‘ইনক্রিমেন্টাল লোন-টু-ডিপোজিট রেশিও’ সংক্ষেপে ‘এলডিআর’ এমনই এক আর্থিক হাতিয়ার, যা ব্যাঙ্ক তাদের আর্থিক স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন করতে ব্যবহার করে। এই রেটের বাড়া-কমা– সে তথ্য কি খতিয়ে দেখা উচিত? কেন-ই বা এতে উত্তেজিত, বা উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক? লিখছেন নীলাঞ্জন দে।

সামান্য এক কি দেড় লাইনের খবর। তবে অন্তর্নিহিত অর্থ বিরাট। শিরোনাম অনুযায়ী– ব্যাঙ্কিং সেক্টরের বাড়তি বা ‘ইনক্রিমেন্টাল লোন-টু-ডিপোজিট রেশিও’ (সংক্ষেপে ‘এলডিআর’) গত ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে প্রায় ১২৫ শতাংশে পৌঁছেছিল। এই চলতি অর্থবর্ষে ‘এলডিআর’-এর পরিমাণ ১০০ শতাংশর বেশি। কেন এই তথ্য ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত? কেন-ই বা এতে উত্তেজিত বা উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক?
গাড়ির চাকা গড়ানোর আগে ব্যাঙ্কিং সেক্টরের প্রেক্ষাপট দেখে নিই চট করে। সাদা বাংলায়, আমাদের দেশের ব্যাঙ্কিং সংস্থাগুলি এখন যে ‘লোন’ দিচ্ছে, তার সামগ্রিক পরিমাণ ডিপোজিটের বাড়তি মোবিলাইজেশনের তুলনায় বেশি। দ্রুত মোট ডিপোজিট বেস বাড়ানোর দিকে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে মন দিতে হবে। ব্যাঙ্কের প্রধান কাজ– ক্রেডিট বা ধার দেওয়া, তাহলে সেটি সুচারুভাবে করা যাবে ভবিষ্যতে।
বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝাতে ছোট একটি অঙ্ক কষা যাক। মনে করুন, গড়পড়তা ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে ‘এলডিআর’ এখন ১০০ শতাংশ। তার মানে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কটি লোন দিচ্ছে ১০০ টাকা, নতুন ডিপোজিটও তোলা হচ্ছে সমপরিমাণ সেই ১০০ টাকার। এবার সাধারণ বুদ্ধি বলছে, ‘এলডিআর’ যদি মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে, তাহলে কর্তৃপক্ষ বিলক্ষণ অসুবিধায় পড়বেন। ইতিমধে্যই এই নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা হচ্ছে, বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে। সাধারণ ব্যাঙ্কের গ্রাহক হয়তো এই জাতীয় প্রসঙ্গে অাগ্রহী নয়, তবে জেনে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। গ্রাহকের উদ্দেশে বলি, ক্রেডিট ফরমেশন, অর্থাৎ লোন দেওয়া, যে কোনও ব্যাঙ্কের প্রাথমিক কর্তবে্যর মধে্য পড়ে। ‘ক্রেডিট গ্রোথ’ এবং ‘ডিপোজিট গ্রোথ’, দুই-ই ব্যাঙ্কারদের জন্য জরুরি। কিন্তু বর্তমানে ব্যাঙ্কের আমানতে কিছুটা টানাটানি লক্ষ করা যাচ্ছে– তাই বেশিরভাগ ব্যাঙ্কের জন্য ডিপোজিট গ্রোথ নিশ্চিত করতে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।
প্রশ্ন হল, কীভাবে ডিপোজিট গ্রোথ সুনিশ্চিত করা যেতে পারে! কোনও কর্তৃপক্ষর হাতেই জাদুদণ্ড নেই, তবে তুলনায় স্বল্প খরচে আমানতকারীর কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা সবাই করছে। বিশেষ করে সেভিংস অ্যাকাউন্ট এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্ট– ব্যাঙ্কিং পরিষেবার একেবারে কেন্দ্রস্থলে এই দুই বাড়ানোর প্রয়াস সর্বদাই জারি আছে। এর সঙ্গে ব্যাঙ্কের অন্য কর্তব্যও রয়েছে: আমানতের পরিমাণ, পোশাকি ভাষায় ‘ডিপোজিট বুক’, যথাসম্ভব স্ফীত করা।
আমানতে যদি টান পড়ে, লোন দেবে কী করে ব্যাঙ্ক? আগামী দিনে এই প্রশ্ন খুব বড় আকার ধারণ করতে চলেছে বলে আমার বিশ্বাস। প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে– যখন আমরা দেখতে পাই যে, কারেন্ট এবং সেভিংস অ্যাকাউন্টের ইন্টারেস্ট রেট আর সাধারণভাবে গ্রাহকের মন জয় করতে পারছে না। এই কম্পিটিশনের যুগে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা উচ্চহারে রিটার্ন পাওয়া। ভ্যালু-অ্যাডেড পরিষেবার তাই বেশি চাহিদা, মানুষ এখন বেশি সুদ-যুক্ত ডিপোজিটের দিকে ঝুঁকছে। অর্থাৎ, ব্যাঙ্ককে উচ্চ হারে ইন্টারেস্ট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, নাহলে আমানতকারী কেন-ই আর ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা জমা করবে? এই সওয়ালের তাৎক্ষণিক জবাব পাওয়া দুষ্কর।
পাবলিক সেক্টর অথবা প্রাইভেট– সব শ্রেণির ব্যাঙ্কের জন্য এমন চ্যালেঞ্জ বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুয়োর গ্লোবাল রেটিংস’ (এস অ্যান্ড পি)। তারা পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছে যে, ভারতে ক্রেডিটের চাহিদা মোটেও খারাপ নয়, আর তা অর্থনীতির অগ্রসরের পক্ষে বড় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। ‘অ্যাসেট কোয়ালিটি’– অর্থাৎ লোনের মান, হয়তো আগামী দিনে আরও উন্নত হবে। অন্তত আংশিকভাবে, এমনই মত ‘এস অ্যান্ড পি’-র।
সমস্যা সেখানে নয়, মুশকিল হল সেই আমানত নিয়ে। আমানত গঠনের দিকে তাই বিশেষভাবে নজর দিতেই হবে ব্যাঙ্কগুলিকে। অতএব ভবিষ্যতে ব্যাঙ্কিং নীতি-নির্ধারকদের আমানতের বিষয়ে সজাগ থাকতেই হবে। কারণ, ‘এলডিআর’-এর উপর নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের রিস্ক। গ্রাহকদের স্বার্থেই এই ধরনের রিস্ক কমিয়ে এনে সুষ্ঠুভাবে কার্যপ্রণালী চালাতে হবে আমাদের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে।
খবরে প্রকাশ, ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রক ইতিমধে্যই নানা সংস্থাকে ডিপোজিট বেস প্রসারিত করার বিষয়ে সতর্ক করেছে, এর উপর জোর দিতে বলেছে। এছাড়াও ক্রেডিট সংক্রান্ত নিয়মও বদলে লেন্ডিং বাড়ানোর কথা ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে। গত কয়েক দিনের খবর দেখুন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রায়োরিটি সেক্টর সম্বন্ধীয় নীতি পরিবর্তন করেছে। লক্ষ্য একটাই– বিশেষ কয়েকটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রেডিট ফ্লো নিশ্চিত করা। জনসাধারণের জন্য হোম লোন থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রির জন্য রিনিউয়েব্ল এনার্জি লোন, একাধিক সুবিধা এই পরিবর্তিত নীতির আওতায় আসছে। তবে ভারতীয় অর্থনীতি কত দ্রুত নতুন ক্রেডিট গ্রহণ করতে পারবে, কার্যকরী করতে পারবে, তার উপর বহু কিছু নির্ভর করবে। যতক্ষণ না ভারী শিল্পের জন্য ক্রেডিট ফ্লো বাড়ে, ততক্ষণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার অবকাশ কারও নেই। ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির সম্প্রসারণ জোরকদমে না হলে এই মুহূর্তে সেই সম্ভাবনা দেখছে না কোনও মহলই।
তবে বিশেষ কয়েকটি রাস্তা খুলছে, এ-ও বেশ বোঝা যাচ্ছে। ‘গ্রিন শুট্স’ দেখা যাচ্ছে এনার্জি সেক্টরে, দৃষ্টান্ত হিসাবে যে-নামটি প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে। বাস্তবিকই, ‘রিনিউয়েব্ল এনার্জি’ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ বাড়ছে, ভারতেও তার ব্যতিক্রম নেই। আগামী দিনে এই সেক্টরে বড় মাপের ক্রেডিট ফ্লো আসার বিষয়ে অনেকেই বেশ আশাবাদী। একইভাবে এই কথা প্রযোজ্য ইলেকট্রনিক্স, অটো অ্যানসিলিয়ারি এবং ফার্মাসিউটিকাল জাতীয় সেগমেন্টের ক্ষেত্রে।
তবে এতদ্সত্ত্বেও, বাজারে উপস্থিত একাংশের অভিমত, ‘ডিপোজিটে টান পড়েছে’ বলে খুব বেশি শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। একথা ঠিক কিছু সংখ্যক হলেও নতুন ডিপোজিটার ব্যাঙ্কের চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকছে না, তবে এই ট্রেন্ড ক্ষণস্থায়ী। তবে বিকল্প ভাবনাচিন্তাও করতে হবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে। যেমন, আমানতের হার হয়তো বাড়াতে হতে পারে। সেখানে অবশ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিজের নীতিই অন্তরায় হয়ে দঁাড়াবে। উল্লেখ্য, এই মুহূর্তে দেশে ‘রেপো রেট’ কমানোর বাতাবরণ জারি আছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেও ‘রেপো রেট’ কমিয়েছিল ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রক, আবার এপ্রিল মাসে গোড়ার দিকে এই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা। রেপো রেট একটি পলিসি রেট বলে গণ্য, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বড় হাতিয়ার তো বটেই। এই রেট কমিয়ে অর্থনীতিতে ‘মানি সাপ্লাই’ বাড়ানোর প্রচেষ্টা করে সরকার। কম রেপো রেটের অর্থ, বিভিন্ন ব্যবসার জন্য ধার নেওয়া সহজ হবে, ঋণ নিয়ে সম্প্রসারণ করতে পারবে তারা। বরোয়িংয়ের ভিত্তিতে খরচ করার ক্ষমতাও বাড়বে, সঙ্গে সাথ দিতে পারে বিনিয়োগ। ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে বেশি বিনিয়োগ এলে কাজের পরিসর বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে। সমগ্র অর্থনীতির পক্ষে তা ইতিবাচক হতে বাধ্য।
শেষ করার আগে বলে রাখি– জিয়নকাঠিটি সেই ‘এলডিআর’, মানে সাবেক ‘লোন-টু-ডিপোজিট রেশিও’। ভবিষ্যতের ভারতে, নতুন প্রজন্মের হাতে বিকল্পের অভাব থাকবে না, এমন আশা করাই যেতে পারে। একমাত্রিক, কম সুদের আমানতের গণ্ডির ভিতর তারা নিজেদের আর আটকে রাখবে না। আগের প্রজন্ম যা করে এসেছে পরম নিশ্চিন্তে, এ যুগের অল্পবয়সিরা তা করবে না। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে, বিকল্পে আস্থা রাখাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। তাই ব্যাঙ্কের সামনে চ্যালেঞ্জ আরও কড়া ধঁাচের হতে চলেছে– চটজলদি সুরাহা পাওয়া মুশকিল। তবে গ্রাহক নতুনই হন অথবা পুরনো– সব বয়সিদের জন্য প্রযোজ্য, সবার মনের কথা সেই ছোটবেলায় পড়া আপ্তবাক্য– ‘Life is like a bank account, you cannot take out more than you put in!’
(মতামত নিজস্ব)