গোবিন্দ রায়: পদ্মফুল দিয়ে নয়, রীতি মেনে ১০৮টি অপরাজিতা ফুলে সন্ধিপুজো হয় দেবী দুর্গার। টানা ২১৫ বছর ধরেই উত্তর কলকাতার নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের মিত্র বাড়িতে এভাবেই সন্ধিপুজোয় নীলফুলে সেজে ওঠেন সপরিবার দুর্গা (Durga Puja 2021)। শুধুমাত্র ব্যতিক্রমী ফুলই নয়, এই বাড়ির নৈবেদ্যও রয়েছে বিশেষত্বের ছোঁয়া। কুলের আচার, আট রকমের বড়ি দিয়েকে নৈবেদ্য দেওয়া হয় দেবী দুর্গাকে। প্রথম কুল ওঠার পর সেই কুল দিয়ে আচার বানানো হয় মায়ের জন্য। পুজোতে মিষ্টির বৈচিত্র্যও আলাদা। এখানে প্রায় আট থেকে দশ রকমের নাড়ু হয় দেবী দুর্গার ভোগের জন্য। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের নারকেলের মিষ্টি, গজা ও নানা ধরনের মিষ্টি বাড়িতেই তৈরি করা হয়। এই সব মিষ্টি করেন বাড়ির মহিলারাই।
উত্তর কলকাতার (North Kolkata) বিখ্যাত রাস্তা নীলমণি মিত্র স্ট্রিট। সেই নীলমণি মিত্রের নাতি রাধাকৃষ্ণ মিত্র এই পুজোর প্রবর্তন করেন। সেই থেকেই উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম এই মিত্রবাড়ির পুজো। বংশপরম্পরায় বাড়ির ছেলেরাই এই পুজোর দায়িত্ব নিয়ে আসলেও রাজকৃষ্ণ মিত্রের নাতি মানবেন্দ্র কৃষ্ণ মিত্রের তিন ছেলের কোনও পুত্র সন্তান না থাকায় বর্তমানে তাঁর তিন মেয়ে এই পুজোর পরিচালনা করেন। ইতিমধ্যেই সেই বাড়িতে প্রস্তুতি তুঙ্গে।
মিত্র বাড়ির বড়ো কন্যা অনসূয়া বিশ্বাস মিত্র জানান, ”এই বাড়ির প্রতিমার আরও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী মূর্তি হয় দেবীমুখ অর্থাৎ টানা টানা চোখের প্রতিমা এবং কার্তিক ও অসুরের মুখ হয় মানবমুখের আদলে। প্রতি বছরই দুর্গার মূর্তি একই রকম মূর্তির ছাঁচে করে রাখা হয়।” তিনি আরও বলেন, কুমোরটুলির একই জায়গা থেকে বংশপরম্পরায় এই প্রতিমা হয়ে আসছে। প্রতিমাটি হয় এক কাঠামোর। বর্তমানে প্রতিমা করছেন শিল্পী অসিত মুখোপাধ্যায়। এখানে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিনদিন ধরে চলে কুমারী পুজো। দশমীর দিনে পান, মাছ খেয়ে বাড়ির মহিলারা মাকে বরণ করেন।
[আরও পড়ুন: Durga Puja 2021: প্যান্ডেলে গিয়ে অঞ্জলি দিতে লাগবে টিকার জোড়া ডোজ, নয়া গাইডলাইন আদালতের]
পরিবার সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, আড়িয়াদহ থেকে ভাগ্যান্বেষণে সুতানুটি অঞ্চলে আসেন এই পরিবারের জগন্নাথপ্রসাদ মিত্র। রাঢীয় কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত দর্জিপাড়া মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। তিনি কী ব্যবসা করতেন তা জানা যায় না। তবে তাঁর পৌত্র দুর্গাচরণ ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার ‘কোর্ট জুয়েলার’। হিসেবের খাতায় তাঁর লেখা গান পড়ে খুশি হয়ে হয়ে দুর্গাচরণ রামপ্রসাদকে আজীবন মাসোহারার ব্যবস্থা করে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্য-সংগীতচর্চার জন্য। দুর্গাচরণের ভ্রাতুষ্পুত্র নীলমণি মিত্রও ছিলেন সে যুগের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি।
[আরও পড়ুন: Durga Puja 2021: পুজোর সময় বাড়তি পরিষেবা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোতেও, প্রকাশিত নতুন সময়সূচি]
নীলমণি মিত্রর পৌত্র ব্যবসায়ী রাধাকৃষ্ণ মিত্র ১৮০৬-এ দর্জিপাড়া মিত্রবাড়ির দুর্গোৎসবের সূচনা করেন। আগে এখানে আগে পাঠা বলি হত কিন্তু একবার রাজকৃষ্ণ মিত্রের পায়ের কাছে একবার একটি ছাগল চলে আসে। সেই থেকে এখানে বলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রীতি মেনে সিঁদুর খেলায় মাতেন বাড়ির মেয়ে-বউরা। সেখানে বাদ যায় না প্রতিবেশীরাও। প্রথা মেনে বাড়ির পুরুষরা আজও সাদা ধুতি পড়ে উড়নি গায়ে দিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দিতে যান।