‘ডানা’ সাইক্লোনের ভয়ংকর অবতরণ দেখতে ছুটে এসেছিল কিছু মানুষ। কীসের টানে? ধ্বংসলীলা ‘উপভোগ’ করার এত আগ্রহ কেন?
প্রিন্সেস ডায়না নিজের ইচ্ছায় রাজি হয়েছেন এই বিকট নিষ্ঠুরতা এবং ভয়ের ট্যুরে। তিনি এসেছেন বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ‘ডার্ক মিউজিয়াম’-এ, যেখানে কাচের শোকেসে সারি-সারি সাজানো সেসব দর্শনীয় বস্তু, যারা জড়িয়ে আছে বীভৎস খুন আর কদর্য অপরাধের সঙ্গে। “ইয়োর হাইনেস, আপনি এবার দেখুন এই দূরবিনটাকে। এক জঘন্য অপরাধী তার প্রেমিকাকে এই দূরবিন উপহার দিয়েছিল। সেই তরুণী এই যন্ত্রটি যেই-না চোখে লাগিয়ে অ্যাডজাস্ট করেছে, অমনি দুটো পেরেক ওই যন্ত্র থেকে তার দু’-চোখে তীব্র বেগে ঢুকে গেল। অ্যান্ড শি ওয়াজ ব্লাইন্ডেড।” কেন এমন দূরবিন সেই জঘন্য অপরাধী তার প্রেমিকাকে উপহার দিয়েছিল?
সে কোর্টে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বলেছিল, ‘আই ডিড নট ওয়ান্ট হার টু লুক অ্যাট অ্যানাদার ম্যান এভার এগেন।’ ডায়না শিউরে ওঠে দু’-হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢাকলেন। এইভাবে ‘ডার্ক টু্যরিজম’-এর এক মোক্ষম ঝলক দিয়ে, জেফ্রি আর্চার শুরু করছেন তাঁর বেস্টসেলার উপন্যাস ‘নেক্সট ইন লাইন’। ‘ডার্ক টু্যরিজম’, যার অর্থ, ‘ভয়াবহ পর্যটন’– এই শব্দবন্ধটি ইংরেজি ভাষায় প্রথম দেখা দেয় ১৯৯৬ সালে। ত্রাস উদ্রেককারী পর্যটন, বিপজ্জনক টু্যরিজমের ভাবনাটি প্রথম নিয়ে এলেন দুই বন্ধু, লেনন এবং ফোলে, যাঁরা একসঙ্গে কাজ করতেন গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন বিভাগে। তাঁদের মনে হয়েছিল, পর্যটনের সঙ্গে বিপদ, ভয়, বিচিত্র আশঙ্কা, মানুষের পীড়ন, অত্যাচারের গল্প, এমনকী পর্যটকদেরও মৃত্যুর সম্ভাবনা– এসব টেনশন মেশাতে পারলে পর্যটনের বাণিজ্যিক টান বাড়বে। এই ধরনের ভয়ার্ত, মৃত্যুময় পর্যটনের তাঁরা নাম দিলেন ‘ডার্ক ট্যুরিজম’। এবং সত্যিই তৈরি হল ভ্রমণের নতুন শৈলী, বেড়ানোর নতুন বাজার।
কেউ যাচ্ছে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, যেখানে হাজার-হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল, তো কেউ যাচ্ছে হিরোসিমা-নাগাসাকি-তে, অ্যাটমবোমার ধ্বংসলীলা ‘উপভোগ’ করে শিউরে উঠতে। ডার্ক টু্যরিজম প্রাকৃতিক তাণ্ডবের চিহ্নগুলির আবেদনকে নানাভাবে সাজিয়ে আকর্ষণীয় করে বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করছে। এমনকী, জাগ্রত আগ্নেয়গিরিকে খুব কাছ থেকে দেখানো বা মাউন্ট এভারেস্টের খুব কাছে নিয়ে যাওয়ার বিপজ্জনক ফ্লাইটও আধুনিক ডার্ক ট্যুরিজমের অঙ্গ। ভয়ংকর খাদের ধারে ঝুলন্ত বাড়িতে একরাত কাটানো, বা পাহাড়ের উপর বরফের ঝড়ের মধ্যে কাচের ঘরে রাত কাটানোর আহ্বান, এমন বিপর্যয়ের রোমাঞ্চ ও নেশা টানছে অনেককেই।
সম্প্রতি, ‘ডানা’ সাইক্লোনের ভয়ংকর অবতরণ দেখতে বহু বাঙালি তো প্রাণ হাতে ছুটে গেল সমস্ত নিষেধ অগ্রাহ্য করে, পুরী এবং দিঘার তোলপাড় সৈকতে! কীসের টানে? অবশ্যই বিশুদ্ধ বিপর্যয় এবং কসমিক তাণ্ডবের ডাকে। যে-ডাক এবং ভয়ংকরের আহ্বান শুনিয়েছেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতিনাট্য ‘নটরাজ’-এর গানে– ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে’। ভৈরবের রোম্যান্টিক আকর্ষণই যেন ফিরে এসেছে এ-যুগের ডার্ক ট্যুরিজমের সংকটজনক বিপদগর্ভ আকর্ষে!