চেখভ থেকে কামু-র নাটক পড়ে অভ্যস্ত আমার মনে প্রশ্ন উঠেছিল, এই পাঠ কি আমাকে দেশের মানুষের মর্মে পৌঁছে দেবে? বাঁক বদল করি। যেভাবে প্রসেনিয়ামে সফল হয়েও বাদল সরকার সন্ধানী হয়েছিলেন ‘তৃতীয় ধারার নাট্য আন্দোলন’-এর প্রতি। লিখছেন মহেশ এলকুঞ্চওয়ার।
বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ আর আমার ‘গার্বো’ নাটকটির মধ্যে অদ্ভুত এক রহস্যময় মিল রয়েছে। এটা কী করে ঘটল, বলা কঠিন। ‘গার্বো’ লেখা হয়েছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে। এ-কথা ঠিক যে, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ তার পঁাচ-ছয় বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে বাংলায়। নাটকটির ইংরেজি বা অন্য ভাষায় অনুবাদ সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু জানা ছিল না। বাদল সরকার সম্পর্কে আমি কিছু-কিছু বিষয় ইতোমধ্যে জেনেছিলাম পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে। গিরিশ কারনাডের বিখ্যাত ইংরেজি অনুবাদটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। ফলে, ‘গার্বো’ রচনার সময়ে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর কোনও অনুষঙ্গ আমার ভাবনায় থাকা এক অর্থে অসম্ভব ছিল। তাছাড়া, আমি বাদলবাবুর কোনও লেখাই সে-সময়ে পড়ে উঠতে পারিনি। এরপর ১৯৭৩ সালে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘গার্বো’ নাটকটি। এই সময় বোধহয় আমি বাদলবাবুর লেখা পড়া সবে শুরু করেছি। তা সত্ত্বেও মানতে হবে, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ এবং ‘গার্বো’-র মধ্যে আশ্চর্য মিল রয়েছে! প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও নাট্য-চিন্তক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এ-বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বাদলবাবু কাজ করছেন দেশের পূর্ব প্রান্তে, আমি পশ্চিমে। আমাদের ভাষা ভিন্ন, নাটক দেখা বা নাট্য-ভাবনার পরিসর একেবারেই আলাদা। বাদলবাবু আমার অগ্রজপ্রতিম পূর্বসূরি। আমি একটা সময়ে বিজয় তেন্ডুলকরের নাটক দেখে বড় হয়েছি। আমার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মারাঠি নাটকের পরম্পরা। ফলে
চিন্তা-ভাবনার পরিসরও একেবারেই ভিন্ন। অথচ, দুই নাটকের মিল অনস্বীকার্য।
যে-সময়ে এই লিখন-প্রক্রিয়া চলছে, সে বাদলবাবুই লিখুন, তেন্ডুলকর লিখুন বা আমিই লিখি, সেই সময়ের তীব্র তাপপ্রবাহ স্পর্শ করেছে আমাদের প্রত্যেককে। দিকে-দিকে সে-সময় জ্বলছে ক্রোধের আগুন। আবার, হতাশার অসহনীয় যন্ত্রণা ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে এক প্রজন্মকে। ভেবে দেখুন, তেন্ডুলকরের ‘সখারাম বাইন্ডার’-এর প্রচণ্ড চাপ বহন করছে মারাঠি রঙ্গমঞ্চ। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছে ১৯৭২ সালে, এবং নিষিদ্ধ হয়েছে ঠিক দু’-বছর পর, অর্থাৎ ১৯৭৪-এ। একদল তরুণ তাদের স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে আলোড়িত। একটা নবীন
non-conformist প্রজন্ম প্রবলভাবে সাড়া দিচ্ছে। আমি নিজেকে মনে করি সেই প্রথম দিকের non-conformist generation-এর একজন প্রতিনিধি। সমাজের ঘেরে-ঘোরে প্রচলিত কতগুলি ধারণাকে সর্বজনীন বলে মেনে নিতে চাইছে এই প্রজন্ম। বরং, তাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ দেখছে দেশবাসী। ১৯৬৭ সালে বাংলায় নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান। ১৯৬৮-র মে মাসে, প্যারিসের সোর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তাল ছাত্র আন্দোলন। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে ফরাসি দেশে। ক্রমশ দেশে-বিদেশে নানা জায়গায়। অস্তিত্বের সংকট এবং অস্তিত্ববাদ তখন আমাদের সামনে নানা প্রশ্ন নিয়ে উপস্থিত। আমি নিজে তখন অস্তিত্ববাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।
স্বাধীনতার পরে এক দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। ’৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধ। ১৯৬৪-তে জওহরলাল নেহরুর প্রয়াণ। তরুণদের একদল বামপন্থায় আকৃষ্ট হয়ে পথ চলেছিলেন। ১৯৬৪-তে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন। ফলে মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আস্থা– এই শব্দগুলো তখন অনেকাংশেই নড়বড়ে।
আমরা তখন নানা প্রচলিত বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করছি। ‘গার্বো’-তেও দেখা যাবে– ইন্টাক, প্যান্সি, শ্রীমন্তরা কথা বলছে প্রায় ভিন্ন ভাষায়। তাদের হাতে কালো কফি বা বিয়ার। তারা প্রশ্ন করছে যৌনতা ও সমাজের নানা বিষয়কে। এই ‘non-conformist’ প্রজন্ম ঘাড় থেকে শিখিয়ে দেওয়া কথার ভার নামিয়ে দিতে চাইছে। তারা মুক্ত পরিসরের দিকে আগুয়ান। তবে তারা নিশ্চিতও নয় যে, এই ‘liberal space’ বা স্বাধীনতা আদতে তাদের কোন কাজে আসবে। আগামী সম্পর্কেও তারা যে খুব স্পষ্ট, এমন নয়। কিন্তু শূন্যে প্রলম্বিত জিজ্ঞাসা–
উঠে আসছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এও, সকলে করে বলে সকলকে একইভাবে তা-ই করে যেতে হবে– এই নিয়ে তীক্ষ্ণ বক্রোক্তি। ইন্দ্রজিৎ-মানসীর প্রেম কখনও মনে হয় অবশ্যই এক নির্ধারিত পরিণতির দিকে যাবে। কিন্তু আবার দেখা যায়, ইন্দ্রজিৎ-মানসী সেই আবর্ত-ছঁাদেই ধরা দিয়েছে। আবার
মনে হয়, ধরা দেয়নি। কোনও ‘নির্ধারণবাদ’-কে (determinism) তারা মানতে অপারগ। ফলে, নতুন সম্ভাবনা। কিন্তু তার স্বরূপ কারও জানা নেই। তাই, তীর্থ নয়, তীর্থ পথ আমাদের। ‘গার্বো’-র সঙ্গে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর অমিলও বিস্তর। সেগুলো নিয়েও ভাবতে হবে।
এখানে আমি বলতে পারি, আমার অজান্তেই ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এরই যেন ক্রমসম্প্রসারণ ঘটল ‘গার্বো’ নাটকে। সেদিক থেকে, আমি বাদলদার উত্তরসাধক। ছয়ের দশকের ক্রোধ বা angst-কে আমি বহন করলাম সাতের দশকের দিনগুলিতে– so in a way I am the rightful heir of Badal babu. ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র আমি। যখন চেখভ, স্ট্রিন্ডবার্গ, লোরকা—– এঁদের লেখা পড়ছি, তখনও আমি থিয়েটারে যুক্ত নই। সাহিত্য ভালবেসেই আমি ক্রমাগত পড়ছি এরকম বহু লেখা। নিতান্তই সাহিত্যের পাঠক হিসাবে এসব পড়াশোনা। নাটকও যে সাহিত্যের বিশেষ অঙ্গ, এই বিষয়টি নাট্যজগতের বহু মানুষ বিস্মৃত হন। এর ফলে বহু সমস্যা দেখা গিয়েছে। অন্তত আমার চোখে পড়েছে। আমাদের সময়ে ইউরোপ নিঃসন্দেহে hyper-real। মার্কিন নাট্যকারদের মধ্যে ইউজিন ও’নিল, টেনিসি উইলিইয়াম্স, আর্থার মিলার ব্যতীত আর কারও লেখা নিয়ে আমি তেমন ভাবিত হইনি। ইউরোপীয় নাটকের ঐতিহ্য আমাকে বারবার প্রাণিত করেছে। আমি ফিরে ফিরে পড়েছি আলবেয়ার কামু, ইবসেন, জঁ আনুই– এঁদের লেখা। আবারও বলছি, সাহিত্য হিসাবেই পড়েছি। ফ্রান্সের সাহিত্য যা পাচ্ছি পড়ার চেষ্টা করছি।
জঁ-পল সার্ত্রের ‘Being and Nothingness’ অথবা কামু-র ‘The Rebel’ আমার নিত্যসঙ্গী। নাটক-রচয়িতা হিসাবে এই সাহিত্যপাঠের প্রভাব আমার এক পর্বের নাটকে ছত্রে-ছত্রে রয়েছে। এই সময় আমি ভাবছি, আমাকে অন্য পথে যেতে হবে। এভাবে কি বলতে পারব, আমার দেশের মানুষের মর্মকথা? ভারতীয় দর্শন, নন্দনতত্ত্ব তখন আমাকে ক্রমশ ঘিরে ফেলছে। এ-দেশের আখ্যান-উপাখ্যান, লোকনাট্যের নানা পরম্পরার উদ্যাপনে আমি তখন মরিয়া।
অন্যদিকে দেখুন, গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষ পর্বে বাদলবাবু সম্মানিত হচ্ছেন দেশজুড়ে। অথচ সেই সময় তঁাকে ভাবতে হচ্ছে, কোন পথে তিনি পৌঁছতে পারবেন দেশবাসীর মর্মস্থলে। তঁাদের জীবন-যন্ত্রণার কথা বলবেন কোন প্রকরণে। এই সময়ে তিনি যেন হয়ে উঠেছেন শিকড়-সন্ধানী। তঁার ‘তৃতীয় ধারার নাট্য
আন্দোলন’-কে আমি এভাবেই দেখি। তিনি চাইছেন গ্রামে-গঞ্জের মানুষের কাছে থিয়েটারকে নিয়ে উপস্থিত হতে। দেশের মানুষের কথা সোচ্চারে বলতে তখন তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই দেশেও যে লোকনাট্যের বিভিন্ন ধরন আছে, তার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে বাদলবাবুর তৃতীয় ধারার থিয়েটারের। এই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে তিনি যেন ছুঁতে চাইছেন মানুষের অন্তর। সরাসরি সংযোগের কথা বলছেন। দর্শক-অভিনেতা এবার এসে পড়েছে একই তলে, একেবারে মুখোমুখি। নতুন এক পরিসর সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন বাদলবাবু, দেশের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে ঘুরে। ভাবার বিষয়, এই বাদলবাবুই রচনা করেছেন ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সারা রাত্তির’, ‘পাগলা ঘোড়া’ কিংবা ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর মতো আশ্চর্য সব নাটক।
স্বীকৃতি, সম্মান তিনি প্রসেনিয়াম পর্বে কিছু কম পাননি। আর আমরা আমরা দেখেছি, অধিকাংশ শিল্পী নিজেরই মুদ্রাদোষে নিজেকে বারবার একইভাবে উপস্থাপন করে চলেন। বাদলবাবু এড়িয়ে গেলেন সেই ফঁাদ। নিজের পুনর্নবীকরণে তখন তিনি নিয়োজিত। এই দেশের বাস্তবতাকে, মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামকে তিনি ধরে রাখছেন তঁার এই পর্বের নাটকে। এই প্রচণ্ড সাহস কিংবা দায়বদ্ধতা অভাবনীয়। এক্ষেত্রেও আমি তঁার উত্তরসূরি, কারণ আমিও নাটক রচনার সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি তার কিছু পরে। এভাবেও, বাদলবাবুর পরোক্ষ-প্রভাব দেখা যাবে আমার চিন্তায়।