স্টাফ রিপোর্টার: একজনের বয়স ছ’দিন। অন্যজন পৃথিবীর আলো দেখেছে তেরো দিন হল। দুই একরত্তিকে নিয়ে যমে-ডাক্তারে টানাটানি! একজনের তো হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে! চমকে ওঠার এখানেই শেষ নয়। আরও চমকাতে হবে, যখন শুনবেন, কোলাঘাটের নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন দুই সদ্যোজাতের শরীরে মিলেছে করোনার (Coronavirus) অ্যান্টিবডি! মানে, অনেকদিন আগেই তাদের শরীরে কোভিড ভাইরাস প্রবেশ করেছিল, যার জেরে রক্তে অ্যান্টিবডিও তৈরি হয়ে গিয়েছে।
অনেক দিন আগে? ভূমিষ্ঠই তো হয়েছে মাত্র ১৪৪ ঘণ্টা হল! এখানেই চূড়ান্ত চমক। ডাক্তারবাবুরা জানাচ্ছেন, বাচ্চা দু’টি মায়ের পেটে থাকতেই কোভিডের খপ্পরে পড়েছে, যা কিনা দেশে নজিরবিহীন। দুই শিশুর চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রবীর ভৌমিকের কথায়, “মায়ের গর্ভেই করোনা আক্রান্ত হয়েছে দু’জন। এমন ঘটনা রাজ্যে তো বটেই, দেশের মধ্যে প্রথম।” দুই শিশুর একজনের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরে। অন্যজন হলদিয়ার। ১৩ দিন বয়সি বাচ্চাটি ভগবানপুর থেকে গত শনিবার আসে কোলাঘাটের নার্সিংহোমে।
[আরও পড়ুন: নমুনা পরীক্ষা বাড়তেই বাংলায় বাড়ল দৈনিক করোনা সংক্রমণ, বৃদ্ধি পেল মৃতের সংখ্যাও]
আচমকা তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। হলদিয়া থেকে কোলাঘাট দীর্ঘ ৫৮ কিলোমিটার পথ পেরোতে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে তুলতুলে শরীর। নার্সিংহোমে যখন আনা হয় হার্টবিট মাত্র ২০! সঙ্গে সঙ্গে ভেন্টিলেশনে ঢোকানো হয়। বুকের এক্স-রে করে দেখা যায়, ঘসা কাচের মতো অবস্থা ফুসফুসের। এরপর ইকোকার্ডিওগ্রাফি। সেখানে ধরা পড়ে, হার্টের একটি প্রকোষ্ঠ (লেফ্ট ভেন্ট্রিকল) কাজ করছে না। দুধের বাচ্চার হার্ট অ্যাটাক! সন্দেহ হয় চিকিৎসকদের। ডা. ভৌমিকের কথায়, করোনা থেকে বয়স্কদের হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে তেমনটা শোনা যায়নি। সন্দেহ হওয়ার বাচ্চাটির অ্যান্টিবডি টেস্ট করাই। আশঙ্কাই সত্যি! শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি। ছ’দিনের বাচ্চাটি ‘প্রিম্যাচিওর’। নির্দিষ্ট সময়ের আড়াই মাস আগেই ভূমিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে। ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই কম। ১ কেজি ১০০ গ্রাম। জন্ম থেকেই তার শ্বাসকষ্ট। বাইরের একটি নার্সিংহোম থেকে ছ’দিনের একরত্তিও রেফার হয়ে আসে ওই নার্সিংহোমে। দ্রুত নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ঢোকানো হয়। এক্সরে করে দেখা যায়, নবজাতকের ডান দিকের ফুসফুসে গভীর ক্ষত। সেখানে নল ঢুকিয়ে বাতাস বের করা হয়। বাঁ দিকের অংশে চেপে বসেছে নিউমোনিয়া। কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও কাজ হচ্ছে না। শত চেষ্টাতেও কমানো যাচ্ছে না সেই নিউমোনিয়া। এক্ষেত্রেও অ্যান্টিবডি টেস্ট করিয়ে দেখা যায় আইজিজি পজিটিভ।
কী এই আইজিজি? করোনার ভাইরাসের প্রোটিন স্পাইককে শরীর অ্যান্টিজেন হিসাবে গণ্য করে। শরীরে করোনার অ্যান্টিজেন প্রবেশ করলেই শরীর সতর্ক হয়ে যায়। তখন সেই অ্যান্টিজেন ধ্বংস করতে প্রথমেই যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তাকে বলে আইজিএম। কিন্তু তার আয়ু কম। তাই সেটা কপি করে অন্য একটি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যাকে বলে আইজিজি। এই প্রোটিন কিন্তু অনেক দিন ধরে শরীরে সেই অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দুই সদ্যোজাতর শরীরে এই আইজিজি-ই পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু তার পরিমাণ যৎসামান্য বলে তা করোনার বিরুদ্ধে লড়তে পারেনি। আপাতত দুই শিশুই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। চিকিৎসক বলেন, “দুই পরিবারকেই বলেছি, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু বাঁচার আশা অত্যন্ত ক্ষীণ।” এমতাবস্থায় দুই মা- সরস্বতী মাইতি আর রুণা পারভিন তাঁদের ঈশ্বর-আল্লাহর কাছেই ছেড়ে দিয়েছেন সন্তানের ভাগ্য। ঘটনা হল, মা করোনা আক্রান্ত হলে তাঁর প্ল্যাসেন্টার তরল থেকে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে পারে কি না, তা নিয়ে জোরালো বিতর্ক রয়েছে। মায়ের করোনা ছিল কি না নিশ্চিত হতে মঙ্গলবার দুই মায়েরও অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়েছে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নিশান্তদেব ঘটক জানিয়েছেন, আইজিজি পজিটিভ মানেই যে শিশুদু’টি গর্ভাবস্থায় কোভিড পজিটিভ হয়েছে এমনটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। যদি ভূমিষ্ঠ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই শিশুর লালারস নেওয়া হত এবং সেই রিপোর্ট পজিটিভ আসত তবেই বলা যেত এটা ভার্টিকাল ট্রান্সমিশন।