সম্প্রতি, গাজা-যুদ্ধের জেরে কোলা-যুদ্ধ লেগে গিয়েছে বাংলাদেশে। একদিকে ঘৃণায় বয়কট, অন্যদিকে সহমর্মিতার বার্তা। এর জেরে এবারের গরমে ঠান্ডা পানীয় হিসাবে ‘কোকাকোলা’ বর্জন করে অনেকেই হাতে তুলে নিচ্ছে ‘মোজো’, নতুন ঠান্ডা পানীয়। ওপার বাংলা সম্প্রতি নতুন করে মেতে উঠেছে বয়কট আর স্বদেশি আন্দোলনে! লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
বিশুদ্ধ বাণিজ্য বলে কিছু নেই। চিরকালই বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনীতির সহাবস্থান। অবশ্য রাজনীতির অন্তরালে বাণিজ্য, না কি বাণিজ্যের অন্তরালে রাজনীতি– মানে, কে কাকে রিমোটের সাহায্যে কন্ট্রোল করছে, বলা শক্ত। অস্বীকার করার উপায় নেই– সম্পদ নিজের দখলে রাখতেই যুদ্ধ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আবার কখনও-কখনও সেই যুদ্ধ পরিস্থিতিটাই কাজে লেগে যায় বাণিজ্য বিস্তারে। সম্প্রতি, গাজা-যুদ্ধের জেরে কোলা-যুদ্ধ লেগে গিয়েছে বাংলাদেশে। একদিকে ঘৃণায় বয়কট, অন্যদিকে সহমর্মিতার বার্তা দেওয়ায়– সেখানে এবারের গরমে ঠান্ডা পানীয় হিসাবে ‘কোকাকোলা’ বর্জন করে অনেকেই হাতে তুলে নিচ্ছে ঠান্ডা পানীয় ‘মোজো’। ওপার বাংলা সম্প্রতি যেন নতুন করে মেতে উঠেছে বয়কট আর স্বদেশি আন্দোলনে।
কোকাকোলা বিশ্বের অন্যতম পুরনো কার্বনেটেড পানীয় উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত। ‘ঠান্ডা পানীয়’ হিসাবে দুনিয়াজুড়ে মানুষের কাছে জনপ্রিয় এই ব্র্যান্ড। বাংলাদেশের ঠান্ডা পানীয়র বাজারের বড় অংশ রয়েছে কোকাকোলার দখলে।
এদিকে, গত কয়েক মাসে গাজা-যুদ্ধে হাজার-হাজার মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। ওই যুদ্ধ বাংলাদেশে ঠান্ডা পানীয়র বাজারটাকে এমনভাবে বদলে দিচ্ছে যে, কোকাকোলার বাণিজ্যে আঘাত সহ্য করতে হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি ইজরায়েলের সেনাবাহিনী বা সরকারকে সমর্থন করে– সামাজিক মাধ্যমে সেসব সংস্থার পণ্য বর্জনের জোরদার প্রচার চলছে। তাতে কোকাকোলার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আর, কোকাকোলা বর্জনের পাশাপাশি ‘বিকল্প’ হিসাবে কোন ঠান্ডা পানীয় পান করা
যায়, কেউ কেউ সে-বিষয়েও পরামর্শ দিচ্ছে। তারা অনেকেই কোকাকোলার বদলে মোজো-কে তুলে ধরতে চাইছে।
[আরও পড়ুন: কোল্ড ড্রিঙ্কে নেশার দ্রব্য, হায়দরাবাদে অচৈতন্য তরুণীকে গাড়ির ভিতরেই ধর্ষণ!]
এর ফলে বাংলাদেশের কোম্পানি ‘আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ’-এর উৎপাদিত ঠান্ডা পানীয় মোজো-র জনপ্রিয়তা বাড়ছে। শুধু স্বাদে নয়, অন্য একটা সেন্টিমেন্টও প্রভাবিত করছে বাংলাদেশে মোজোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে। এই ঠান্ডা পানীয় সংস্থাটি গত ডিসেম্বর থেকে প্যালেস্তাইনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দঁাড়াতে ‘মোজো সাপোর্ট প্যালেস্তাইন’ নামে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যার ফলে প্রতি বোতল মোজো বিক্রি থেকে এক টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে প্যালেস্তাইনের নিপীড়িত মানুষের জন্য। সংস্থার এহেন মানবদরদি পদক্ষেপ বাংলাদেশের মানুষজনের সেন্টিমেন্টকে ছুঁয়ে যাবে, বলা বাহুল্য।
বিগত কয়েক বছর ধরে কর্পোরেটের সামাজিক দায়িত্ব পালনের কথা বিশ্বজুড়ে আলোচনা হলেও তা আদৌ কতটা পালিত হয়, যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। কিন্তু দেখা যায় কখনও-কখনও কর্পোরেটের মানবদরদি কর্মকাণ্ড আখেরে সংস্থার বাণিজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গিয়েছে, মোজো-র এসব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে কোক বয়কটের ডাক দেওয়ার পাশাপাশি দেশি পণ্য মোজো পান করার আহ্বান জানিয়েছে কেউ কেউ। বিদেশি পণ্য কোকাকোলা বয়কট করে দেশি পণ্য মোজোতে মজেছে বহু লোক। গরমের দিনে দোকানে গিয়ে ক্রেতারা মোজো-ই চাইছে। এমনকী, মোজো নেই বলে কোকাকোলা দেওয়া হলে তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে অন্য দোকানে চলে যাচ্ছে কেউ-কেউ। অর্থাৎ ঠান্ডা পানীয় গ্রহণে ঘৃণা এবং সহমর্মিতা বেশ জঁাকিয়ে বসেছে এবার ওপার বাংলার মানুষজনের মনে।
আবার, পরিস্থিতি সামাল দিতে কোক একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করে প্রচার করতে গেলে হিতে আরও বিপরীত হয়। ওই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোকাকোলা কর্তৃপক্ষ বোঝাতে চেয়েছিল, যে-তথ্যের ভিত্তিতে ক্রেতারা কোক ‘বয়কট’ করছে, সেটা সঠিক নয়। ১৩৮ বছর ধরে ১৯০টি দেশে মানুষ কোক পান করছে। তুরস্ক, স্পেন, দুবাইতেও মানুষ এই পানীয় পান করে। এমনকী, প্যালেস্তাইনেও কোকের ফ্যাক্টরি আছে। এসব তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপনটিতে ক্রেতাদের কোক কিনতে দেখানো হয়েছে। যার জন্য বিজ্ঞাপনটিতে সবশেষে বিক্রেতাটিকে বলতে শোনা গিয়েছে– ‘কোকে একটা ঢোক দেন, তারপর একটা সার্চ দেন’। এসব বার্তা দিলেও বিজ্ঞাপনটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের মানুষের সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগে। যার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা গিয়েছে বিভিন্ন মানুষজনের সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায়।
[আরও পড়ুন: ফের ভয়ংকর গুলির লড়াই ছত্তিশগড়ে, যৌথবাহিনীর এনকাউন্টারে খতম ৫ মাওবাদী]
কোকাকোলার ওই বিজ্ঞাপনটি গ্রাহকের কাছে ইতিবাচক হওয়ার বদলে বুমেরাং হয়ে বয়কট আন্দোলনের তেজ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞাপনটিতে অভিনয় করেছেন যেসব মডেল-অভিনেতা, তঁাদেরও রীতিমতো জনগণের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। বিতর্কিত বিজ্ঞাপনটিতে ‘মডেল’ হিসাবে অভিনয় করা শিমুল শর্মাকে বয়কট হুমকির পরিস্থিতি দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ‘পোস্ট’ করে দেশবাসীর কাছে তঁাকে ক্ষমা চাইতেও দেখা যায়।
বাংলাদেশে শহরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকেও বয়কটের আন্দোলনে শামিল হতে দেখা গিয়েছে। বয়কটের বিস্তার বাড়ার পর ডাক দেওয়া হয়েছে কোকাকোলা, পেপসি-সহ বিভিন্ন বিদেশি পণ্য বর্জনে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই কোম্পানিগুলির ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এ-বছর কোকাকোলার বিক্রি ৬০ শতাংশ কমে গিয়েছে বলে আশঙ্কা। আর, ঠান্ডা পানীয়র বাজারে মোজোর ২৯ শতাংশ শেয়ার বেড়ে দঁাড়িয়েছে ৩৯ শতাংশে।
কাউকে কোনও কাজ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য অর্থনৈতিক বয়কট যুগ-যুগ ধরে চলে আসা একটি পন্থা। পরাধীন ভারতেও বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় দু’টি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল– বিদেশি পণ্য বয়কট এবং ‘বিকল্প’ হিসাবে স্বদেশি পণ্য উৎপাদন। কারণ, নিজেরা উৎপাদন না-করলে, বিকল্প পণ্য না-দিতে পারলে সাধারণ মানুষ কী করবে! এক্ষেত্রেও কোকাকোলা বয়কট করা হলে ‘বিকল্প’ ঠান্ডা পানীয় মোজো কতটা সরবরাহ করতে পারছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তৃষ্ণা নিবারণের জন্য কোকাকোলার ‘বিকল্প’ কিছু না-পেলে তখন কিন্তু বয়কটের মানসিকতা থাকা সত্ত্বেও ক্রেতারা বাধ্য হয়ে তা পান করবে। তবে, বাংলাদেশ যে-বয়কটের পথ দেখাচ্ছে, গাজা-যুদ্ধ বেশি দিন চললে আগামী দিনে ইজরায়েল-বিরোধী দেশগুলিরও সেই পথে জোরদার হঁাটার সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভুললে হবে না, ইরাকে আমেরিকান আগ্রাসনের সময় আরব দেশগুলি কিন্তু মার্কিন পণ্য বয়কট করেছিল।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
sidmukh12@gmail.com