অরিঞ্জয় বোস: ওই তো, ওই তো বিখ্যাত সেই প্লেয়ার্স টানেল, যা দিয়ে ড্রেসিংরুমের ‘গর্ভগৃহ’ থেকে এত দিন বেরিয়ে আসতেন তিনি, উদ্ধত গ্রীবা আর উন্নাসিক পেটানো চেহারা নিয়ে, এসে দাঁড়াতেন সতীর্থদের সঙ্গে। আজ ব্রুনো ফার্নান্ডেজ আছেন, মার্কাস র্যাশফোর্ডকেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি– ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo) কোথায়?
আচ্ছা, ওটাই সেই অপমানের রিজার্ভ বেঞ্চ না? যেখানে শুকনো মুখে শেষের দিকে বসে থাকতে দেখা যেত তাঁকে, দেখতে হত মাঠে লাল জার্সিতে বাকিদের দাপাদাপি। আর তিনি রোনাল্ডো, লাল জার্সির ঔদ্ধত্যের ‘জনক’ হয়েও চুপচাপ বসে থাকতেন, কোনও এক এরিক টান হাগের (Erik Ten Hag) অঙ্গুলিহেলনে। রক্তিম রিজার্ভ বেঞ্চ আজও আছে, কিন্তু তিনি আর সেখানে নেই। অপমানে রাঙা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আর ওখানে বসেন না।
আরে, ওরা বিখ্যাত সাত নম্বর জার্সি পরে এসেছে কেন? ওদের পিঠে কেন এখনও রোনাল্ডো লেখা? যে প্লেয়ার নেই, যে প্লেয়ার ক্লাবের মানসম্মান ধ্বংস করে চলে গিয়েছে, তাকে আবার কেউ মনে রাখে নাকি? কিন্তু কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন ওদের, দেখবেন কেমন বিদ্রোহী চাহনি পাবেন! কী করা যাবে, ওদের পৃথিবীতে ক্রিশ্চিয়ানো যে অবিনশ্বর।
ফুটবল আপনার ‘কুলদেবতা’ হলে, জীবদ্দশায় একবার অন্তত ওল্ড ট্র্যাফোর্ড (Old Traford) নামের উপাসনা-গৃহে ঘুরে যাওয়া উচিত। আমাদের কলকাতায় স্টেডিয়াম সংলগ্ন অঞ্চলে যেমন ছুটকো খাবারের দোকান থাকে, ‘রেড ডেভিলস’ (Red Devils) হেডকোয়ার্টার্সেও তাই, শুধু পরিধিতে আরও বড়। হট ডগ, আইসক্রিম, কী না বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গে দেদার টিকিট-কালোবাজারি! আজ্ঞে মহাশয়, কালোবাজারি। মোহনবাগানের (Mohun Bagan) খেলা থাকলে কলকাতায় যেমন টিকিট কালোবাজারি চলে, শাহরুখ খানের সিনেমা এলে যেমন দু’শোর টিকিট পাঁচশোয় অবলীলায় উড়ে যায়, এ তল্লাটেও হুবহু তাই! আর আছে ‘রক্তবর্ণ’ অভ্যর্থনা! আছে লাল জার্সির ইউনাইটেড সমর্থক-সৃষ্ট সমর্থনের লোহিত-সাগর, যার আবেগের স্রোতে একবার পা দিলে, মুহূর্তে তার ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যেতে হবে।
[আরও পড়ুন: ‘মেসি নয়, এমবাপেরই পাওয়া উচিত ছিল সোনার বল’, বিতর্ক উসকে দিলেন রোনাল্ডো]
মঙ্গলবার ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন স্ট্যান্ডে, প্রিমিয়ার লিগে (EPL) ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো-উত্তর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্রথম ম্যাচ দেখতে বসে, ওই লোহিত-আবেগের টানে হারিয়ে যেতে যেতেও কথাটা বারবার মনে হচ্ছিল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো কি সত্যি নেই? নাকি না থেকেও আছেন অদৃশ্য ভাবে, শুকতারা থেকে যায় যেমন? নইলে কী ব্যাখ্যা হয়, স্টেডিয়াম পার্শ্ববর্তী পাব ‘দ্য ট্র্যাফোর্ড-এর দেওয়াল-চিত্রের? যেখানে আজও থেকে গিয়েছেন রোনাল্ডো, ম্যুরালের ‘ছদ্মবেশে’? কী ব্যাখ্যা হয়, পল নামক রোনাল্ডো সমর্থকের, যিনি ক্লাব সমর্থকদের কাছে অবিরাম দুয়ো খেয়েও ছাড়তে পারেন না পুরনো ভালবাসা?
নাহ্, এক সময়ের প্রিয় পর্তুগিজ সন্তানের জন্য মঙ্গলবারের নটিংহ্যাম ফরেস্ট ম্যাচে কোনও ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ রাখেনি ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। বরং আবারও জিতিয়ে দিয়েছে ইন্দ্রলুপ্ত এরিক টেন হাগকে, তাঁর সিদ্ধান্তকে, সিআরের (CR) দিকে আরও একবার তাচ্ছিল্যের আলকাতরা ছিটিয়ে দিয়ে। লাগেনি তো তাঁকে, রোনাল্ডো ছেড়ে যাওয়ার পরে প্রিমিয়ার লিগের (Premier League) প্রথম ম্যাচে ইউনাইটেড (Man United) জিতেছে তিন গোলে, প্রতিপক্ষকে ফুৎকারে উড়িয়ে। কে আর তাই পাত্তা দেবে পলদের চোখের জলকে, যারা ইউনাইটেডকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেও হৃদয়টা সিআরের জন্য ছেড়ে বসেছিল? একা পল নন। তাঁর বেশ কয়েক জন বন্ধুবান্ধবকেও পাওয়া গেল মাঠের এক কোণে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর হিমহিমে শীতে গুটিসুটি মেরে খেলা দেখছিলেন। তা, ওঁদের মারফতই শোনা গেল, ইউনাইটড সমর্থকদের মধ্যে এখন একটা অদৃশ্য বিভাজন হয়ে গিয়েছে। একদল মনে করে, রোনাল্ডোর সঙ্গে ক্লাব যা করেছে, ঠিক করেছে। পিয়ার্স মর্গ্যানকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন রোনাল্ডো, যা বলেছেন ক্লাব নিয়ে, তার পর তাঁকে রাখা উচিত হত না। আর একদল মনে করে, ক্লাব যা খুশি করে করুক, রোনাল্ডো রোনাল্ডোই। ইউনাইটেড আজ ইউনাইটেড হয়েছে, তাঁর জন্য।
আশেপাশের কানফাটানো গর্জনে হঠাৎ আড্ডার তালটা কেটে গেল। কী না, মার্কাস র্যাশফোর্ড গোল করেছেন (পরে মার্শিয়াল আর ফ্রেডও করলেন)। যাঁকে কি না সিআরের উত্তরসুরি ধরছে সবাই। ব্রাজিল মিডফিল্ডার কাসেমিরো নিয়েও সবাই প্রবল পুলকিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি, বলাবলি চলছে যে, ‘স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন (Sir Alex Ferguson) ছেড়ে দেওয়ার পরে কাসেমিরোই আমাদের সেরা আমদানি!’ দেখলাম, সেই সমস্ত তর্জন-গর্জন শুনে কতিপয় সিআর-উপাসককুলের ঠোঁটে বিষণ্ণ হাসি। কেউ কেউ বললেন যে, রাস্তাঘাটে তাঁদের দেখলে নাকি ইউনাইটেড সমর্থকরা টিটকিরি দেন, ‘নাথিং অ্যাবাভ দ্য ক্লাব।’ বার্তা জলবৎ, ক্লাবের উপর সিআরও না। নাহ্, টেন হাগের উপর রাগ নেই এঁদের। এঁরা শুধু বুঝে পান না, স্বদেশীয় হয়েও কী করে রোনাল্ডোকে পর্তুগাল বেঞ্চে বসিয়ে রাখলেন ফের্নান্দো স্যান্টোস? তাও বিশ্বকাপ ম্যাচে? ওঁদেরই একজন বললেন, সিআর আল নাসেরেই যাচ্ছেন। আর তাঁর ছেলে যাচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদ (Real Madrid)। ইউনাইটেড ছেড়ে।
[আরও পড়ুন: স্মরণীয় করে রাখা হবে আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেসির ঘর বদলে যাবে মিউজিয়ামে]
শেষ, সব শেষ।
তবু শেষ বললেই কি শেষ? ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ফুটবল-জীবন যে অবিকল রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মতো, চিরকাল যা ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’ যে টানে তাঁকে ট্রেনিং গ্রাউন্ডে দেখামাত্র রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকরা প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের কাছে আকুল আবেদন রাখেন–ফিরিয়ে আনো ওকে, শেষবারের মতো ফিরিয়ে আনো ক্রিশ্চিয়ানোকে। যে টানে প্রিয় ক্লাবের জয়েও বজ্রাহতের মতো ওল্ড ট্র্যাফোর্ড গ্যালারিতে বসে থাকেন কতিপয় পলরা, টিমের জয়ের লোহিত-আদর যাঁদের ছুঁয়েও ছুঁতে পারে না। কী করা যাবে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এ হেন ‘সিআর-দ্বীপপুঞ্জের’ জীবনযাপনই এমন, দর্শনই এমন। নাথিং অ্যাবাভ দ্য ক্লাব। বাট এনিথিং ফর ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো!