স্টাফ রিপোর্টার: অ্যাডিলেড টেস্ট তখন শেষ। মিনিট পনেরো পেরিয়েছে সবে। অতীব বিষণ্ণ, বিমর্ষ ভাবে ডাগআউটে বসেছিলেন রোহিত শর্মা। একা। সুবিশাল অ্যাডিলেড ওভালের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে। কী দেখছিলেন ভারত অধিনায়ক? নিজের অদৃশ্য দেওয়াল লিখন কি? নিজের ভবিতব্য? ভবিষ্যৎ?
একটু পর ডাক পড়ল রোহিতের। প্রথাগত পুরস্কার-বিতরণী মঞ্চে যেতে হবে। কিন্তু মঞ্চে ওঠার সময় মৃদু ‘বিরতি’ নিলেন বোধহয়। আসলে সঞ্চালিকা নাম ডাকছেন বটে, শুধু ভুল নাম! ভারত অধিনায়ক হিসেবে তিনি ভুল করে রোহিতের বদলে জশপ্রীত বলে ফেলেছেন! সেই জশপ্রীত বুমরাহ, যাঁর নেতৃত্বে পারথ টেস্টে ২৯৫ রানের বিরাট জয় তুলে নিয়েছিল ভারত। সেই জশপ্রীত, জয়-জয়কার পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও অ্যাডিলেড টেস্টে যাঁকে অধিনায়কত্বের তাজ ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল টিমের নিয়মিত অধিনায়ককে, রোহিত শর্মাকে! সঞ্চালকের ভুল ধরতে ঈষৎ সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত রোববার অ্যাডিলেডের পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে উঠেছিলেন ভারত অধিনায়ক। গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিতে আসা ট্রাভিস হেডের পাশে।
সময়-সময় ভাবলে অবাকই লাগবে যে, যে ক্রিকেটারের সঙ্গে রোহিতের নাম ‘গুলিয়ে’ ফেলা হল, তাঁর সংক্ষিপ্ত দায়িত্ব-প্রাপ্তির আমলে কত কী-ই বা বদলে গিয়েছিল? দেশ থেকে নিউজিল্যান্ডের কাছে ০-৩ চুনকাম হয়ে অস্ট্রেলিয়া ঢুকেছিল ভারত। সবাই প্রহর গুণেছিল, পারথে বর্ডার-গাভাসকর ট্রফির প্রথম টেস্টে আর এক বিপর্যয়ের। কিন্তু সবাইকে অবাক করে অস্ট্রেলিয়াকে তাদের দেশে সবচেয়ে বড় মার্জিনে গুঁড়িয়ে দেয় ভারত। এবং তার পরই রোহিত শর্মার ভারতীয় সংসারে আগমন। দুর্ভাগ্য তাঁর, অ্যাডিলেড ওভালে তিনি যা যা করার চেষ্টা করেছেন, সবই দিন শেষে জলে গিয়েছে। তা সে রাহুল-যশস্বীর ওপেনিং জুটি অক্ষত রেখে নিজেকে মিডল অর্ডারে নামিয়ে আনার সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়াই হোক কিংবা টস জিতে ব্যাট করার সঠিক সিদ্ধান্ত। তার উপর ধরা যাক, হর্ষিত রানার উপর আস্থা রাখার সিদ্ধান্ত। গোলাপি বলে ভারতীয় নেটে আকাশ দীপ তুলনায় অনেক ভালো বোলিং করা সত্ত্বেও দিল্লি পেসারকেই আরও একটা সুযোগ দেওয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে স্বয়ং তাঁর নিজের দৃষ্টিকটু ভাবে আউট হওয়া। অ্যাডিলেড ওভালে কিছুই ঠিক গেল না রোহিতের। কিছুই ঠিক হল না। আর এ সবই হল, জশপ্রীতের সঙ্গে তাঁর নাম ‘গুলিয়ে’ ফেলার আগে!
এটা ঘটনা যে, অ্যাডিলেড হারের সব দায় রোহিতের নয়। সব দায়িত্বও নয়। এবং সেটা হওয়া উচিতও নয়। কিন্তু দিন শেষে তিনিই যে আবার অধিনায়ক! দিন শেষে সর্বাধিক কথা-সমালোচনা যে তাঁকে নিয়েই হবে, কে না জানে! আর সেটা হচ্ছেও। এই যেমন সবাই বলছে এখন রোহিতকে নিয়ে। তাঁর ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে। সুনীল গাভাসকর। কপিল দেব। রবি শাস্ত্রী। গাভাসকর-শাস্ত্রী একযোগে রায় দিয়ে দিয়েছেন যে, ব্রিসবেনে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে রোহিতের অবিলম্বে উচিত, ওপেনিংয়ে ফিরে আসা। ‘‘রোহিতের উচিত ওপেনিংয়ে ফিরে আসা। আমাদের মনে রাখা দরকার, কেন রাহুল পারথে ওপেন করেছিল? করেছিল, কারণ রোহিত ছিল না বলে। আমি বুঝতে পারছি, কেন অ্যাডিলেডে রাহুলকে পাঠানো হয়েছিল ওপেনিংয়ে। কারণ, পারথে যশস্বীর সঙ্গে ওপেন করতে নেমে ওর দু’শো প্লাস রানের পার্টনারশিপ। কিন্তু অ্যাডিলেডে রাহুল যখন ওপেনিংয়ে পারেনি, তখন ওকে পাঁচ কিংবা ছ’নম্বরে ফিরিয়ে আনা উচিত। রোহিত যদি ওপেন করতে নেমে দ্রুত রান করা শুরু করে দেয়, কে বলতে পারে তার পর সেঞ্চুরিও করে দেবে না?’’ সম্প্রচারকারী সংস্থায় বলে দিয়েছেন গাভাসকর।
শাস্ত্রীও একই নিদান দিয়েছেন। তিনি বলে দিয়েছেন, ‘‘আমি সব সময় রোহিতকে ওপেনিংয়ে দেখতে চাই। কারণ, ওপেনিংয়েই ও আগ্রাসী হতে পারবে। নিজের খেলাটা খেলতে পারবে। অ্যাডিলেডে রোহিতের শরীরীভাষা দেখে মনে হল, কিছুটা যেন ঝিমিয়ে রয়েছে ও। আমি রোহিতকে আর একটু আগ্রাসী মেজাজে দেখতে চাই। আর একটু আগুনে মেজাজে দেখতে চাই।’’ তিরাশির বিশ্বজয়ী ভারত অধিনায়ক কপিল দেব নিখাঞ্জ–তিনি ব্রিসবেন টেস্টে রোহিতের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে কিছু বলতে যাননি। তাঁর একটাই বক্তব্য। একটাই আর্জি। রোহিত শর্মার প্রত্যাবর্তন ক্ষমতাকে যেন সন্দেহ না করা হয়। ‘‘মাত্র ছ’মাস আগে রোহিত অধিনায়ক হিসেবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে। কোথায়, তখন তো কেউ কিছু বলেনি ওকে নিয়ে। মাত্র একটা-দু’টো ম্যাচ দেখে কারও অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়া উচিত নয়। আমি বিশ্বাস করি, রোহিতের যা ক্ষমতা, তাতে ও ভালো ভাবেই প্রত্যাবর্তন করবে,’’ সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলে দিয়েছেন কপিল। বিশ্বজয়ী ভারত অধিনায়ককে জিজ্ঞাসা করা হয়, রোহিতের উত্তরসূরি হিসেবে জশপ্রীত বুমরাহকে ভাবা যায় কি না? টেস্ট অধিনায়কত্ব তাঁর হাতে তুলে দেওয়া যায় কি না? ‘‘খুব তাড়াতাড়ি বলা হয়ে যাবে সেটা। মাত্র একটা ম্যাচ দেখে যেমন বলা উচিত নয়, অমুক সেরা। তেমনই একটা ম্যাচ দেখে এটাও বলা উচিত নয় যে, অমুকের দ্বারা হবে না। আর রোহিত নিয়ে এত বলার দরকার নেই। বিরাটের মতো আমাদের দেশের সেরা চার ব্যাটারের মধ্যে থাকবে রোহিত। যদি ওর মনে হয়, সময়টা ভালো যাচ্ছে না, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে ওকে, তা হলে কী করে সেই অবস্থা থেকে বেরনো সম্ভব, রোহিতকেই ভেবে বের করতে হবে।’’ ১৪ ডিসেম্বর থেকে ব্রিসবেনে শুরু হওয়া টেস্ট জিতে ভারত সিরিজে পুনরায় ফিরে আসবে কি না জানা নেই। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত, ব্রিসবেন পর্যন্ত এ পর্যালোচনা, এ ময়নাতদন্ত চলবে। রোহিত গুরুনাথ শর্মা ও তাঁর ব্যাটিং অর্ডারের!