শ্রীলঙ্কায় তিন আদিম জনজাতি– রাক্ষস, যক্ষ আর নাগ। কথিত, এই রাক্ষস জনজাতিরই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজা ছিলেন ‘রাবণ’। ইতিহাস বলছে, ভারতের দাক্ষিণাত্যের চোল বংশের রাজা বিজয় পৌঁছলেন শ্রীলঙ্কার যে পশ্চিম তটে, সেখানে যক্ষ জনজাতির বসবাস। এই আরোহণই ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে সিংহলের প্রথম জিনগতসেতু তৈরি করে বলে অনুমান করা হলেও, বিস্ময় ঘটাল সাম্প্রতিক এক গবেষণা! লিখছেন সুমন প্রতিহার।
‘মানুষ’ বলতে তো শুধু হোমো স্যাপিয়েন্সকেই বোঝায় না, রয়েছে আরও অনেক প্রজাতি তবে, এখন তারা বিলুপ্ত। এই ‘হোমো’ গণের সবচেয়ে সফল প্রজাতি হোমো ইরেক্টাস– যারা ২০ লক্ষ বছর প্রকৃতির সঙ্গে সম-অসম লড়াইয়ে বেঁচেবর্তে ছিল। হোমো স্যাপিয়েন্সের বহু আগে এরা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছিল। পৃথিবীর নানা প্রান্তে মাটি খুঁড়ে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তেমনই, বালাংগোড়া মানব– শ্রীলঙ্কার গুহায় যাদের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছিল। প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে বালাংগোড়া মানব শ্রীলঙ্কায় বসবাস করেছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ বিজ্ঞানের হাতে রয়েছে। কারা এই ‘বালাংগোড়া মানব’। বর্তমান শ্রীলঙ্কার অধিবাসীদের জিনের উৎসই-বা কী?
বালাংগোড়া মানুষ মূলত অস্ট্রালয়েড গোত্রের, এর সঙ্গে রয়েছে কিছু নিয়েন্ডারথাল বৈশিষ্ট্যও। আঠেরোশো শতকে সমস্ত মানবপ্রজাতিকে চারটি জাতিতে ভাগ করার রীতি ছিল। ককেশীয়, মঙ্গোলয়েড, নেগ্রোইড আর অস্ট্রালয়েড। পশ্চিমের গবেষক ছাত্ররা জাতি ও বর্ণগতভাবে মানুষকে বিভাজনের পক্ষে জোরাল সাওয়াল করেন। ইংরেজদের ভারত শাসনের অন্যতম চাবুক ছিল আগাগোড়া ভুল এই ধারণা। মানব জিন মানচিত্র প্রকাশে জাতিগত বিভাজনটা হাস্যস্পদ হয়ে পড়ে। ২০১৯-এ ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ বায়োলজিক্যাল অ্যানথ্রোপোলজিস্ট’-দের পক্ষে বেশ কড়া বিবৃতি জারি করে জাতিগত মানব বিভাজনকে অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক, মানব সমাজের পক্ষে চূড়ান্ত ক্ষতিকর ঘোষণা করে।
বালাংগোড়া মানবদের খুলির হাড় ছিল মোটা, অক্ষিকোটরের উপরের হাড়টি স্পষ্ট, থ্যাবড়ানো নাক, শক্তপোক্ত চোয়াল, বড় দঁাত। মানুষগুলোর ঘাড় বলতে বিশেষ ছিলই না। অত্যন্ত চতুর শিকারি ছিল বালাংগোড়া মানব। শিকারের জন্য তারা সম্বর হরিণের শিং থেকে বানিয়েছিল ধারালো ছুরি, হাতির পায়ের হাড় থেকে তৈরি করেছিল হাত-কুঠার। এছাড়াও ছিল পাথরের অস্ত্র। বসতি ছিল সমুদ্র থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। কুকুর গৃহপালিতকরণ থেকে আগুনের ব্যবহার– জানত তারা সবই।
শিকারের মাংস যে সবক্ষেত্রে পুড়িয়ে খেত এমনটাও নয়, কঁাচা খাওয়ার প্রমাণও রয়েছে। বর্তমান সিংহলি মানুষদের তুলনায় বালাংগোড়া মানব ছিল উচ্চতায় প্রায় সাত সেন্টিমিটার বেশি। কিন্তু, এই তথ্য একদমই সাম্প্রতিকের। কিছু মাস আগেও শ্রীলঙ্কার নৃতত্ত্ব ও পুরাণ মিশিয়ে ইতিহাস ছিল অন্যতর। তা অনেকটা এরকম– শ্রীলঙ্কায় তিন আদিম জনজাতি গোষ্ঠী– রাক্ষস, যক্ষ আর নাগ। সাড়ে তিন হাজার বছরেরও প্রাচীন এদের মিলেমিশে বসবাস। প্রসঙ্গত, এই গোষ্ঠী নামকরণ মূলত হয়েছিল দেবতাকে পূজা বা মান্য করার
নিরিখে। আর, দেবতার পূজাপাঠ করত না বলেই, রাক্ষস গোষ্ঠী এহেন নাম পেয়েছিল। কথিত, এই রাক্ষস জনজাতিরই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজা ছিলেন ‘রাবণ’। রাবণ এতটাই মহিমান্বিত ছিলেন যে, ভারতের প্রাচীনতম মহাকাব্যে তঁার দুর্দান্ত উপস্থিতি।
[আরও পড়ুন: ‘চ্যালেঞ্জের মুখে ব্র্যান্ড মোদি’, লোকসভা নির্বাচন নিয়ে চাঞ্চল্যকর ভবিষ্যদ্বাণী প্রশান্ত কিশোরের]
উপকথা আরও বলবে, এই জনজাতিদের অবস্থানকালেই গৌতম বুদ্ধ প্রথম পদার্পণ করেন শ্রীলঙ্কায়। তঁার সেই যাত্রায় যক্ষদের জ্ঞান দান করার প্রমাণ রয়েছে। যদিও তারা বিন্দুমাত্র উৎসাহিত হয়নি, মজেনি বুদ্ধং শরণংয়ে। তাদের স্বভাবোচিত বৈশিষ্টে্যই তারা আটকে থাকে। দ্বিতীয়বার শ্রীলঙ্কা যাত্রায় গৌতম বুদ্ধ নাগ জনগোষ্ঠীর রত্নশোভিত মুকুট নিয়ে দুই ভাইয়ের বিবাদ সমাধান করে জ্ঞান দান করেন। ঐতিহাসিক কী সমাপতন, গৌতম বুদ্ধর মৃত্যুদিনেই ভারতের দাক্ষিণাতে্যর চোল বংশের রাজা বিজয় তঁার সাতশো সহযোগী নিয়ে পৌঁছলেন শ্রীলঙ্কার পশ্চিম তটে, ঠিক যেখানে যক্ষ জনজাতির বসবাস। এবং, কালের খেয়ালে সেই জনজাতির প্রধানের কন্যা কুভেনির সঙ্গে প্রণয়পাশে জড়িয়ে পড়ছেন রাজা বিজয়।
বহমান এই ইতিহাসে, বুঝতে অসুবিধা হয় না, চোরাস্রোত হয়ে দু’টি ভিন্ন ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর মধে্য জিনেরও আদানপ্রদান ঘটে যাচ্ছে। আর, সূক্ষ্মভাবে বদলেও যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার মানব-বৈশিষ্ট্য! আন্দাজ করাই যায়, এই প্রথম শ্রীলঙ্কার অন্যতম আদিম জনজাতির অভ্যন্তরে ভিন্ন জিনের প্রবেশ। কিন্তু, শুধু ঐতিহাসিক নয়, বিজ্ঞানভূত প্রমাণও যে চাই!
২০২৪– অর্থাৎ চলতি বছরের একটা গবেষণাপত্রে অনেকটাই খোলসা হয়েছে শ্রীলঙ্কার মানব-বৈচিত্রের ইতিহাস। গুহা থেকে পাওয়া বালাংগোড়া কঙ্কালগুলোর মাপজোক করে দেখা গেল, জৈবিকভাবে বালাংগোড়া মানবদের সঙ্গে বর্তমান শ্রীলঙ্কার আদিমতম জনজাতি ভেড্ডা-র বেশরকম মিল। এই ভেড্ডা জনজাতি আনুমানিক ২,৮০০ বছরেরও প্রাচীন। ইতিহাস আরও বলছে, রাজা বিজয় ও কুভেনির দুই সন্তানের সঙ্গে এই জনগোষ্ঠীর সংযোগ রয়েছে। রাজা বিজয় তঁার দুই সন্তানের মুখশ্রীতে যক্ষগোষ্ঠীর বিপুল মিল পাওয়ার পর, প্রত্যাখ্যান করেন তাদের। এমনকী নিজের এহেন উত্তরাধিকারের ভবিষ্যৎ মুছে ফেলতে তাদের হত্যারও চেষ্টা করেন। সেই সময় শ্রীলঙ্কার অন্য প্রান্তে পালিয়ে বঁাচে সেই দুই সন্তান। কিন্তু, আশ্চর্যান্বিত হওয়ার সূত্রপাত এবার!
ভেড্ডা জনজাতির সঙ্গে বর্তমান সিংহলি ও তামিলদের যতটা না মিল, তার চেয়ে ঢের বেশি মিল ভারতের পঁাচ আদি জনজাতির! মিলন ও তদ্পরবর্তী জিন সংশ্লেষ ব্যতীত এ তো প্রায়াসম্ভব! বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্সের অধ্যাপক জ্ঞানেশ্বর চৌবে, ‘সেন্টার ফর সেল অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি’-র প্রফেসর থঙ্গরাজ, কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের রুওয়ান্দি রানাসিংয়ের যৌথ গবেষণা ‘মাইট্রোকন্ডিয়ন’ জার্নালে প্রকাশিত হতে জানা গেল এই চমকে দেওয়া সাদৃশ্য। বর্তমান শ্রীলঙ্কায় সিংহলি, তামিল আর ভেড্ডা জনজাতি দীর্ঘ দিন প্রতিবেশী থাকলেও অদ্ভুত জেনেটিক দূরত্ব বজায় রেখেছে। অথচ, ভেড্ডার সঙ্গে মিল ভারতীয় সঁাওতাল মুন্ডা, ওড়িশার জুয়াং, কর্নাটকের ইরুলা, কেরলের পানিয়া আর তামিলনাড়ুর পালার জনজাতির। সিংহলিদের সঙ্গে তামিলদের জেনেটিক্যালি আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হলেও ভেড্ডারা
নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। এবং, প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে বালাংগোড়া মানুষদের থেকেই এখনকার শিকারি জুগাড়ু ‘ভেড্ডা’-র উৎপত্তি। ভেড্ডার ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা, মিল নেই আর কারও সঙ্গে। ঠিক যেমন মধ্য ভারতের নিহালি আর নেপালের কুসুন্ডা। আফ্রিকা ছেড়ে আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষেরা ভারতে এসে পৌঁছয় প্রায় ৫৫ হাজার বছর আগে। আদিম সেই জনগোষ্ঠী থেকেই সময়ের সঙ্গে ভেড্ডা, মুন্ডা, ইরুলা, পানিয়া, পালার পৃথক হয়েছে। যে-জনগোষ্ঠী ৫৫ হাজার বছর আগে ভারতে পৌঁছেছিল, সম্ভবত তাদের অস্তিত্বের কথাই আমরা জানতে পারি ৪০ হাজার বছর আগে শ্রীলঙ্কায় বালাংগোড়া মানব হিসাবে।
[আরও পড়ুন: বড় পরিবার, সদস্য সংখ্যা কমাতে ২ সৎ বোনকে ‘খুন’ নাবালিকা দিদির!]
সিংহলিদের শ্রীলঙ্কায় আগমন ৭০০ থেকে ৯০০ বছর আগে, আর প্রায় ৫০০ বছর আগে চোলদের হাত ধরে ভারতীয় তামিলরা শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করে। জাতিগত, ভাষাগতভাবে পৃথক হলেও তাদের সাংঘাতিক মিল! শ্রীলঙ্কার ইরানামাডু অঞ্চলে মাটির তলায় মিলেছিল তিন লক্ষ বছর আগের প্রস্তর যুগের মানুষের প্রমাণ। এক লক্ষ ২৫ হাজার বছর আগের কোনও এক মানব গোষ্ঠীর ব্যবহৃত স্ফটিক ও চুনের সামগ্রীর হদিশও মিলেছে। তারা কিন্তু হোমো স্যাপিয়েন্স নয়। তারা-ই মানবগণের সবচেয়ে সফল প্রজাতি ‘হোমো ইরেক্টাস’! সেখানেই কি নিহিত তবে পুরাণ ও বিজ্ঞানের হাত-ধরাধরি করা সমাপতন?
আগামী গবেষণার দিকে আমরা তাকিয়ে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক
pratihar_vu@rediffmail.com