shono
Advertisement

Breaking News

ইতিহাস নয়, প্রোপাগান্ডা

এক ধরনের আশ্চর্য বিশ্বাস আছে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের, তা হল, মতাদর্শের মহত্ত্ব জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে।
Posted: 07:01 PM Feb 15, 2022Updated: 07:01 PM Feb 15, 2022

এক ধরনের আশ্চর্য বিশ্বাস আছে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের, তা হল, মতাদর্শের মহত্ত্ব জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে। এই বিশ্বাসই সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁদের ঘৃণাকে চালিত করেছে। কিন্তু কোনওভাবেই ঐতিহাসিক নথি থেকে প্রমাণ করা যায় না যে, সুভাষচন্দ্র নাৎসিদের সমর্থক বা সহযোগী ছিলেন।লিখছেন চন্দ্রচূড় ঘোষ

Advertisement

ইতালীয়, জার্মান আর জাপানিরা যা যা সাহায্য করেছিল সুভাষচন্দ্র বসুকে, সেই সমস্ত কিছুর জন্য তাঁর যথেষ্ট কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল। কিন্তু এই দেশের নেতৃত্ব, তাঁদের ক্ষমতার সমীকরণ এবং তাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের মতামত ছিল একদম পরিষ্কার। ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে যথেষ্ট উদাসীন ছিলেন হিটলার। তাই স্বাধীনতার জন্য যা সাহায্য দরকার, তা টেনে বের করে আনতে সুভাষচন্দ্রকেও তাঁর নিজের মতো প্রোপাগান্ডার খেলা খেলতে হয়েছিল এবং জিততে হয়েছিল, যাকে বলে ‘ব্যাটল অফ পারসেপশন’। অক্ষশক্তির কাছে বিশ্বাস অর্জন করা বা তাদের জরুরি মনে করানো সুভাষচন্দ্রর প্রয়োজন ছিল বটে; কিন্তু একইসঙ্গে অক্ষশক্তিকেও ব্রিটিশদের দেখাতে হবে যে সুভাষচন্দ্র জিতে গিয়েছেন- এই সমীকরণ তিনি আরোপ করেছিলেন স্পষ্টভাবে।

কিন্তু, এটাও সত্যি যে, সুভাষচন্দ্র তখন সাহায্য চাওয়ার অবস্থানে ছিলেন। কোনও ‘আর্মচেয়ার ক্রিটিক’ হয়ে হুকুম জারি করার অবস্থায় ছিলেন না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, নিজের কিংবা ভারতের আত্মসম্মান না খুইয়ে যতটা পারা যায় সাহায্য এককাট্টা করতেই হবে। এমন পরিস্থিতিতে, তিনি যেভাবে যতটুকু সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিলেন, তা তারিফ না করে কারও পক্ষেই চুপ থাকা সম্ভব নয়। গিরিজা মুখোপাধ্যায় যেমন বলেছেন- নেতাজি তাঁর নিজের কার্যকারণের প্রতি সম্পূর্ণত স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন এবং কোনওভাবেই যেন তাঁকে ‘প্রো-নাৎসি’ দাগানো না যায়, সে নিয়ে সচেতন ছিলেন। এবং এটা যতবার বলার দরকার পড়েছে, তিনি একটুও শব্দ খরচ করতে কার্পণ্য করেননি। যেমন, হিটলারের সঙ্গে বৈঠকে, হিটলার নেতাজিকে প্রচণ্ড উপদেশ দিচ্ছিলেন। ডিক্টেটরের এই জ্যাঠামার্কা আচরণে, যারপরনাই বিরক্ত হয়ে পাশে অ্যাডাম ভন ট্রট জু সোল্‌জ-কে নেতাজি বলেছিলেন- প্লিজ, তোমার ফুয়েরারকে বলো, আমি সারা জীবন রাজনীতি করে আসছি, তাই কারও উপদেশের প্রয়োজন আমার নেই। হিটলার সম্পর্কে নেতাজির ব্যক্তিগত মূল্যায়ন ছিল এমন- দ্য জার্মান ভার্শন অফ দ্য ফকির অফ ইপি। এই ‘ফকির অফ ইপি’ হলেন হাজি মিরজালি খান, যিনি ১৯২৩ সালে ওয়াজিরিস্তানে (তৎকালীন ভারতে, বর্তমানে পাকিস্তানে) ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, নাৎসিদের সাহায্য নিয়ে। ১৯৩৮-এ তিনি আফগানিস্তান থেকে স্বাধীন দেশ ‘পাখতুনিস্তান’-এর ঘোষণা করে ব্রিটিশ-বিরোধিতা শুরু করেছিলেন।

[আরও পড়ুন: জাতের যাতনা ও ‘উলটাপ্রদেশ’]

এটা বললে বাড়াবাড়ি হবে না যে, বিপক্ষের হলেও ভাবনা ও চিন্তনের দিক থেকে, নেতাজির তুলনায়, মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরু ব্রিটিশদের অনেকটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তা সে যতই সুভাষ অক্ষশক্তির সাহায্যের প্রতি নির্ভরশীল থাকুন!

আরও কড়া সত্যিটা হল, সমস্ত দেশ ও সেই দেশের নেতৃত্বগণ যে যার দেশের স্বার্থ ছাড়া আর কিচ্ছু পরোয়া করে না। ১৯৯০-এর গ্রীষ্মকালে এই কথাটাই ব্যাখ্যা করেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। নিউ ইয়র্কের সিটি কলেজে, ম্যান্ডেলা প্রথমবার মার্কিন মানুষজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় এসেছেন। আয়োজন করেছেন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট টেড কোপ্পেল। আমেরিকা যেসব দেশনেতাদের অ্যাপ্রুভ করে না, তাঁদের সম্পর্কে ম্যান্ডেলার কী ধারণা, এই বিষয়ে একের পর প্রশ্নের বোমা ফেলা হচ্ছিল। কূটনীতিবিদ এবং রাজনীতি বিশেষজ্ঞ লেখক কেনেথ অ্যাডেলম্যান ম্যান্ডেলার উদ্দেশে মন্তব্য করেছিলেন- আমরা যারা জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের লড়াইয়ে আপনার লড়াই ভাগ করে নিই, তারা মানবাধিকার সম্পর্কে আপনার ধ্যানধারণা সম্পর্কে খানিক মর্মাহত, বিশেষ করে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার থেকে আপনি যে যে ধারণা পোষণ করেছেন।

এরপর তিনি প্রশ্নটি করেন এরকম- আপনি গত ছয় মাসে তিনবার ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাঁর প্রশংসা করেছেন। আপনি গদ্দাফিকে জানিয়েছেন যে, আপনি তাঁর ভাবনাচিন্তায় সহমত পোষণ করেন এবং গদ্দাফির মানবাধিকারের ধারণাকে আপনি তুমুল প্রশংসা করেছেন এই বক্তব্যে যে, তিনি স্বাধীনতা এবং বিশ্বশান্তির জন্য মানবাধিকারকে পর্যায়ে ব্যবহার করেছেন, তা অতুলনীয়। আপনি ফিদেল কাস্ত্রোকে মানবাধিকারের নেতা বলে সম্বোধন করেছেন। এবং বলেছেন, কিউবা হল সেই দেশ, যে কিনা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় মানবাধিকারে অনেক গুণে এগিয়ে। যেখানে কিনা জাতি সংঘের তথ্য বলছে কিউবায় মানবাধিকার অন্যতম নিম্ন স্তরে। আমার অবাক লাগছে, এই নেতারা আপনার কাছে মানবাধিকারের নেতৃত্বের মডেল, আর তাই যদি হয়, আপনি কি কোনও গদ্দাফি বা আরাফাত বা কাস্ত্রোর মতো কোনও নেতাকে দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চাইবেন?

প্রত্যুত্তরে ম্যান্ডেলা যা বলেছিলেন, তাতে দর্শকরা তাঁকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়েছিল। বক্তব্যটি এই-
কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের এই ভুল ধারণা রয়েছে যে, তাঁদের শত্রুকেও আমাদের শত্রু হতে হবে। যে কোনও দেশের সম্পর্কে আমাদের ধারণা তৈরি হয়, সেই দেশ আমাদের দেশের সংগ্রামের প্রতি কীরকম ধারণা পোষণ করে তার ওপর। ইয়াসের আরাফাত, কর্নেল গদ্দাফি, ফিদেল কাস্ত্রো আমাদের সংগ্রামকে তীব্রভাবে সমর্থন করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় মানবাধিকারের যেমন প্রয়োজন, সেভাবেই তাঁরা প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন। ফলে, মানবাধিকারের প্রতি তাঁদের যে প্রতিশ্রুতি, তাকে স্বাগত জানানোর বিষয়ে আমাদের কোনও দ্বিধা থাকার কারণই দেখি না। তাঁরা শুধুই কথায় বা বুলিতে জাতিবিদ্বেষ-বিরোধী সংগ্রামের সমর্থন করেননি, আমরা যাতে এই সংগ্রাম জিততে পারি, তার জন্য তাঁরা যথাসম্ভব সহায় হয়েছেন আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে। ফলে, এটাই হল আমার অবস্থান।

‘আমেরিকান জিউয়িশ কংগ্রেস’-এর এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর হেনরি সিগম্যানের প্রতি ম্যান্ডেলার জবাব তো আরওই তীক্ষ্ম ছিল। প্রথমত, আমরা একটি মুক্তি আন্দোলনের সংগ্রামী। যে আন্দোলন কিনা বিশ্বের দেখা সবচেয়ে কুৎসিত জাতিগত অত্যাচারের একটি শাসনতন্ত্র থেকে আমাদের জনগণকে মুক্তি দেওয়ার সংগ্রামে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার সময় আমাদের নেই। সেটা আমাদের দায়িত্ব, কেউ যদি মনে করে, তবে তা হবে সম্পূর্ণত অযৌক্তিক ধারণা।

২০১৫ সালে যখন রাষ্ট্র সংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের একটি আসনে সৌদি আরবকে সমর্থন করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের কাছে চ্যানেল ফোর নিউজের জন স্নো জবাবদিহি দাবি করেন, তখন ক্যামেরন স্বীকার করে নেন, ‘হয়তো আমার পক্ষে বলা সহজ হত, আমার সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্ক নেই বা এসব রীতিমতো জটিল বিষয় ইত্যাদি, কিন্তু আমার কাছে ব্রিটেনের জাতীয় নিরাপত্তা ও আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রাথমিকভাবে জরুরি।’

এক ধরনের আশ্চর্য বিশ্বাস আছে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের, তা হল মতাদর্শের মহত্ত্ব জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে। এই বিশ্বাসই সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁদের ঘৃণাকে চালিত করেছে। কিন্তু কোনওভাবেই ঐতিহাসিক নথি থেকে প্রমাণ করা যায় না যে, সুভাষচন্দ্র নাৎসিদের সমর্থক বা সহযোগী ছিলেন। এর নেপথ্যে তাঁদের ‘ভাল গান্ধীবাদী’ হওয়ার প্রয়াসও দায়ী বটে, পাশ্চাত্য দুনিয়াকে খুশি করার জন্য। স্বাধীনতার পর থেকে গান্ধীকে প্রায় ‘মিথ’ করে তোলার একটি সুশৃঙ্খল গঠনতন্ত্র গড়ে উঠেছে এই কারণেই।

বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সুভাষচন্দ্রর প্রতি ঘৃণার কারণ অবশ্য কিছুটা আলাদা। অক্ষশক্তির সঙ্গে তাঁর সংযোগের চেয়েও আরও বেশি মূলগত একটি কারণ রয়েছে সেক্ষেত্রে। ব্রিটিশরাজের শেষদিকে প্রতিরক্ষা দপ্তরের যুগ্মসচিব ফিলিপ ম্যাসন বলছেন: ‘একজন ইংরেজের কাছে সুভাষচন্দ্র বসুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুব গ্রহণযোগ্য বলে না মনে হওয়ারই কথা। তাঁর ঔদ্ধত্য, তাঁর আপসহীন মনোভাব এবং রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ আহ্বানের ঘোষণায় তাঁর দৃঢ়তা- এসবই ইংরেজদের কাছে অস্বস্তিকর।’

তাৎপর্যপূর্ণ যা, তা হল, সুভাষচন্দ্রর প্রতি এই মনোভাবের ধারাবাহিকতা। সুভাষকে ভারতীয় নেতাদের থেকে পৃথক করে দেখা ও তাঁকে দুর্বৃত্ত হিসাবে বিবেচনার প্রবণতা শুরু হয়েছিল সুভাষের জার্মানিতে পদার্পণের খবর প্রকাশ্যে আসামাত্রই। যে সুভাষ সম্পর্কে ১৯৩৮ সালে ‘টাইম’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং আত্মতুষ্ট কংগ্রেসের কতিপয় শীর্ষ নেতার মধে্য সুভাষ ব্যতিক্রম’, বা ১৯৩৮ সালে তাঁর ইংল্যান্ড সফরকালে ব্রিটিশ গণমাধ্যম যে সুভাষের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিল- সেই সুভাষ ক্রমে হয়ে উঠলেন ‘খলনায়ক’।

১৯৪২ সাল পর্যন্ত সুভাষকে বলা হত বামপন্থী নেতা বা উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা, কিন্তু ১৯৪২-এর মাঝামাঝি থেকে তাঁকে চিহ্নিত করা হতে থাকে ‘ভারতীয় কুইসলিং’ হিসাবে। ‘কুইসলিং’ অর্থে দেশ দখলকারী শত্রুপক্ষের দালাল। ‘দ্য অবজার্ভার’ তাঁকে তকমা দিয়েছিল, ‘ভারতীয় আকাশের রেডিওবাজ দেশদ্রোহী ধ্রুবতারা’। অক্ষশক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের উল্লেখ মার্কিন সংবাদমাধ্যমের চেয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে বেশি দেখা গিয়েছিল। ‘অক্ষশক্তির হাতের পুতুল জাপানে পৌঁছলেন’ বা ‘ভারতীয় বিশ্বাসঘাতক আজাদ হিন্দ সরকার তৈরি করছেন ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য’- এই জাতীয় নানা কিছু লেখা হয়েছিল সেসময়। তাঁকে ‘এশীয় কুইসলিং’ বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে ‘তোজো এশীয় পুতুলদের পেপ টক দিচ্ছেন’। জাপানের সরকারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের পর লেখা হয়েছিল ‘বোস তাঁর প্রভুর সঙ্গে দেখা করলেন।’ একটি মার্কিন সংবাদপত্রে পাঠকদের সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষা করা হয়েছিল এই প্রশ্ন করে, ‘৪৬ বছর সুভাষচন্দ্র বসু কোন দেশের জন্য জাপানের পুতুল সরকার তৈরি করছেন, বার্মা (অধুনা মায়ানমার), ভারত, সিয়াম না ফিলিপিন্স?’ অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে আইএনএ-র নেপথে্য রয়েছে সুভাষচন্দ্র বসুর ‘শয়তানি বুদ্ধি’। বিমান দুর্ঘটনার পর ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ একথাও লিখেছে, ‘ভারতীয় পুতুল নিহত বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।’

ইতিহাস বা ভারতের প্রতি উদ্বেগ নয়, এই ঘৃণাপূর্ণ মিডিয়া প্রোপাগান্ডা-ই সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি আন্তর্জাতিক ভারত-বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছে।

[আরও পড়ুন: গান্ধী-সুভাষ মতানৈক্য]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement