে দিয়েছিলেন দর্শকরা। বক্স অফিসে দারুণ হিট হয় ‘ক্রান্তি’। রাজনীতি নিয়েও বরাবর সচেতন ছিলেন মনোজ কুমার। ফিল্মি কেরিয়ারের অস্তরাগে রাজনীতিতে কেরিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০০৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য হন। মোদির সঙ্গেও একাধিকবার নির্বাচনী প্রচারে দেখা গিয়েছে তাঁকে।