রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: গ্রীষ্মের দাবদাহ অগ্রাহ্য করে ইডেনের বাইরে আপনমনে ছবি আঁকছিলেন যিনি, শখের চিত্রকর ছাড়াও সেই যুবকের একটা পরিচয় আছে। ইনি ক্রিকেটার। ময়দানের বিজয় স্পোর্টস ক্লাবে খেলেন, ফুরসতে ছবি আঁকেন। তা, শনিবাসরীয় দুপুরে ক্লাবহাউস গেটের সামনে যাঁর ছবি আঁকছিলেন, এই দেশ তাঁকে চেনে মহেন্দ্র সিং ধোনি নামে। ধোনি তো নেই, আসবেন না আজ ইডেনে, খামোখা তা হলে আঁকছেন কেন? স্মিত হাসিতে চকিত উত্তর আসে, ‘‘ভালবাসায়।’’ ভালবাসা! এই শব্দবন্ধের সঙ্গে বাঙালির বন্ধন বহুদিনের। নিত্য জীবন-দহনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে বারবার ‘ভালবাসা’-র গ্রন্থিতে বাঁধা পড়েছে এই শহর, বল্গাহীন ভেসে গিয়েছে স্রেফ প্রেমের টানে। আর এই ভালবাসার সংজ্ঞাকে কখনও নারী-পুরুষ সম্পর্কে সীমাবদ্ধ রাখেনি বাংলা। বরং তা বিস্তৃত করেছে রাজনীতি থেকে সিনেমায়। সিনেমা থেকে খেলায়। মহেন্দ্র সিং ধোনিকে (MS Dhoni) নিয়ে তাই সে যে এমন পাগলাটে আবেগ-মৃদঙ্গ আগাম বাজাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
কী বলবেন নইলে রাত পৌনে আটটার কলকাতা এয়ারপোর্টকে? যেখানে ধোনি-দর্শন মাত্র উপস্থিত শ’তিনেক উপাসকের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটল, বেঁধে গেল শুধুমাত্র মহানায়ককে চাক্ষুষ করার অভিলাষে তীব্র ধাক্কাধাক্কি! কী বলবেন নইলে ইডেনে অপেক্ষমান জটলাকে, যাঁরা নাইটরা প্র্যাকটিস শেষে বেরনোর সময় ‘ধোনি…ধোনি’ হিংস্র ধ্বনিতে বুঝিয়ে গেলেন, রবিবার ইডেন কার! সিএবি কর্তাদের অধিকাংশ ‘আত্মগোপন’ করেছেন টিকিটের উত্তুঙ্গ চাহিদায়। একটা কেন, আধখানা ছেঁড়া টিকিটও ইডেনের (Eden Gardens) আশেপাশে কোথাও নেই। আম-জনতা ছেড়ে দিন। প্রাক্তন বঙ্গ ক্রিকেটারদের পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে বেশি দাম দিয়ে টিকিট কিনতে হচ্ছে ‘ব্ল্যাকার’দের থেকে! পাগলামি, স্রেফ পাগলামি চলছে এক কথায়। পৃথিবীর কোনও যুক্তি বা বোধে যার কোনও ব্যাখ্যা চলে না।
দু’টো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আন্দাজ করা যায়। প্রথমত, তিন বছর কোভিডে রক্তাক্ত হওয়ার পর এই প্রথম ধোনি-মোহানার মুখোমুখি শহর। আর দুই এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ দুই, খুব সম্ভবত দু’বারের বিশ্বজয়ী ভারত অধিনায়কের এটাই শেষ আইপিএল (IPL)। যদিও ধোনির গুরু কেশব বন্দ্যোপাধ্যায় শোনামাত্র রাঁচি থেকে ফুৎকারে পুরোটা উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘মনে হয় না সিএসকে ওকে এত সহজে ছাড়বে বলে। ওদের পরবর্তী নেতা কোথায়? আমার ধারণা ধোনি আরও একটা আইপিএল খেলবে।’’ ভারতীয় ক্রিকেটের ‘মহেন্দ্রবাবু’ স্বয়ং কিছু ঘোষণা করেননি। ধোনি সরকারি ভাবে একবারও বলেননি যে, এটাই তাঁর অন্তিম আইপিএল। আবার নয় যে, সেটাও বলেননি। অতঃপর–দোলাচল। যে দোলাচলে দুলছে শহর, ‘শবরীর প্রতীক্ষা’ নিয়ে অপেক্ষা করছে ২৩ মে-র। আবেগের ব্যারোমিটারে যার সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলতে পারে ৫ মে, ২০১২-র। সৌরভ বনাম কেকেআর (KKR) নিয়ে সেই চিরস্মরণীয় ‘বঙ্গভঙ্গে’-র। কেশব বলছিলেন যে, ‘‘হবে না-ই বা কেন? একচল্লিশে এই খেলা ও যে খেলবে, বিশ্বাস করুন ধোনির কোচ হয়েও আমি কোনও দিন ভাবতে পারিনি। গতকাল এসআরএইচের বিরুদ্ধে এমএসের স্টাম্পিংটা দেখলেন? ক্যাপ্টেন্সিটা দেখলেন? ক্ষণজন্মা ক্রিকেটার, ক্ষণজন্মা। ও খেলা ছেড়ে দিলে ওর ব্রেন ম্যাপিং করা দরকার।’’
[আরও পড়ুন: বৃষ্টির ভ্রূকুটির মধ্যেই আজ ইডেনে ভুল শুধরে জয়ে ফেরার লড়াই কেকেআরের]
বাঙালি সব দেখছে। শুনছে। আত্মস্থ করছে। আর শেষে আবেগের হড়কা বানে ঘরের টিমকেই যেন ‘ফুটনোট’ করে চলে যাচ্ছে! আইপিএলের যতই রাশি-রাশি বিস্ময় উৎপাদনের ঐতিহ্য থাকুক অতীতে, ফর্ম বা পরিসংখ্যান এই মুহূর্তে ধোনির চেন্নাইয়ের (CSK) ধারেকাছে নেই কেকেআর। আজ পর্যন্ত আইপিএল-চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টি-সব কিছু মিলিয়ে ২৯ বার দেখা হয়েছে দু’টো টিমের। হলুদ জার্সি জিতেছে ১৮ বার, আর সোনালি-বেগুনি ১১ বার। ইডেন পরিসংখ্যানেও এগিয়ে ধোনি। ন’বারের সম্মুখসমরে চেন্নাই জিতেছে পাঁচ বার, কেকেআর চার বার। কেকেআর বোলিং কোচ ভরত অরুণ তাই কোন যুক্তিতে বলে গেলেন, ‘‘সিএসকে-র বিরুদ্ধে রেকর্ড আমাদের বরাবরের ভাল,’’ কে জানে! সিএসকে-কে হারিয়ে ২০১২ আইপিএল ফাইনাল কেকেআর জিতেছিল বটে। কিন্তু সেটা দশ বছরের পুরনো ঘি। যা দিয়ে বর্তমানে ভাত মেখে খেলে কোনও লাভ নেই।
আর ফর্ম তো না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। টানা তিনটে ম্যাচ হেরে শহরে ফিরেছে কেকেআর। এ দিন প্র্যাকটিসে নেমেছিলেন নীতীশ রানারা। কিন্তু নামামাত্র ছুটকো ধাক্কা খেতে হল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ট্রেনিং ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন আফগানিস্তান উইকেটকিপার-ব্যাটার রহমনুল্লাহ গুরবাজ। মনে হল, হ্যামস্ট্রিংয়ে টান। গুরবাজ এমনিতেও খেলছেন না। পদ্মাপারের লিটন দাস আর বিলেতের জেসন রয় যাচ্ছেন কেকেআরের হয়ে ওপেনিং করতে। কিন্তু যাঁরা খেলবেন, তাঁদের উপরেও নিঃশর্ত ভরসা রাখা যাচ্ছে কোথায়? মহেন্দ্র সিং ধোনির বিরুদ্ধে নাইটদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল পারফরম্যান্স যাঁর, সত্তর বলে যাঁর বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত মাত্র একটা বাউন্ডারি মারতে পেরেছেন এমএসডি–সেই সুনীল নারিনের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়। লোকে বলাবলি করছে, পুরনো নারিন আর নেই। তিনি অতীতের গর্ভে। স্পিনের সেই বিষদাঁতটাই চলে গিয়েছে। বিশ্বাস না হলে, দিল্লির বিরুদ্ধে কোটলা টার্নারে রেকর্ড দেখুন। চার ওভারে চল্লিশের কাছে রান দিয়ে গিয়েছেন নারিন। এ দিন বেশ বিমর্ষ ভাবে একা একা বল করছিলেন ক্যারিবিয়ান রহস্য স্পিনার। ফিরবেন নারিন? পারবেন তিনি পুরনো নারিন হয়ে ধোনিকে আরও একবার নিশ্চুপ করাতে? জানা নেই।
যা জানা আছে তা হল, নারিনের চেয়েও এক ভয়ানক প্রতিপক্ষ রয়েছে আজ রবিবাসরীয় ধোনি-মায়ার সামনে। যার নাম আকাশ, সেই আকাশ- নিঃসৃত বৃষ্টি। হাওয়া রিপোর্ট যা, তাতে বিকেলের দিকে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে রবিবার। ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায় আশ্বস্ত করলেন যে, মুষলধারায় নামলেও পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে খেলা শুরু হবে। কিন্তু আইপিএলের মহাষ্টমীতে কে-ই বা আর বৃষ্টির বিঘ্ন চায়? কে-ই বা চায় কাটছাঁট ম্যাচ দেখতে?
কিন্তু নাহ্। মন বলছে, এ সমস্ত হবেই না। আবেগের শহরে এ সমস্ত কখনও হয় নাকি? লক্ষাধিকের ‘আরাধনা’ মণ্ডপে নামতে পারে নাকি কখনও বৃষ্টি? জলে যেতে পারে নাকি কখনও ইডেনে এমএসডি নামের এক ক্রিকেট-বীরের সম্ভাব্য ‘শেষের কবিতা?’ প্রাণ, প্রাণ, তোমার প্রাণ নাই আকাশ!
[আরও পড়ুন: রবিবার ‘আবর্জনা’র জার্সি পরে নামবেন বিরাটরা, তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে ১৯,৪৮৮টি বোতল]