দক্ষতা সম্পর্কে ভারতের কর্মক্ষেত্রের ভাবনাবোধ স্পষ্ট নয় বলেই, হাসপাতালে মর্গের কাজের জন্যও স্নাতক, ইঞ্জিনিয়ারদের আবেদন করতে দেখা যাচ্ছে! উপায় কী? লিখছেন নীল সরকার।
ভারতের প্রত্যেক নির্বাচনে ঘুরে-ফিরে আসে কতকগুলো সমস্যা। গরিব নাগরিক, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি– এসব থাকবেই। এবারও ছিল। সময়ে-সময়ে সরকার-বিরোধী সমস্ত দলই ইস্তাহারে সেসব সমস্যা সমাধানের আশার কথা শুনিয়ে চলছে প্রজন্ম ধরে। যদিও ক্ষমতায় এসে কিছু বদল ঘটছে কই!
অথচ, ভারতের অর্থনীতি দুনিয়ায় তিন নম্বরে পৌঁছে গিয়েছে। জনসংখ্যায় একে। বিগত ১৩ বছর জনগণনা না-হলেও ধারণা, সেটা ১৪৩ কোটির আশপাশে। সিংহভাগ ১৫-৪৫ বছর বয়সি। ফলে, বেকারত্বের ভয়ংকর দৃশ্যটি আর গোপন নয়। এই সমস্যা সব দেশেই থাকলেও, ভারতে নজির গড়েছে। কেন এমন পরিস্থিতি এবং তা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে?
[আরও পড়ুন: চলতি মাসেই দিল্লি যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, যোগ দেবেন নীতি আয়োগের বৈঠকে!]
দেশের চাকরির বাজারের বড় অংশ রাষ্ট্রের হাতে। রাষ্ট্র কিছু নির্দিষ্ট কাজের যোগ্য নিয়োগ করে বাছাই করে। তবে বর্তমানে রাষ্ট্র বা সরকারি কাজের ক্ষেত্রেও অসংগঠিত ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেড়েছে বিপুল, যা অনেকটাই বেসরকারি চাকরির বাজারের মতো। যেখানে নিয়োগ চলে শিল্পমহলের পছন্দের ভিত্তিতে। এছাড়া সাবেক কাল থেকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে বড় অংশর চাকরি তো আছেই।
দু’-ধরনের কর্মী কাজের বাজারে আসছে। দক্ষ ও অদক্ষ। এখন, উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হচ্ছে। মানবসম্পদের বিনিয়োগ যেহেতু প্রযুক্তির হাত ধরে কমিয়ে এনেছে উন্নত দেশ, তাই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে ভারতেও সেই প্রবণতা প্রাধান্য পাচ্ছে। যে-কারণে, বিনিয়োগ
করা অর্থ কখনওই চাকরি সৃষ্টির নিশ্চয়তা দিচ্ছে না আর।
[আরও পড়ুন: মোদির সঙ্গে বৈঠক শাহের, রাজ্যপালের দ্বারস্থ যোগী, উত্তরপ্রদেশে কি বড়সড় বদল?]
ফলে, এমন জনসংখ্যার দেশ ভারতে, অদক্ষ তো দূর, দক্ষ শ্রমিকের জন্যও কাজ সৃষ্টির সুযোগ নেই বললেই চলে। সেই বিষয়ে বিশেষ কেউ ভাবছে বলেও মনে হয় না। ফলে, শ্রমিক শ্রেণি বেশি রোজগারের আশায় দক্ষিণে বা পশ্চিমে পাড়ি দিচ্ছে। এবং, মানবসম্পদ ও আর্থিক সম্পদের বণ্টন পুরো অসাম্যে ভরে উঠছে।
দক্ষ মানবসম্পদের প্রযুক্তিনির্ভর অংশ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। ফলে, দেশ সেই মেধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উন্নত দেশ আমাদের মেধা ব্যবহার করে সমৃদ্ধ হচ্ছে। ভারতে যারা শিল্পদক্ষ শ্রম বিনিয়োগ করছে, তাদের লক্ষ্য ‘জিডিপি’ ধরে রাখা। তারা রাষ্ট্রের অনুপ্রেরণায় ব্যাঙ্কের আমানতে শিল্প খুলছে। সেই শিল্পের প্রযুক্তি বিদেশের। কারণ, আমাদের গবেষণা বেশ দুর্বল।
এআই ও ৫-জি প্রযুক্তির সময়ে সেই দুর্বলতা প্রকট হওয়ায়, এখন গবেষণায় খাতা খোলা হয়েছে। অনুসারী শিল্পেও দক্ষ মেধা আবশ্যক। কিন্তু, দুর্ভাগে্যর বিষয়, এই দক্ষতা সম্পর্কে ভারতের কর্মক্ষেত্রের ভাবনাবোধ স্পষ্ট নয় বলেই, হাসপাতালে মর্গের কাজের জন্যও স্নাতক, ইঞ্জিনিয়ারদের আবেদন করতে দেখা যাচ্ছে! দেশে আইআইটি পাস করা ৩০ শতাংশ ও আইআইএমের ১০ শতাংশ চাকরির সন্ধানে। অর্থাৎ দক্ষ, প্রযুক্তিবিদ, অদক্ষ সকলেই কাজের বাজারে গ্রহণযোগ্য কাজ পাচ্ছে না।
কারণগুলো যে অজানা বলা যাবে না। চাকরির যোগ্যতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ফারাক তো রয়েছেই, একইসঙ্গে রয়েছে দুর্নীতি। সর্বোপরি কর্মীর জীবন ও জীবনযাপনের মানোন্নয়নের প্রতি দায়িত্ব গা থেকে ঝেড়ে ফেলার প্রবণতা। যার ফলে, বেকারত্ব হয়ে উঠেছে কাজ চলে যাওয়ার আশঙ্কার সঙ্গে সমানুপাতিক। এমন পরিস্থিতিতে, বিপুল জনসংখ্যা যত বাড়বে তত কাজ সৃষ্টি কি আদতেও সম্ভব?
এই বিপুল মানবসম্পদ নিয়ে ভারত কী করবে! অদক্ষ শ্রমিকদের বড় সমস্যা উপযুক্ত মজুরি। যদি দক্ষিণে কেউ ৬০০-৭০০ টাকা রোজ পায়, তাহলে কেন সে এখানে ৩০০-৩৫০ টাকায় কাজ করবে! সব রাজ্যের খরচা করার ক্ষমতা নাগরিকদের এক নয়। এক নয় জিডিপি।
অর্থনৈতিক অসাম্য ডেকে আনছে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে, ভিন দেশে। নদিয়া থেকে আলিপুরদুয়ারে দেখা যাবে কত কত মানুষ ইতালি, জাপান থেকে ইজরায়েলে কাজ করছে নিজেদের উদ্যোগে। অর্থাৎ বাইরে কাজ জুটিয়ে দেওয়ার সংগঠিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা না থাকলেও নিজেদের উদ্যোগে কাজ জুটিয়ে নিচ্ছে বা জুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ।
এমন প্রেক্ষাপটে দেশের মেধা, দেশে ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্র ও শিল্পপতি উভয়কেই ভাবনাচিন্তা করা উচিত, যেহেতু ধনতান্ত্রিক বাজারকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। দরকার লিঙ্গ সাম্য, এবং সেই ভিত্তিতে বেতন বৈষম্যের অবসানও।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
sarkarnil086@gmail.com