উত্তর ভারত ও মধ্য ভারত জুড়ে বিজেপি অথবা বিজেপির জোট সরকার যেখানে-যেখানে আছে, সেখানেই চলছে ‘বুলডোজার রাজ’, যা কিনা ‘উন্নয়ন’-এর পক্ষে সদর্থক পদক্ষেপ বলে প্রচার করা হচ্ছে ক্রমাগত। এই মেরুকরণের রাজনীতির শিকার কিন্তু আখেরে মানুষ। কলমে অর্ণব সাহা
১ আগস্ট উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার বাদল অধিবেশনে ক্যাবিনেট সদস্য সঞ্জয় নিষাদ বলেন, সরকারের ‘বুলডোজার নীতি’-ই সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটে বিজেপির খারাপ ফলের কারণ। পালটা জবাব দিতে উঠে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাঁর কাছে মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিছক চাকরি করা নয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও রাজ্যের মেয়েদের সম্মানরক্ষার প্রশ্নে তাঁর সরকারের ‘বুলডোজার রাজ’ চলবেই। কীরকম এই ‘বুলডোজার নীতি’?
১৯ জুন, উত্তরপ্রদেশ সরকার লখনউক্ষ্ণৌয়র আকবরনগরে এক ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযান চালায়। মোট ১,৮০০ পাকা বাড়ি-দোকানঘর ভাঙা পড়ে, যার মধ্যে ১,১৬৯টি বসতবাড়ি ও ১০১টি দোকানঘর কাঠামো। যোগী আদিত্যনাথের সরকার এই এলাকাটিকে ‘কুকরেল রিভারফ্রন্ট’ নামের এক উন্নত ‘ইকো-ট্যুরিজম হাব’-এ রূপান্তরিত করতে চায়। এলাকায় এমন বহু মানুষের ঘরবাড়ি রয়েছে, যারা এখানে দশকের-পর-দশক ধরে বসবাস করছে। এমনকী, এখনকার ‘ডেভেলপমেন্ট অথোরিটি’ যখন গড়েও ওঠেনি, তখন থেকে এই চত্বরে বসবাস করছে এমন এক ব্যক্তি সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়েছে, আপনারাই বলুন, কোনটা বেশি জরুরি, রিভারফ্রন্ট না কি গরিব মানুষের বাসস্থান?
সরকার দাবি করছে, যাদের বাড়ি ভাঙা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই বেআইনি দখলদার। যারা আইন-বহির্ভূতভাবে নদীর তীরবর্তী অঞ্চল দখলে রেখেছে, তারা হয় জমি-মাফিয়া নয়তো বাংলাদেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। উত্তর ভারত ও মধ্য ভারত জুড়ে বিজেপি অথবা বিজেপির জোট সরকার যেখানে-যেখানে আছে, সেই উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র এমনকী কংগ্রেস-শাসিত কর্নাটকেও লাগাতার চলছে এই ‘বুলডোজার রাজ’, যাকে ‘উন্নয়ন’-এর পক্ষে এক সদর্থক পদক্ষেপ বলেই প্রচার করা হচ্ছে ক্রমাগত। এর আগে ৬ মে, মহারাষ্ট্রের পোয়াইয়ের ‘বৃহন্মুবাই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন’ ৬০০-র উপর বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে জয় ভিম নগরের দলিত বস্তি এলাকায়। উচ্ছেদ হয় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ। এদের ঠাঁই এখন শহরের ফুটপাতে।
[আরও পড়ুন: ভারত কেন ‘চোখের বালি’]
অথবা, ধরা যাক, দিল্লির বাসিন্দা সুশীলের কথা (নাম পরিবর্তিত)। বয়স ৪৪। তাদের পরিবার প্রথমে থাকত মনসা-রোভার পার্ক এলাকায়। সরকার ফ্লাইওভার তৈরি করলে তারা প্রথমবার উচ্ছেদ হয়। ফের উচ্ছেদ ২০১১ সালে। এবার আন্ডারপাস বানানোর কারণ দেখিয়ে তাদের তুলে দেওয়া হয়। আর ২০২২ সালে একটি সরকারি পার্ক গড়ে তোলা হবে বলে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ৩২টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে আবার। এবার বলা হয়েছে– তারা নাকি ‘জবরদখলকারী’, তাদের বৈধ অনুমতিপত্র নেই বসবাসের। ২০২৪ সালের ‘হাউজিং অ্যান্ড ল্যান্ড রাইটস নেটওয়ার্ক’-এর (HLRN) রিপোর্ট অনুসারে: আঞ্চলিক, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে কেবল ২০২২-’২৩ সালেই দেশের গ্রামীণ ও শহুরে এলাকায় মোট ১,৫৩,৮২০টি বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদ হয়েছে ৭,৩৮,৪৩৮ জন বাসিন্দা। ২০১৭-’২৩ সালের মধ্যে এই প্রবণতা ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী এবং এই সাত বছরে উচ্ছেদ-অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মোট সংখ্যা ১০ লক্ষ ৬৮ হাজার।
উচ্ছেদ-সংক্রান্ত সরকারি বা কর্তৃপক্ষের বয়ানেও একটা স্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে বিগত দেড়, দুদশকে। শিল্পায়ন বা নগরায়নের কারণে উচ্ছেদের জায়গায় এখন অনেক বেশি বলা হচ্ছে নগর-সৌন্দর্যায়নের উদ্দেশ্যে জবরদখল-মুক্তি অভিযান। বারংবার ‘স্যানিটাইজেশন’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এই ‘দূষণ মুক্তি’-র ‘লক্ষ্য’ সবচেয়ে গরিব, পিছিয়ে থাকা মানুষজন, যাদের একটা বড় অংশই সংখ্যালঘু অথবা দলিত। মধ্যপ্রদেশের জিরাপুর, উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ, সাহারানপুর, হরিয়ানার নুহ্, দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরি সর্বত্রই প্রধান টার্গেট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়– দিল্লির উক্ত জায়গাটির কথা। বছর দুয়েক আগে হনুমান-জয়ন্তীর মিছিল নিয়ে সংঘর্ষ হওয়ার পরে উত্তর দিল্লি মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের কর্তা-ব্যক্তিরা ১২ কোম্পানি সিআরপিএফ জওয়ান-সহ এলাকায় আসেন এবং ২৫টি দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি দোকানের মালিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। একই ঘটনা ঘটেছে মধ্যপ্রদেশের খারগোঁ-তে। সেখানে, এমনকী, এমন সংখ্যালঘুর বাড়িও ভেঙে দেওয়া হয়েছে, যেটি ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’র টাকায় বানানো হয়েছিল। খোদ রাজধানী বাদে এরকম ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোয়, যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই বিভিন্নভাবে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দেওয়া হচ্ছে সরকারি পেশিশক্তি ব্যবহার করে। সর্বত্রই এই বয়ান জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যে, সংখ্যালঘু মাত্রেই ভারতে অনুপ্রবেশকারী ও বহিরাগত। অর্থাৎ, এসব উচ্ছেদের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক অভিসন্ধি, যা রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করছে নাগরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি অথবা উন্নয়নের একমাত্রিক ‘মডেল’-কে সামনে রেখে।
এক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলা প্রয়োজন তা হল, ভারত অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় উন্নয়নের ভয়াবহ বিষম চরিত্রের কারণে জনসমষ্টির একটা বিরাট অংশ, যারা অর্থনৈতিক অথবা সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ– নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে বহু ক্ষেত্রেই আধা-আইনি অথবা বেআইনি বাসস্থান, পেশা, জীবিকা ও জীবনের অন্যান্য পরিসরে জড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এই ছবি এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার প্রায় সমস্ত দেশেরই বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে এসব দেশে প্রত্যেক মুহূর্তে চলতে থাকে অন্তর্নিহিত সামাজিক সংঘাত, যা কখনও ধর্ম, কখনও জাতপাত, কখনও শ্রেণিবৈষম্যের আধারে টিকে থাকে। সেরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র যদি আরও উদার, সহিষ্ণু ও সহনশীল না-হয়, তাহলে জনসমাজের এক বড় অংশই এই মুক্ত, নয়া-উদার অর্থনীতির যুগে ‘অবাঞ্ছিত’ বা ‘বাড়তি বোঝা’ হিসাবে পরিগণিত হবে। এই ‘বাড়তি’ মানুষেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে অথবা বিরাগভাজন হয়েও নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই
‘আধা-আইনি বাসস্থান’, বা ‘বেআইনি জীবিকা’-র সঙ্গে সহবাস করতে বাধ্য হবে। এই সামাজিক বাস্তবতাকে মাথায় না-রাখলে এদের বেঁচে-থাকাকেই এককথায় ‘অবৈধ’ বলে দাগিয়ে দিতে হবে, যা অমানবিক নিষ্ঠুরতা।
[আরও পড়ুন: ‘কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া’]
গত দশ বছরে বারবার রাজ্য ও সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় এদের সম্পর্কে যে-রায় দিয়েছে, তা এদের সামাজিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলেছে। ফলে, আইনকে এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাশে পাচ্ছে না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মান্ধতা ও জাতিবিদ্বেষের রাজনীতি। সম্প্রতি, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর একাধিক রিপোর্টেও উঠে এসেছে কীভাবে উন্নয়নের ‘বুলডোজার নীতি’-র প্রয়োগ ঘটেছে গুজরাতে। একই মহল্লায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হাতও পড়েনি, অথচ সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ভাঙা পড়েছে। ‘এইচএলআরএন’-এর রিপোর্ট অনুসারে, বলপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনার ৪৪ শতাংশ ঘটেছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে। ২৩ শতাংশ আদিবাসী জনজাতির বিরুদ্ধে। ১৭ শতাংশ অন্যান্য অনগ্রসর বর্গ (ওবিসি) এবং ৫ শতাংশ তফশিলি জাতিভুক্তদের বিরুদ্ধে। সরকার নিজেই আইন-বহির্ভূত কাজ করছে। যোগী আদিত্যনাথের নাম-ই হয়ে গিয়েছে ‘বুলডোজার বাবা’। একইভাবে অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মার নাম হয়েছে ‘বুলডোজার মামা’।
আসলে, এই পুরো বয়ানই উত্তর-বিশ্বায়ন যুগে গড়ে ওঠা নয়া-উদারনৈতিক ‘উন্নয়ন’-এর ধারণার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চলেছে। আদিত্য নিগম তাঁর ‘ডিজায়ার নেমড ডেভেলপমেন্ট’ নামক বিখ্যাত বইয়ে এই ‘উন্নয়ন’-এর ধারণাকেই প্রশ্ন করেছেন। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন– গ্রাম থেকে শহর, কৃষি থেকে শিল্প, পরিকল্পনা-বহির্ভূত বসতি ভেঙে অতিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার আওতায় গড়ে ওঠা নগরব্যবস্থাই যে ‘উন্নয়ন’-এর একমাত্রিক মাপকাঠি, এটা কে ঠিক করে দিল? এবং এক্ষেত্রে আদিত্য নিগমের প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছেন বিশ্বের বহু নামজাদা জনকল্যাণ-অর্থনীতির সমর্থক বিশিষ্ট তাত্ত্বিকরাও।
যেমন, কেস স্টাডি হিসাবে আদিত্য বেছে নিয়েছেন বাংলায় বহু আলোচিত সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম মডেলটিকে, যাকে সেদিনের বামপন্থী সরকার ‘কৃষি থেকে শিল্প’-এ পৌঁছনোর অনিবার্য তাগিদ ও মডেল হিসাবে লাগাতার প্রচার চালিয়েছিল। প্রায় থ্রিলারধর্মী বইয়ের এই অধ্যায়টির নাম ‘এন্টার দ্য ন্যানো’। সিঙ্গুরে টাটার কারখানায় একলাখি মোটরগাড়ি প্রকল্পটিকে সেদিন ‘যুগান্তকারী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে, মাত্র ১ লাখ টাকায় মোটরগাড়ি চড়তে সক্ষম হবেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ। এটাকেই সেদিন নয়া উন্নয়নের ‘ডেমোক্রেসি আর্গুমেন্ট’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, যার শরিক ছিলেন প্রথিতযশা বহু কল্যাণকামী অর্থনীতিবিদ।
আদিত্য নিগম দেখাচ্ছেন, ‘উন্নয়ন’-এর এই পুরো মডেলটাই আসলে ইউরোপীয় জ্ঞান-যুক্তি-প্রগতি থেকে ধার করে গড়ে তোলা এমন এক কাঠামো, যা আসলে বিশ্বায়নের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে উদ্ভূত এক সংগঠিত নয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য মডেল। অথচ, এর ফলে মার খাচ্ছে, কাজ হারাচ্ছে, ছিটকে যাচ্ছে বৃহত্তর জনসমাজের এক বিরাট অংশ, যারা নিজেদের এই উন্নয়ন-যজ্ঞে শামিল করতেই পারবে না কোনও দিন। এবার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে গত দশকে দেশজুড়ে উন্নয়নের নামে যে উচ্ছেদ-যুদ্ধ চলছে– তার বিরুদ্ধে গুটিকতক মানবাধিকার সংস্থা ছাড়া বৃহত্তর মধ্যবিত্ত সমাজ কথা বলছে না কেন? কারণ, এই ‘বুলডোজার রাজ’ এই মুহূর্তে সমাজের এই বিশেষ সুবিধাভোগী অংশটির গায়ে হাত দিচ্ছে না।
সর্বশেষ খবর, এবারের প্যারিস অলিম্পিকে ভারতকে দুখানা ব্রোঞ্জ এনে দেওয়া কোচ সামশের জং টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি দেশে ফিরে এসেছেন। কারণ, দিল্লিতে তিনি যে-কলোনিতে থাকেন, সেই পুরো কলোনিটাই বুলডোজারের সামনে উচ্ছেদ করা হবে– এই মর্মে নোটিস এসেছে
তাঁর বাড়িতে। এটাই বোধহয় দেশসেবার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার!