shono
Advertisement

Breaking News

Rishabh Pant

ম‌্যাঞ্চেস্টারে ভাঙা পা নিয়েই মহাকাব‌্য, ক্রিকেট পৃথিবী দেখল ঋষভ পন্থের প্রকৃত পুরুষাকার

অনমনীয় চরিত্রের কাছে ভাঙা পা কী আর এমন?
Published By: Subhajit MandalPosted: 11:28 AM Jul 25, 2025Updated: 12:38 PM Jul 25, 2025

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ‌্যায়: ঋষভ পন্থকে (Rishabh Pant) দেখলে আর যা-ই হোক, কিছুতেই শিরস্ত্রাণ-বর্ম পরিহিত কর্কশ যোদ্ধা মনে হয় না, হাতে যাঁর বিপ্লবের তরবারি আছে! ভারতীয় কিপার-ব‌্যাটার বরাবরই একটু ফোলা-ফোলা। গোলগাল। দুলকি চালে হাঁটেন। অদ্ভুত কায়দায় টেনে-টেনে কথা বলেন। হাসলে কেন জানি মনে হয়, দেবশিশু। অধুনা পন্থ মাঠে খেলতে নামলে দেখছি, টিভি ধারাভাষ‌্যকাররা দ্রুত নড়েচড়ে বসেন। সর্বক্ষণ একটা মৃদু টেনশন ছেয়ে থাকে তাঁকে নিয়ে প্রত‌্যাশার ছায়াপথে। কখন যে কী করে বসবেন পন্থ, কেউ তো জানে না। কেউ আগাম আন্দাজও পায় না। মাঝেসাঝে এমন এক-একখানা শট খেলেন পন্থ, ক্রিকেটের ‘প্রপিতামহ’ ডব্লিউ জি গ্রেস দেখলে নিঃসন্দেহে ভিরমি খেতেন! আনুষাঙ্গিকও তার রয়েছে অকাতর। রান নিতে গেলে পন্থের জুতো খুলে যায়! ছয় মারতে গেলে হাত থেকে ব‌্যাট উড়ে যায়! আর সমস্ত অলুক্ষুণে কাণ্ড-কারখানা ঘটানোর পর নিয়মিত একটা জিনিস করেন পন্থ। হাসেন। যা নিষ্পাপ। স্বর্গীয়। সংক্রামক। ভুবনভোলানো।

বৃহস্পতিবারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড নামক এক দর্পণের হাত ধরে সমগ্র ক্রিকেট পৃথিবী ঋষভ পন্থের প্রকৃত পুরুষাকার দেখে নিল! বুঝে নিল, দৃষ্টিবোধের চেয়ে ভ্রমাত্মক বোধহয় আর কিছু হয় না। মানুষ মানুষকে দেখে ভাবে এক, পরে সে বেরোয় আর এক! গোলগাল-ফুলো-ফুলো, সাতাশ বছরের পন্থ বেরোলেন যেমন। যদিও জানা উচিত ছিল। বোঝা উচিত ছিল। বছর আড়াই আগে যে গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন পন্থ, তার প্রকোপ কাটিয়ে বেরনো, শরীর-মন দুইয়ের সঙ্গে সমান্তরাল যুদ্ধ চালিয়ে জিতে ফেরা, সহজ ছিল না মোটে। মুশকিল হল, লোকে সে ঘটনার ধারাবিবরণী কানে শুনেছে। কাগজে পড়েছে। চোখে কখনও দেখেনি। তাই পন্থের পুরুষাকার ক্রিকেট-জনতার চাক্ষুষ করা হয়নি। বৃহস্পতিবারের পর সে ‘আক্ষেপ’ আর থাকার কথা নয়!

Advertisement

ছবি দেবাশিস সেন



শার্দূল ঠাকুর আউট হওয়ার পর খর্বকায় অবয়বকে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে বেরোতে দেখছিলাম যখন, মন বলছিল দৃষ্টি বিশ্বাসঘাতকতা করছে নিঃসন্দেহে। এ আবার হয় নাকি? ঈষৎ পূর্বে যে বোর্ডের বুলেটিন এসেছে, পায়ের পাতার হাড় ভেঙেছে পন্থের। ছ’সপ্তাহ বিশ্রাম প্রয়োজন তাঁর। ওভালে সিরিজের শেষ টেস্ট আর খেলা হবে না কিপার-ব‌্যাটারের। তবে এটা লেখা ছিল যে, ম‌্যাঞ্চেস্টারে টিমের প্রয়োজন অনুপাতে ব‌্যাট করবেন পন্থ। মনে হয়েছিল, কিছু একটা লিখলেই হল! পা ভাঙলে কেউ আবার ব‌্যাট করতে নামে নাকি? মানছি, অতীতে ভাঙা চোয়াল নিয়ে অনিল কুম্বলে বোলিং করেছেন অ‌্যান্টিগা টেস্টে। উইকেট নিয়েছেন। এ-ও জানা, প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রেম স্মিথের ভাঙা হাত নিয়ে টিমের স্বার্থে ব‌্যাট করতে নামার ইতিহাস। যা ক্রিকেট লোকগাথায় ঢুকে পড়েছে বহু দিন। কিন্তু ভাঙা হাত আর ভাঙা পা, কখনও এক নয়। কমেন্ট্রিবক্সে সঞ্জয় মঞ্জরেকররাই তা বলছিলেন। বলছিলেন যে, ভাঙা হাতের চেয়ে ভাঙা পা নিয়ে ব‌্যাট করা বহু, বহু কঠিন।

মুশকিল হল, ক্রিকেট সাংবাদিক কোন ছাড়, মঞ্জরেকরের মতো বিদগ্ধ প্রাজ্ঞরাও আদতে একটা বিষয় বুঝতে পারেননি। ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি দিয়ে এ দিন মোটেও ঋষভ পন্থ নামেননি! বরং বিদেশের মাঠে আক্রান্ত, রক্তাক্ত, এক চলমান ‘ভারতবর্ষ’ নামছিল, প্রত‌্যাঘাতের স্পৃহা যার একমাত্র পুঁজি, বিশ্বাসের একমাত্র সহায়-সম্বল! লাল টুকটুকে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডকে দেখলাম, সমবেত উঠে দাঁড়িয়ে পন্থকে উষ্ণ অভ‌্যর্থনার গালিচা পেতে দিয়েছে। দেবেই। অলৌকিক তো আর রোজ-রোজ ঘটে না।



‌‌কী করেনি ইংল‌্যান্ড? কী করেননি এ দিন তারা পন্থ-মায়ার অন্তর্জাল ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে? বেন স্টোকস-জোফ্রা আর্চাররা এ দিন ভারতীয় কিপার-ব‌্যাটারের পা নিশানা করে যে গোলাগুলি নিয়মিত ছুঁড়ে গিয়েছেন, সে সমস্তকে ‘বল’ বলে খামোখা অপমানের প্রয়োজন নেই! প্রত‌্যেকটা শব্দভেদী বাণ! আর কোন পা? না, যে পায়ে প‌্যাডের অন্তরালে পেল্লায় একখানা ‘প্লাস্টার’ রয়েছে! ইংরেজদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। খেলার মাঠ মায়াদয়া দেখানোর জায়গা নয়, সেখানে কুরুক্ষেত্রের ধর্ম চলে। বলের লাইন মিস করায়, কতক বার পন্থের পায়ে লাগল প্রচণ্ড। শুধু এক ইঞ্চি তাঁকে নড়ানো গেল না! বরং সিঙ্গলস নিতে শুরু করলেন তিনি (যা অকল্পনীয়, কারণ সবাই ভেবেছিলেন, পন্থ নেমে যতটা পারবেন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তাণ্ডব চালিয়ে ফিরে যাবেন)। শেষ দিকে তো জোফ্রা আর্চারের ঘণ্টায় দেড়শো কিলোমিটার গতিবেগের ডেলিভারিকে সপাটে মাঠের বাইরে ফেলে দিলেন! অথচ শিশুও জানে যে, ভাঙা পায়ে ফিট মুভমেন্ট করাই সম্ভব নয়। আর পন্থ, তিনি কি না জোফ্রা নামক পেস-দৈত‌্যকে অকুতোভয় ছয় মারছেন, স্টোকসকে বাউন্ডারি মেরে হাফসেঞ্চুরি (৫৪) করছেন!

এটা ঘটনা যে, তাঁর রোমহর্ষক বীরগাথার পরেও ম‌্যাঞ্চেস্টার টেস্টে প্রবল চাপে ভারত। প্রথম ইনিংসে ৩৫৮-র বেশি তোলা যায়নি। জসপ্রীত বুমরা নেতৃত্বাধীন ভারতীয় পেস বোলিংকেও বড় নির্বিষ লাগছে। ওভার পিছু প্রায় পাঁচ করে তুলে ইংল‌্যান্ড দ্বিতীয় দিন শেষে প্রথম ইনিংসে ২২৫-২। জাক ক্রলি ৮৪। বেন ডাকেট ৯৪। জো রুট ব‌্যাটিং ১১। যিনি থেকে গেলে অধিকতর চোখ রাঙাবেন। সব ঠিক আছে। কিন্তু ক্রিকেট কবেই বা স্কোরবোর্ডের কাছে ঋণী থেকেছে? তাই টেস্ট নিয়ে আজ আর লিখে লাভ নেই। আজ থেকে শতবর্ষ পর যে মহাকাল স্কোর মনে রাখবে না। রেজাল্ট স্মরণ করবে না। তার দায় শুধু চরিত্রের কাছে। দিন শেষে যে চরিত্র থেকে যাবে মানুষের মনে। তার রাত-স্বপ্নের কল্পলোকে।

ভুল নয়, যা ভুল নয়। জুলাইয়ের চতুর্থ বৃহস্পতিবার যে কখনওই ক্রলির কভার ড্রাইভ, ডাকেটের পুল, বেন স্টোকসের পরাক্রমী বোলিং নিয়ে লেখার দিন নয়। বরং এক জখম ক্রিকেট-বীরপুরুষের অদম‌্য লড়াই নিয়ে লেখার দিন, যে প্রতিটা শটে আজ বুঝিয়ে দিয়েছে, ঠিক কী ভাবে সে দু’বছর আগে মৃত‌্যুকে হারিয়ে ফিরে এসেছিল! গাড়ি দুর্ঘটনার পর প্রথম-প্রথম নিজে উঠে দাঁড়াতে পারতেন না পন্থ। চারটে লোক লাগত। নিজে-নিজে ‘ব্রাশ’ করতে পারার দিন যিনি ভেবেছিলেন, যাক শেষ পর্যন্ত জীবনে ফিরলাম! সেই ক্রিকেটারের কাছে, সেই অনমনীয় চরিত্রের কাছে ভাঙা পা কী আর এমন? আর তাঁর অসমসাহসী ‘জঙ্গ’-এর দিনে, এক দিনের টেস্ট ম‌্যাচ রিপোর্টও বা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ? জানি, রাগ করবেন। ট্র্যাফোর্ড টেস্টের দ্বিতীয় দিনের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট না পেয়ে। কিন্তু করলেও কিছু করার নেই। দেয়ার আর মোর থিংস অন হেভেন অ‌্যান্ড আর্থ, হোরাশিও, দ‌্যান আর ড্রেমট অফ...!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • বছর আড়াই আগে যে গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন পন্থ।
  • তার প্রকোপ কাটিয়ে বেরনো, শরীর-মন দুইয়ের সঙ্গে সমান্তরাল যুদ্ধ চালিয়ে জিতে ফেরা, সহজ ছিল না মোটে।
  • মুশকিল হল, লোকে সে ঘটনার ধারাবিবরণী কানে শুনেছে।
Advertisement