সিবিআই ও ইডি-র আজ্ঞাবহতা নতুন নয়। এই দু’টি সংস্থাকে ব্যবহার করে বিজেপি এখন ‘টার্গেট’ করছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তদন্তে তদন্তে তাঁকে বিব্রত করা এবং মানসিক পীড়ার বলয়ে নিক্ষেপ করে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব চাইছে- তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতির রাজনৈতিক সক্রিয়তা স্তিমিত করতে। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-কে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়? না, হয় না? এই প্রশ্নটি নিয়ে যদি কোনও সংস্থা এখন সমীক্ষা চালায়- সাধারণ মানুষের জবাব কী হবে?
যাদের কাছে এই প্রশ্নটি উত্থাপিত করা হবে, তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য থাকতে পারে। যারা বিজেপি সমর্থক তারা তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত দেখে অনাবিল আনন্দ পেতে পারে। আবার যখন অমিত শাহ, এমনকী, নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কংগ্রেস জমানায় ‘ফেক এনকাউন্টার’ ছাড়াও নানা ধরনের মামলা হয়েছিল, তখন ‘সিবিআই’-এর নাম বিজেপি দিয়েছিল ‘কংগ্রেস ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’। সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদম্বরম-সহ বহু কংগ্রেস নেতা অমিত শাহকে জেলে পাঠিয়ে যারপরনাই আহ্লাদিত বোধ করেছিলেন প্রশ্নটা হচ্ছে, তাহলে কি সিবিআই বা ইডি-র আদতে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা আছে বলে ধরে নেওয়া যায়? আমার মনে হয় দল-মত নির্বিশেষে একথা অনস্বীকার্য যে, দু’টি সংস্থার কোনওটাই নিরপেক্ষ নয়।
’২১ সালের রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সিবিআই এবং ইডি আকস্মিক হানা দিয়েছিল। কলকাতার একটি ইলেকট্রনিক চ্যানেলের সাংবাদিক এবং চিত্রগ্রাহক আমাকে জানিয়েছিলেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট হানার খবর তাঁদের কাছে আগাম পৌঁছে যায় এনফোর্সমেন্ট সূত্রেই। যদিও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু জানতেন না। জানার কথাও নয়। কেননা, এনফোর্সমেন্টের অফিসাররা চিরকাল এটাই বলে এসেছেন- যদি ‘ছাপা মারা হয়’, তাহলে যার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে তাকে জানানো হবে কেন!
প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত সিবিআই অফিসার শান্তনু সেন কংগ্রেস জামানায় অনেক সংবেদনশীল মামলা করেছিলেন, খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সিবিআইয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কেউ কখনও তাঁর সম্পর্কে এটা বলতে পারেনি যে, দলদাস হয়ে সিবিআইয়ের কাজ করেছিলেন। শান্তনু একটা কথা সবসময় বলতেন- সিবিআই এর কাজটা হল ‘Covert’, ‘Overt’ নয়। তদন্ত সংবাদমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে হয় না। সিবিআইয়ের প্রাচীন পন্থা হল: কাউকে কিছু না জানিয়ে, সংবাদমাধ্যমকেও কিচ্ছুটি টের না পাইয়ে, মিডিয়া ট্রায়াল না করে, তদন্তের অনুসন্ধান করে চার্জশিট তৈরি করা। আদালতে চার্জশিট পেশ হয়ে যাওয়ার পর, তার ভিত্তিতে যদি প্রমাণাদি পেশ হয়, তখন বিষয়টা সংবাদমাধ্যমের কাছে আসবে। কিন্তু কোনও কিছু প্রমাণ হওয়ার আগেই যদি প্রতিটি মহূর্তে সিবিআই কী করছে না করছে সেটা দৈনন্দিন ‘ব্রিফিং’ হয়, তাহলে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে যায় না সাধারণত।
অতীতে বোফর্স কেলেঙ্কারির সময়ও হয়েছিল এমন। কোনও কিছু প্রমাণ হওয়ার আগেই, সিবিআই সূত্রে আমাদের জানানো হয়েছিল, অমুক চিঠি জেনেভা থেকে এসেছে। সেই চিঠি সংবাদপত্রে প্রকাশিতও হয়েছিল। সিবিআই সেই চিঠির বিষয়ের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে দেয়। তাতে বিরোধীরা সেই সময় রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে চিৎকার শুরু করে, ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।’ ১৯৮৪ সালে ‘মিস্টার ক্লিন’-কে ১৯৮৯-এ ‘বোফর্স গান্ধী’-তে পরিণত করতে যথেষ্ট সুবিধা হয়েছিল, কেননা তখন সিবিআইয়ের একটা অংশ এই ব্যাপারে বিরোধী দলকেও সাহায্য করেছিল। ১৯৮৯-এ বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে সিবিআইয়ের এই সংস্কৃতি কিন্তু বহাল ছিল। এখন বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ১০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে- পশ্চিমবঙ্গে শুধু নয়, দেশজুড়েই সিবিআই এবং ইডি এক বড় শক্তি।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দপ্তরে, বাড়িতেও সিবিআই-ইডি বিভিন্নে সময়ে হানা দিয়েছে। তিনি তো পলাতক নন! তা সত্ত্বেও তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর বিদেশযাত্রা নিয়ে লুকআউট নোটিস জারি হয়েছে। সমস্ত কিছু আদালতকে জানিয়ে করার পরও। সিবিআই ডাকলে তিনি হাজিরও হচ্ছেন। অভিষেক গত রবিবার বিদেশ থেকে ফিরেছেন। ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে প্রচার, সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিজেপি কর্তৃক। ‘অনেক কিছু পাওয়া গিয়েছে’, ‘ধাপে ধাপে আরও অনেক কিছু বেরবে’- প্রচারিত হচ্ছে এমনটা। সুষ্ঠু তথ্য-সহ নির্দিষ্ট কিছু প্রমাণ মেলার আগেই এই বিবৃতির ক্রমশ প্রচার রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে সিবিআইয়ের অবস্থান আরও দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে।
[আরও পড়ুন: দাগী নেতাদের ভাতায় কোটি টাকা খরচ, অথছ বিজ্ঞানীদের ঝুলি খালি!]
প্রশ্ন অবশ্য সিবিআই বা এনফোর্সমেন্টকে নিয়ে নয়। প্রশ্ন হল, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘টার্গেট’ কেন করছে? ২০২১-এ টার্গেট ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনের আগেও তিনি-ই টার্গেট। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রধান কান্ডারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘ব্র্যান্ড ইক্যুয়িটি’ নিয়ে রাজ্য জুড়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। রাজ্যে রাজ্যে বিরোধী ঐক্যর সক্রিয়তা শুরু হয়েছে। এর আগে এরকমভাবে বিরোধী নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হতে দেখা যায়নি দেখা যায়নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে পাটনায় বৈঠক হয়েছে। বেঙ্গালুরুতেও। এই মাসের শেষে মুম্বইতেও বৈঠক হতে চলেছে।
শুধু তা-ই নয়, কর্নাটকে কংগ্রেসের বিজয়লাভ হয়েছে। শোনা যাচ্ছে- সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাতীয় স্তরে একটা কথাবার্তা শুরু হয়েছে। মমতা-কংগ্রেসের মধ্যেও বোঝাপড়া হতেই পারে। এইরকম প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচন আসছে এবং যেগুলোয় বিজেপির বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি’-র অভিযোগ যথেষ্ট শক্তিশালী।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দশ বছরের তৃণমূল শাসনের মশালের আলো অভিষেক জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দিতে যেভাবে পরিশ্রম করছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেও তিনি যেভাবে পরিশ্রম করেছেন এবং সংগঠনকে মজবুত করেছেন, যেভাবে দলে নতুন হাওয়া নিয়ে আসছেন, তাতে রাজ্যস্তরের বিজেপি কিছুটা থতমত। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বুঝতে পারছে, বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব তৃণমূল কংগ্রেসের মোকাবিলা করতে সফল তো নয়-ই, কিছুটা অপ্রস্তুতও।
উত্তরপ্রদেশের মতো ‘জয় শ্রীরাম’ ও হিন্দুত্বের তাস ফেলে এই বঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরানো যে কঠিন, সেটা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব পদে পদে বুঝছে। এই অবস্থায় যেহেতু নরেন্দ্র মোদি দুর্নীতিকে মস্ত বড় ইস্যু করছেন, তাই অভিষেকের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচারের মধ্য দিয়ে তাঁর ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করা হলে, তা বিজেপির জন্য ইতিবাচক।
[আরও পড়ুন: দাগী নেতাদের ভাতায় কোটি টাকা খরচ, অথছ বিজ্ঞানীদের ঝুলি খালি!]
পাশাপাশি, আরও একটা বিষয় মনে হচ্ছে। অভিষেক ২০২৪-এর জন্য জেলাওয়াড়ি সফর করবেন। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি তুঙ্গে। বিজেপির যে আধুনিক রণকৌশল তার পাল্টা কৌশলে তিনিও কিছু কম নন। অভিষেক বারবার বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে চটজলদি সমীক্ষা করান। বিভিন্ন অ্যাকশন নেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে একটা নতুন টিম তৈরি করছেন। তাঁর মধ্যে যুবশক্তি রয়েছে। বিজেপি নেতারা ভাবছেন, এই অবস্থায় যদি তাঁকে তদন্তে-তদন্তে জেরবার করে দেওয়া যায়, এবং মানসিকভাবে পীড়ার বলয়ে নিক্ষেপ করা যায়, সেক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে রাজনৈতিকভাবে ততটা তৎপর থাকা সম্ভব হবে না হয়তো। শেষ পর্যন্ত কী হবে তা ভবিষ্যতের গর্ভেই নিহিত। তবে এটুকু বুঝতে পারি, মমতা এবং অভিষেকের যৌথ নেতৃত্ব যে কোনও ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
redhat.jayanta@gmail.com