সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: নিজের জীবনসায়াহ্নে এসে তিনি বলতেন, ”আমার সমালোচনা করা লোকটিই একদিন বলবেন, মানুষটি বড় ভাল ছিল গো, আর কিছুদিন বাঁচতে পারত!” ১৯৬২ সালের ১ জুলাই প্রয়াণের পর সত্যিই অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল বিধানচন্দ্র রায়ের (Bidhan Chandra Roy) কথা। তাঁকে নিয়ে বিতর্ক তুলেছে বিরোধীরা। শুনতে হয়েছে নানা কটূক্তি। তবু শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘বাংলার রূপকার’ হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন সকলেই। চিকিৎসক হিসেবে তিনি কিংবদন্তি। পাশাপাশি প্রশাসক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত।
[আরও পড়ুন: বিধানচন্দ্র রায় ও কল্যাণীর ‘প্রেম’, মিথ ও মিথ্যের নেপথ্যে কাহিনি]
বিহারের পাটনা থেকে মাত্র কয়েক টাকা সম্পদ নিয়ে মানুষটির উদয় হয়েছিল এই রাজ্যে। বিদেশে ডাক্তারি পড়েও বিনা পয়সায় রোগী দেখতে আগ্রহী ছিলেন বেশি। মধ্য কলকাতায় বসবাসের ঘুপচি ঘর, সাদামাটা পোশাক আর চিকিৎসক হয়ে ওঠার কঠিন লড়াইয়ের মধ্যেই অনুরণিত হয়েছিল বিধানচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনও। প্রশাসক হিসেবে তাঁর কৃতিত্বের কথা স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (Prafulla Chandra Ghosh)। কিন্তু তিনি স্বল্প সময়ই মসনদে ছিলেন। তাঁর পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন বিধান (B C Roy)। একদা নেতাজি সুভাচন্দ্র বসুর (Netaji Subhash Chandra Bose) পছন্দের মানুষ, কলকাতার প্রাক্তন মেয়র, কংগ্রেস নেতা, জনপ্রিয় চিকিৎসক ১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি দায়িত্ব নিলেন। একজন সাধারণ চিকিৎসক থেকে ক্রমেই বাংলার রূপকার হয়ে ওঠার যাত্রাপথ সত্যিই বিস্মিত করে।
কাজটা সহজ ছিল না। মন্ত্রিসভা থেকে প্রশাসন পরিচালনা, সব ক্ষেত্রেই নয়া প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু নীলরতন সরকার মেডিক্যাল হাসপাতালের (NRS Medical College and Hospital) চিকিৎসক-শিক্ষকের মূল শক্তি ছিল তাঁর শিক্ষা আর মাটির টান! সুনিশ্চিত পেশা এবং বিপুল আয়ের পথ বন্ধ করেই মানবসেবায় নিয়োজিত হলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে সমস্যা কমার তুলনায় বাড়তে থাকল ফের। দেশভাগ, পশ্চিম পাকিস্তান (Pakistan) থেকে এদেশে আসা অগণিত মানুষের ঢল নতুন করে ভাবাল তাঁকে। খুললেন প্রায় ৫০টি উদ্বাস্তু শিবির। শোনা যায়, অতিরিক্ত ৪২ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল সরকারের। সেই সময় এই অঙ্কের অর্থ ছিল আজকের হিসেবে কয়েক কোটিরও বেশি। আবার এই সময়েই বাম আন্দোলন, জ্যোতি বসুর (Jyoti Basu) নেতৃত্বে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভও শুরু হচ্ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসন পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক আক্রমণও প্রতিহত করছেন রোজ।
এর মধ্যেই বিনা পারিশ্রমিকে রোগী দেখা ডাক্তারের মাথায় এল কলকাতা ছাড়িয়ে নতুন বাসস্থান তৈরির কথা। সল্টলেক, কল্যাণী, দুর্গাপুর তৈরি করলেন তিনি। তাঁর মাথায় এল কলকাতার কাছে জঙ্গল, মাছের ভেড়িতে ভরপুর একটি জায়গার কথা। তবে ওই বিপুল পরিমাণ জমি কেনার টাকা নেই তাঁর সরকারের! এমন সময় মুখ্যমন্ত্রীকে সাহায্য করলেন প্রফুল্লচন্দ্র সেন (Prafulla Chandra Sen)। তাঁকে ডেকে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ”পূর্ব কলকাতায় অনেক জলা জমি আছে। সেগুলি বুজিয়ে ফেলতে হবে।” বিস্মিত হলেন প্রফুল্ল সেন। তিনি জানালেন, ”একাজ সম্ভব নয়, কারণ পুরো জায়গাটায় হেমচন্দ্র নস্করের।” যিনি নিজেও একই মন্ত্রিসভার সেচমন্ত্রী।
[আরও পড়ুন: যেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী! বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মদিনেই দেশজুড়ে পালিত হয় ‘ডক্টরস ডে’]
বহু টালবাহানার পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর আচমকা ডাকে হাজির হলেন ‘হেমদা’। প্রথমে রাজি না হলেও বিধানচন্দ্র বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সম্মতি আদায় করে ফেললেন তাঁর। এমনকী, মাত্র এক টাকাতেই রফা হল বিপুল পরিমাণের ওই জায়গার দাম। পরিকল্পনা করাই ছিল আগে! মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে নকশা নিয়ে হাজির হলেন মুখ্যসচিব। সই করলেন হেমচন্দ্র। বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর বাসস্থানের লক্ষ্যে অবতীর্ণ হল সল্টলেক।
তিনিই দুর্গাপুর (Durgapur) শিল্পনগরী তৈরি করতে নেহরুকে চিঠি লিখেছেন। কারখানা তৈরির বন্দোবস্ত করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তৈরি করে ফেলেন কল্যাণী (Kalyani) শহর। শুধু শহর তৈরি নয়, কৌশলগত অবস্থানে ভর করেই ওই নবনির্মিত শহরেই করেন জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন। চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা। মুর্শিদাবাদ-মালদহের সংযোগে ফারাক্কা বাঁধ (Farakka Barrage) তৈরি করিয়ে গঙ্গার জল সংরক্ষণ, চাষের কাজের গতিতেও যুগান্তকারী পদক্ষেপ করেন তিনি। ময়ূরাক্ষী প্রকল্প, হাওড়া থেকে শেওরাফুলি, প্রথম বৈদ্যুতিক রেলপথের সূচনা হয় তাঁর উদ্যোগে।
উত্তরবঙ্গেও ছড়িয়েছিল বিধান-মস্তিষ্কের সৃষ্টির বীজ। তাঁর ইচ্ছাতেই নতুন পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিতি পায় দিঘা। হলদিয়া বন্দরের সূচনাতেও নাম উঠে আসে তাঁরই। কিন্তু নেতাজির অন্তর্ধানে ‘নীরব’, ‘নেহরুর গোলাম’, প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে ‘প্রতারণা’, একাধিক বিতর্কেও উঠেছে তাঁর নাম। সেসবকে উপেক্ষা করে ইন্দিরার চিকিৎসক, ‘মহাত্মা’র প্রিয় সতীর্থ হয়েছেন বিশ্বজয়ী। নিজ মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় ছড়িয়েছেন সৃষ্টির উপকরণ। কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদের দরজায় ব্যাপ্ত হয়েছে তাঁর সাধারণ থাকার উপজীব্য। যার হাত ধরেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘রূপকার’ কাকে বলে!