বিশ্বদীপ দে: বহুদিন আগেই রমাপদ চৌধুরী প্রশ্নটা তুলে দিয়েছিলেন, ‘ভূতগুলো সব গেল কোথায়?’ আজকের বাঙালির কাছে অবশ্য সেই অর্থে ভূতের অভাব নেই। হাতের ফোনে থাকা ওটিটিতে হলিউড তো বটেই, কোরিয়ান কিংবা ইন্দোনেশিয়া... বলতে গেলে সারা পৃথিবীর ভূতকেই চাইলে পাওয়া যায়। কিন্তু বঙ্গদেশের আদি অকৃত্রিম ভূতেরা? অষ্টাদশ শতাব্দী কিংবা আরও আগের সময়ে যখন ইলেকট্রিসিটির বালাই ছিল না, তখন এই বঙ্গদেশের মাটিতেও ভূতের দৌরাত্ম্য ছিল বইকি। ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসের শুরুর দিকে ত্রৈলোক্যনাথের বর্ণনায় পাই, ”সন্ধ্যা হইলে, ঘরে বসিয়া, লোকে নানারূপ ভূতের গল্প করে, সেই গল্প শুনিয়ে বালক-বালিকার শরীর শিহরিয়া ওঠে।” আরও আগে, সেই কবে লেখা ‘চৈতন্য চরিতামৃত’তে ভূতের উল্লেখ মেলে। হরিদাস নামের এক চৈতন্য ভক্তকে মৃত্যুর পরেও গান গেয়ে শোনাতে দেখা যেত। চণ্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে অন্নপূর্ণামঙ্গল- ভূত কোথায় নেই? বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজ 'আধুনিক বাংলা হোটেল' যেন সেই পরম্পরারই প্রতিফলন ঘটিয়েছে। তিনটি পর্বে তিনটি গল্পের এই ওয়েব সিরিজের দুটি গল্পই একেবারে গ্রামবাংলার শ্যামল প্রকৃতিকে পটভূমি হিসেবে গড়ে তুলেছে। এর আগে 'পেটকাটা ষ'ও চমকে দিয়েছিল। এখানেও ভয় পুরোমাত্রায় উপস্থিত। এবং তা নিখাদ খাঁটি দিশি ভয়! একান্তই এই জলহাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা রিনরিনে আতঙ্ক।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’ হ্যালোউইন উপলক্ষে এই ওয়েব সিরিজ রিলিজ করেছে। প্রতি সপ্তাহে একটি করে গল্প। যার শেষ গল্পটি মুক্তি পেয়েছে এই সপ্তাহে। প্রথম গল্পটির নাম 'বোয়াল মাছের ঝোল', দ্বিতীয় গল্প 'খাসির পায়া', তৃতীয় গল্প 'হাঁসের সালুন'। ভূত এবং কোনও না কোনও খাবারের নামে গল্পের নাম, এছাড়া আরও একটি মিল রয়েছে ওয়েব সিরিজটির সব গল্পের মধ্যে। সেটি হল মুশারফ করিমের উপস্থিতি। শক্তিশালী এই অভিনেতা এপার বাংলাতেও প্রবল জনপ্রিয়। তিনটি গল্পেরই প্রধান চরিত্র তিনি। তবে তিনটি চরিত্রই পরস্পরের থেকে যোজন দূরে অবস্থিত। তাঁর অভিনয় এই অ্যান্থোলজি সিরিজের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
না, একটু ভুল হল বোধহয়। এই সিরিজের সবচেয়ে বড় সম্পদ এর গল্প। শরিফুল হাসানের লেখা তিনটি গল্প থেকে তৈরি হয়েছে গল্পগুলি। অভিনব কাহানিই কেবল নয়, পরিচালক কাজি আসাদের সযত্ন রন্ধন কৌশল একে পরম সুস্বাদু করে তুলেছে। সবচেয়ে আনন্দের যেটা, তা হল লোকায়ত উপাদানের নিবিড় বুনন। একথা ঠিকই প্রথম গল্প অর্থাৎ 'বোয়াল মাছের ঝোল' গল্পের ভয়ের উৎসের সঙ্গে মার্কিন সাহিত্যিক স্টিফেন কিংয়ের 'পেট সিমেট্রি'র সাদৃশ্য মনে পড়বেই। তবুও শেষপর্যন্ত তা দেশীয় গণ্ডির ভিতরেই চরম ভয়ংকর চেহারা ধারণ করেছে। আর তার ইঙ্গিত মেলে একেবারে শুরুতেই বাসের এক অচিন পথিকের মুখে- ‘মাটির মানুষ মাটি খাবে/ মাটির কাছে ফিরতে হলে শিখর ভুলে শেকড় ভোজো।’ শেকড়ের কাছে ফেরার এই আকুতিই আসলে গল্পগুলির শরীর নির্মাণ করেছে। তাই 'আধুনিক বাংলা হোটেল'-এর অতিলৌকিকতাও অনায়াসে 'বাস্তব' হয়ে যেতে থাকে। 'সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ'কে সঙ্গে নিয়েই।
এই সিরিজের অন্যতম প্রধান শক্তি এর ক্যামেরার কাজ। 'বোয়াল মাছের ঝোল'-এর একেবারে শুরুর দিকে দিগন্তবিস্তৃত মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাঁকড়াচুলো এক অতিকায় গাছের লং শট দর্শকের মনে শিরশিরে অনুভবের জন্ম দিতে থাকে। কিছুই ঘটেনি তখনও, তবুও ভাবী অমঙ্গলের ছায়া যেন সর্বত্র পড়ে রয়েছে অস্তগামী সূর্যের লালচে নরম আলোর সঙ্গে গা মিলিয়ে। পরে আকাশে পূর্ণচন্দ্রকে সাক্ষী রেখে দুটি মানুষের নদীর পাড়ে বসে থাকার দৃশ্যটিও অসামান্য। আবার 'খাসির পায়া'তে ক্লোজ শটে ভয়ের জলছাপ ফুটে ওঠে। মুশারফ করিমের মুখের উপরে ধরে থাকা ক্যামেরা। তিনি স্রেফ অভিব্যক্তি দেখিয়েই দর্শককে রোমাঞ্চের মুখোমুখি করে ফেলেন। আবার 'হাঁসের সালুন'-এ পর পর মেলে রাখা রঙিন কাপড়ের সারি এক অদ্ভুত মোহ তৈরি করতে থাকে।
আর এহেন সিনেমাটোগ্রাফিকে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে গিয়েছেন মোশারফ করিম। প্রথম গল্পে তিনি এক গ্রামের সাধারণ মানুষ। যিনি নিজের ইউনিভার্সিটির মাস্টারমশাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নিজের বোয়ালিয়া গ্রামে। যে গ্রামে দৈনিক ঘণ্টা দুয়েকের বেশি বিদ্যুৎ থাকে না। এহেন এক অজ পাড়া গাঁয়ের মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন মুশারফ। তবে একেবারে শেষে তাঁর অভিনয় একবার দেখলে বোঝা কঠিন। চরিত্রটিকে কতটা আত্মস্থ করেছেন তিনি, ভাবলে অবাক হতে হয়। আবার দ্বিতীয় গল্প 'খাসির পায়া'তে এই মানুষটিই চশমা পরিহিত এক কেরানি। পদে পদে যার ভয়। কালো বিড়াল থেকে বাজ পড়ার শব্দ, তাঁর মনের ভিতরে বিনবিনে ভয়ের কুয়াশা তৈরি করে। অথচ 'হাঁসের সালুন' গল্পে তিনিই খল চরিত্রে। প্রথম দৃশ্য থেকেই এখানে মোশারফ এক নিষ্ঠুর খুনি। মাথায় লম্বা চুলের উইগই শুধু নয়, গোটা চরিত্রটিকেই অনায়াসে ধারণ করে রেখেছেন খ্যাতিমান অভিনেতা। তবে কেবলই তিনি নন, এখানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে থাকা প্রত্যেকেই ভীষণ ভালো। বিশেষ করে 'বোয়াল মাছের ঝোল'-এর প্রাক্তন অধ্যাপকের চরিত্রে গাজি রাকায়েত। পাশাপাশি নিদ্রা নেহা, শিল্পী সরকার অপুর মতো আরও অনেকেই নিজেদের ভূমিকায় এমন নিখুঁত যে মানতেই হবে পরিচালক সকলকে সঙ্গে করে নিয়েই এগোতে চেয়েছেন। কেবল মুশারফ করিমের স্টারডমকে 'মূলধন' করতে চাননি।
তবে এর পরও দু-একটা কথা বলাই যায়। 'খাসির পায়া'তে কালো বিড়াল কিংবা বার বার বিদ্যুতের চমকানির মতো বহু ব্যবহৃত ক্লিশে উপাদানগুলিতে এড়ানোই যেত। তাতে ভয় কিছু কম হত বলে মনে হয় না। তিনটি গল্পের মধ্যে এই গল্পটিতেই 'আনপ্রেডিক্টিবিলিটি' অনেক কম (তবে সেটাই সবসময় শর্ত কিনা তা অবশ্য অন্য বিষয়)। কিন্তু প্রথম গল্পে ভয় যেভাবে আসে কিংবা তৃতীয় গল্পের ক্লাইম্যাক্সের শিরশিরানি তা নিয়ে কিছুই বলার থাকে না। সব মিলিয়ে যাঁরা ভূত ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এ এক অভিনব সুস্বাদু অভিজ্ঞতা। আর যাঁরা ভূত ভালোবাসেন না তাঁরা? নিঃসন্দেহে এই সিরিজে তাঁদের জন্যও বহু কিছু রয়েছে। মানুষের হিংসা, লোভ, আতঙ্ক, একাকিত্ব প্রভৃতিকে ভয়ের উপাদানের মোড়কে এমন নিপুণ ভাবে এখানে বোনা হয়েছে, তা নিছক বিনোদনকে অতিক্রম করে যায়। ফলে সব শ্রেণির দর্শকই 'আধুনিক বাংলা হোটেল'-এ একবার ঢুকে পড়লে আর বেরতে পারবেন না। ঠিক শেষ গল্পের একেবারে শেষে দেখতে পাওয়া সেই সতর্কবাণীর মতো। 'এখানে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না।' এই হোটেল দেখার পরও সঙ্গে থাকে। ভাবায়।