চারুবাক: গত দু’তিনটি ছবি থেকেই পরিচালক রাজ চক্রবর্তী সাম্প্রতিক ঘটনা ও বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছেন। বাস্তবতার দিকে নজর দিচ্ছেন বেশি। জনপ্রিয় মশালা এবং ফর্মুলা সযত্নে এড়িয়ে তাঁর চিত্রনাট্যে নিয়ে আসছেন আজকের সমস্যা। রাজ চক্রবর্তীর এই নব পরিচিতি নিশ্চয়ই আগের মতো জনপ্রিয়তা না দিলেও, তিনি কিন্তু নিজের জায়গাতেই এখনও স্থির রয়েছেন। এটা ভাবতে খুবই ভাল লাগছে।
রাজ চক্রবর্তীর নতুন ছবি “ধর্মযুদ্ধ” (Dharmajuddha Review)। নামকরণ থেকেই দর্শক বুঝতে পারবেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই ছবির বিষয়। আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে জুড়ে থাকবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, এটা প্রায় স্বতসিদ্ধ। রাজ ও পদ্মনাভর চিত্রনাট্য মাত্র একটি রাতের দাঙ্গার মধ্যে সীমাবদ্ধ। হ্যাঁ, ফ্ল্যাশব্যাকে শুভশ্রী ও পার্নোর প্রেমপর্বকে গানসহ আনা হয়েছে। এসেছে ঋত্বিকের প্রায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী হওয়ার দীর্ঘ পশ্চাতপট, সন্ধ্যায় মসজিদের আজান ধ্বনি আর তুলসী তলায় শাঁখ বাজানো নিয়ে দুই ধর্মের মানুষের যুযুধান হয়ে ওঠার পর্বটি বেশ সুসংগঠিত। অথচ, মুসলিম বৃদ্ধা স্বাতীলেখার বাড়িতে দাঙ্গার সন্ধ্যায় একে একে পার্নো, শুভশ্রী, সোহম এবং ঋত্বিকের প্রবেশ নাটকীয় ও কাকতালীয় লাগে। যদিও বৃদ্ধা নিজেই ওদের ডেকে এনে আশ্রয় দিয়েছেন এবং দাঙ্গা নয়, ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা ও ধর্মে আঘাত না করে সম্প্রীতির পরিমণ্ডলে বাস করাটাই আদর্শ হওয়া উচিত। ছবির শেষে এই শিক্ষাই রাজ চক্রবর্তী রেখেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন কিছু থেকেই যায়, যেমন প্রসব বেদনা ওঠা শুভশ্রীকে স্বামী রাস্তায় মারমুখী দাঙ্গাবাজদের দেখে সরিয়ে দেবার পর বিধ্বস্ত শুভশ্রীর তো শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হওয়া উচিত, এমনকী, চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে যে অমন পরিস্থিতিতে মিসক্যারেজ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবর্তে দেখলাম পার্নোর সঙ্গে রীতিমতো ধস্তাধস্তি করতে। সেটা কিভাবে সম্ভব! এগুলো একটু নজর দেওয়া উচিত ছিল।
[আরও পড়ুন: অভিনয়ের জোরে কি ‘ডার্লিংস’ হয়ে উঠতে পারলেন আলিয়া ভাট? পড়ুন রিভিউ]
কিম্বা ছবির শেষটা একটু বেশি নাটকীয় এবং আরোপিত লেগেছে! সাম্প্রদায়িক দলাদলি ও সম্প্রীতি নিয়ে বৃদ্ধার সংলাপও বেশ সাজানো গোছানো লাগে! আসলে রাজের ইচ্ছে এবং সাধকে সন্মান জানিয়েই বলছি, বক্তব্যকে দর্শকের কাছে আন্তরিক ও গ্রহণীয় করতে গেলে সিনেমা ভাষার যে দখলদারি প্রয়োজন, সেটার অভাব রয়েছে, অবশ্যই আন্তরিকতায় অভাব নেই! এটাই এই ছবির বড় প্রাপ্তি, ঠিক যেমনটি পেয়েছিলাম “হাবজি গাবজি” তেও। “হর হর মহাদেব” এবং “নারায়ে তাকবীর” স্লোগানের ব্যবহার, মায়ের কোনও জাত হয় না, সত্যনারায়ণের সিন্নি ও ইদের সিমাই বা মানুষ মানুষে মারামারি কাটাকাটি করেই চললে মন্দির মসজিদে পুজো করবে কে? বা ইবাদতই বা কে করবে? এ ধরনের সংলাপ নিশ্চয়ই শুনতে ভাল লাগে!
এইসব অল্প ত্রুটি এড়িয়ে যেতে পারলে “ধর্মযুদ্ধ” নিশ্চিত ভাবেই সাম্প্রতিক পটভূমিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি, সিনেমা বলতে পারলে আরও ভালই লাগত। রাজ কিন্তু সিনেমার ভাষাটা রপ্ত করেছেন, সেটাকে সঠিক চিত্রনাট্যে সুচারু ব্যবহার নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা দরকার। সৌমিক হালদারের ক্যামেরার কাজ আর্থিক টানাটানির মধ্যেও বুঝিয়ে দেয় তাঁর হাতের নৈপুণ্য! ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের আবহ নাটকের জায়গাগুলো হাইলাইটেড হয়েছে। “তুমি যদি চাও নিজেকে হারাই….” গানটি বেশ লাগে শুনতে!
এবার অভিনয়ের কথায় আসা যাক। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র মুসলিম বৃদ্ধার চরিত্রে প্রয়াত স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অবশ্যই সবার আগে থাকবেন তাঁর অভিনয় নিয়েও। বাণী দেওয়ার মতো সংলাপগুলো তিনি কি অনায়াসে উচ্চারণ করে গিয়েছেন। শুভশ্রীর চিত্রনাট্যে আরও একটু বেশি জায়গা পাওয়া উচিত ছিল, যেটুকু পেয়েছেন তাতেই তিনি লেটার মার্কস পাবেন। পার্নো কিন্তু মাঝে মাঝেই বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠেছেন চিত্রনাট্যের দাবি পূরণ করতে। জব্বরের চরিত্রে সোহম এবং রাঘবের ভূমিকায় ঋত্বিক দুজনেই পাল্লা দিয়ে দর্শকদের নজর কাড়বেন। কেমিও চরিত্রে রুদ্রপ্রসাদ তাঁর জাত চিনিয়ে দেন শুধু চোখ দিয়েই। রাজ চক্রবর্তীকে ধন্যবাদ, তিনি বাজারে চলতি বিষয়ের বাইরে গিয়ে অন্যরকম কিছু একটা ভেবেছেন এটাই সবচেয়ে বড় পাওনা।