আটের দশকে পারস্য উপসাগরের কূলে ছিল শুধু জেলেদের বাসস্থান। উট চরে বেড়াত মরুভূমিতে। অবশেষে রকেটের গতিতে উত্থান। অপরাধকে ‘জিরো টলারেন্স’ কীভাবে একটি দেশকে বদলে দিতে পারে, দুর্নীতিমুক্ত করে শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে তার উদাহরণ দুবাই। কলমে কিংশুক প্রামাণিক
মরুভূমিতে ‘মরূদ্যান’ দেখতে পেয়েছিল টিনটিনের বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যাডক। ফুটিফাটা রোদে জ্বলছে শরীর। একবিন্দু জলের আশায় হাহাকার। তেষ্টায় বুক ফেটে যায়। হঠাৎ ক্যাপ্টেনের নজরে এল দূরে বিশাল এক জলাশয়। সারি সারি গাছ। দেখা যাচ্ছে গ্রামও। আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সে। পলক ফেলতে না ফেলতে দৌড় দৌড়। কাছে এসে দেরি না করে ‘জল’-এ লাফ।
অতঃপর দৃশ্যটি এরকম, তপ্ত বালির উপর ক্যাপ্টেন ধপাস! চালভাজার মতো পুড়ে খাক! ভ্রম কাটল আছাড় খেয়ে। মরূদ্যান নয়, মরুভূমিতে মরীচিকা দেখেছে। আপসে পড়ে আহত হয়ে আরও ভেঙে পড়ল হ্যাডক। যখন সত্যিই মরূদ্যান এল, বিশ্বাস করতে পারছিল না।
আমারও খানিক তেমন দশা। এ কোথায় এলাম? বালি কই! উটেরা সব গেল কোথায়! মরু বুজিয়ে এ কার নগর! নিপাট তুলির টানে আকাশের গায়ে কে একের পর এক ইমারত এঁকে দিল! তার রং-রূপ, আকার-সৌন্দর্যে বিকশিত বৈভব। প্রস্ফুটিত নব অজন্তার কারুশিল্প। সব বাড়ি কেমন এক পায়ে দাঁড়িয়ে, একে ওপরকে ছাড়িয়ে। কবি জীবনানন্দর ভাষায় বলতে পারতাম-
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;’- কিন্তু এ তো কবেকার নয়, এ শহর আজকের। কোন সে ‘খলিফা’ কারিগর যিনি মেঘকে ছুঁতে চান? পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বাড়ি বানানোর দুঃসাহস দেখান?
সভ্যতার বিস্তার হয় আধুনিকতাকে পাথেয় করে। কিন্তু তার ব্যাপকতা এত! ফাঁকা জমিতে শহর বানানো যায়। সমুদ্র বুজিয়ে সিঙ্গাপুরের সৌন্দর্য বাড়ানো যায়। তাই বলে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার খাক নির্জলা মরুভূমিকে জাদুনগরী তৈরি করা? এ যেন ময়দানবের কেরামতিকেও হার মানায়!
[আরও পড়ুন: খলিস্তানিদের কার্যকলাপে এত উদ্বিগ্ন কেন ভারত?]
পৃথিবীর সব আয়োজন, সব বিনোদন হাজির আজকের নতুন দুবাইয়ে। এখানে বসে বিশ্ব হাতের মুঠোয়। পথ থেকে পরিবেশ- ইউরোপীয়-মার্কিন সংস্কৃতির মিশেল। অথচ শৃঙ্খলার মোড়ক। কে বলবে এটি একটি রক্ষণশীল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ! বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি জীবনযাপনের মানের উন্নয়ন। একলাফে ডলারকে ছুঁতে চায় মরু-মুদ্রা দিরহাম।
বলতে দ্বিধা নেই একটি বিশৃঙ্খল দেশ থেকে আমি এসেছি। নিজের চোখে নতুন দুবাইয়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেখে চমকে গেলাম। আমরা কোথায়, ওরা কোথায়! ইমারতের সরণির শোভা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, মরীচিকা? না কি জাদুকর ম্যানড্রেকের ইন্দ্রজাল! যা দেখছি সব সত্যিই তো? দু’-চোখে হাত রেখে কচলে নিই। নিজের হাতেই চিমটি কাটি।
এই অবধি লিখে একটি সত্যিকথা বলি। দুবাই সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা আমার ছিল, ব্যাপারটা এমন নয়। বরং ঘটনার ঘনঘটায় এত দিন জেনে এসেছি, বিশ্ব-বাণিজ্য থেকে বিনোদন, স্থাপত্য বিস্ময়ের আড়ালে দুবাই আসলে অপরাধের স্বর্গরাজ্য। বিশ্বত্রাস ডন, গ্যাংস্টার, মাফিয়া, জুয়াড়ি, সন্ত্রাসবাদীদের ‘সেফ হোম’। কারণ, একটি নাম। সে দাউদ ইব্রাহিম। কুখ্যাত মাফিয়া ডন। ‘দুবাই’ এবং ‘দাউদ’, জেনে এসেছি সমার্থক।
আমার এই ভাবনার সঙ্গে অনেকেই একমত হবে। ভারতীয় মাত্রই দাউদ ইব্রাহিমকে হাড়ে হাড়ে চেনে। তারা জানে দাউদ কে, সে কী করতে পারে। পাকিস্তান তাকে আজও কেন পাসপোর্ট দেয়। জামাই-আদর করে নিজেদের দেশে রেখে দেয়।
১৯৯৩ সালে মুম্বইয়ে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণের পর দাউদের নাম আতসকাচের নিচে উঠে আসে। ৩৬ বছরের তরুণ তখন বাণিজ্য নগরীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের সম্রাট। দুবাইকে বেস করে অপরাধচক্র চালায়। এমনকী, মুম্বইয়ের রুপোলি জগতেও তার ছায়া। সেলিব্রিটিদের সঙ্গে সারজা স্টেডিয়ামে তার ছবি সেই আমলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভাইরাল হয়। সেদিন থেকে ভারতবাসীর চোখে দুবাই হয়ে যায় দুশমনের ঘাঁটি। বায়োস্কোপের গব্বর সিংয়ের চেয়েও দাউদ কুখ্যাত হয়ে ওঠে।
সময় সব বদলে দেয়। দাউদ-কাঁটা উপড়ে পারস্য উপসাগরে আজ নতুন ঢেউ। উন্নতির শিখরে উঠতে গেলে সবার আগে দরকার শান্তি ও শৃঙ্খলা। দুবাইয়ে এসে এই শহরের এর ‘সভ্য’ হয়ে ওঠার কাহিনি শুনে অবাক হলাম। আজকের দুবাইয়ে দাউদ ইব্রাহিম কেন, পাতি পকেটমারেরও জায়গা নেই। বড় অপরাধ দূর-অস্ত, সামান্য ট্র্যাফিক আইন ভাঙলে এখানে যে পরিমাণ অর্থ জরিমানা দিতে হয়, তাতে স্পষ্ট আইন শুধু বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ নেই, তা বাস্তবে প্রয়োগ হয়। মানুষ মানতে বাধ্য।
স্বাধীনতা আনে শৃঙ্খলাও। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থেকে সমাজ জীবনে মুক্তির স্বাদ। এই দুবাই মানুষকে বিপুল অধিকার দিয়েও জারি করেছে শৃঙ্খলার বিরল মোড়ক।
উদারপন্থী আমিররা তাঁদের দেশকে একটি অপরাধমুক্ত জমি করতে চেয়েছিলেন। গুগ্ল পর্যবেক্ষক বলছে, তাঁরা সফল। অপরাধের দিক থেকে পৃথিবীতে অন্যতম নিরাপদ শহর এখন দুবাই। এখানে পর্যটকরা স্বাধীন ও মুক্ত। আমার গাড়ির চালক বলছিলেন, ‘হোটেলে ঘরের দরজা হাট করে ঘুমিয়ে পড়ুন স্যর। চোর আসবে না। সব ঠান্ডা করে দিয়েছে।’
দুবাই গিয়েছিলাম বার্সিলোনা থেকে। স্পেনের বিখ্যাত ফুটবল শহরে নামাইস্তক পরিচিতজন সবাইকে জানিয়েছিলাম, সাবধান! বার্সিলোনায় কিন্তু চুরি-ছিনতাই খুব হয়। কেপমারের দলের নজরে পড়লে সর্বস্বান্ত হওয়া নিশ্চিত। হোটেলও নিরাপদ নয়। পাসপোর্ট সাবধানে রাখতে হবে।
ঠিক উলটো চিত্র দুবাইয়ে। এখানে অপরাধ ভয় পায় আইনকে। তথ্য বলছে, এমিরেটসের কঠোর আইন-অনুশাসনে এই শহরে ২০২১ সালের চেয়ে এক বছরে অর্থাৎ ২০২২-এ অপরাধ কমেছে ৬৩.২ শতাংশ। খুন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, প্রতারণা, ড্রাগ সেবন নেমেছে প্রায় শূন্যে। এমন চললে নেদারল্যান্ডসসের মতো দুবাইয়ে জেলখানা বন্ধ করে দিতে হবে। আদালতে উকিল, বিচারকরা মাছি তাড়াবে।
অথচ বাণিজ্য, বিনোদন, বিপণন, সেক্স টুরিজমের নন্দনকানন এই মরুশহর। বিশ্বের সব বিখ্যাত ব্র্যান্ড দিয়ে যেমন দুবাই সাজানো, তেমন এটি একটি বিশাল এক ফিনানশিয়াল হাব-ও। সারা পৃথিবীর ব্যবস্থা এখানে বসে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিস। সুবিশাল সব হোটেল। সমুদ্রকে কেন্দ্র করে ফুর্তির সেরা সম্ভার।
কে বলবে এটি মুসলিম দেশ! বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে এসেছে কাজ করতে। সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিয়ে কাজ করছে। সৌদি আরব থেকে ইরান, জ্বালানি তেলের সম্ভারে বলিয়ান দেশগুলি এখনও রক্ষণশীলতায় নিজেদের মুড়ে রেখেছে। সেখানে অবগুণ্ঠন খুলে স্বাধীনতা চায় নারীরা। অথচ কোনও মিল নেই সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর অন্যতম এমিরেটস দুবাইয়ের সঙ্গে। এখানে অবাধ স্বাধীনতা।
এমিরেটস বিমান সংস্থা যে এয়ারপোর্টটি বানিয়েছে সেটি তো আলাদা একটি নগর! পৃথিবীর সব দেশে উড়ে যাচ্ছে বিমান। বিমানবন্দরকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করছেন যাত্রীরা।
সুবিশাল অট্টালিকা ‘বুর্জ খলিফা’-র নিচে আর এক বিস্ময় দুবাই মল। তার ব্যাপকতা তাক লাগিয়ে দেবে। সমস্যা একটাই, সুতীব্র তাপপ্রবাহ। শীতের সময়ও দিনের বেলা মারাত্মক তাপপ্রবাহ। গরম ঠেকাতে অফিস-আদালত, শপিং মল-দোকানপাট, ট্রেন-ট্রাম-গাড়ি সর্বত্র এয়ার কন্ডিশনের ব্যবস্থা। পারলে গোটা শহরকে একদিন না এরা বাতানুকূল করে দেওয়ার টেকনোলজি বের করে ফেলে!
স্বভাবতই বিশ্বের চোখ মধ্য-প্রাচ্যের মরুনগরীতে। দুবাইকে নকল করছে অন্য দেশ। অথচ, আটের দশকে পারস্য উপসাগরের কূলে ছিল শুধু জেলেদের বাসস্থান। উট চরে বেড়াত মরুভূমিতে।
অবশেষে রকেটের গতিতে উত্থান। অপরাধকে ‘জিরো টলারেন্স’ কীভাবে একটি দেশকে বদলে দিতে পারে, দুর্নীতিমুক্ত করে শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে তার উদাহরণ দুবাই। তাই এই দুবাইয়ে কোনও দাউদ ইব্রাহিমের জায়গা নেই। এখানে সব জেলখানা-ই হয়তো একদিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।