shono
Advertisement
Durga Puja

সেবার বাগবাজার সার্বজনীনের সভাপতি সুভাষচন্দ্র বলেন, ‘দেশমাতৃকা’-র পুজোর জন্য চাই ত্যাগ

কুমারটুলি সার্বজনীন’ও আমন্ত্রণ করে সুভাষচন্দ্র বসুকে পুজোয় অংশ নেওয়ার জন্য।
Published By: Kishore GhoshPosted: 02:48 PM Oct 05, 2024Updated: 02:48 PM Oct 05, 2024

‘কুমারটুলি সার্বজনীন’ আমন্ত্রণ করে সুভাষচন্দ্র বসুকে পুজোয় অংশ নেওয়ার জন্য। তাঁর আপত্তি ছিল। পরে, যখন যোগ দিলেন, পুজো কমিটি ভেঙে যায় দু’ভাগে। ‌‘বাগবাজার সার্ব্বজনীন’, ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’-র পুজোতেও জড়িত ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৮৮০ সালে পুজো করেন প্রেসিডেন্সি জেলে বসে। লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Advertisement

‘সুভাষচন্দ্র দেবী দুর্গার সংসার ভাঙলেন’। এটাই ছিল ১৯৩৮ সালের দুর্গাপুজোয় কলকাতার খবরের কাগজের সংবাদ শিরোনাম। বিষয়টা এরকম–দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন কলকাতা পুরসভার কমিশনার। বাড়ি উত্তর কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে। দুর্গাচরণের বাড়িতে যাতায়াত ছিল সুভাষচন্দ্রর। সেই সুবাদে ঘনিষ্ঠতা তাঁর দুই ছেলে– জগদ্ধাত্রীকুমার আর শচীন্দ্রকুমারের সঙ্গে। দুই ভাই তখন ‘কুমারটুলি সার্বজনীন’-এর সঙ্গে যুক্ত। দু’জনেই এসে ধরলেন সুভাষকে। অনুরোধ, তিনিও এই পুজোতে যুক্ত হোন। প্রাথমিকভাবে, এ প্রস্তাবে প্রবল আপত্তি ছিল সুভাষচন্দ্রর। কারণ, ‘স্যর’ হরিশংকর পাল এই পুজোর সভাপতি। ১৯৩২ সালে তিনিই এই পুজো শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে আবার ব্রিটিশ প্রশাসনের উপরমহলের দারুণ দহরম-মহরম। সেই সুবাদেই ‘স্যর’ উপাধি-প্রাপ্তি। এতেই তাঁর আপত্তি। তাই পাশের সর্বজনীনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকলেও কুমারটুলি নিয়ে তাঁর ভীষণ অ্যালার্জি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাগবাজারের পুজোর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রর যোগসূত্রও কিন্তু জগদ্ধাত্রী আর শচীন্দ্রর বাবা, সলিসিটর দুর্গাচরণ। তাঁর ব্যবস্থাপনায় ‘বাগবাজার সার্ব্বজনীন’ স্বদেশি শিল্প, পুজো আর উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে বাগবাজার সার্বজনীন হয়ে ওঠে ‘বাগবাজার সার্ব্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী’। সেই বদলের বিন্যাসেই জড়িয়ে পড়েন সুভাষচন্দ্র। কিন্তু হরিশংকর পালের মতো ব্রিটিশের ধামাধরা লোক থাকলে সেই পুজোয় সুভাষ থাকবেন না, এ তাঁর স্পষ্ট সিদ্ধান্ত। কুমারটুলি পুজো কমিটিতে গোলমাল বেধে গেল। জগদ্ধাত্রী আর শচীন্দ্রর মতো যুবকের সঙ্গে হরিশংকর পালের অনুগামীদের। ভাগ হয়ে গেল পুজো। পাশাপাশি দুটো পুজো। একটা আদি পুজো। সভাপতি হরিশংকর।

আর-একটা নবীনদের পুজো। সভাপতি সুভাষচন্দ্র। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল পঞ্চমীর রাতে। আকস্মিক অগ্নিদুর্ঘটনা। মণ্ডপ পুড়ে ছাই। প্রতিমা ক্ষতিগ্রস্ত। উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত। সমস্যা সমাধানে পূর্ণ উদ্যমে ময়দানে নামলেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর কাছে দুর্গাপুজো নিছক পাঁচ পুজো নয়। সেই ১৯১৭ সাল থেকে ‘দেশি পুজো পার্বণের মধ্যে দিয়ে দলকে গড়ার এক পরীক্ষায়’ নেমেছেন তিনি। বুঝে ফেলেছেন, ধুমধাম হলে প্রচুর লোকের উৎসাহ বাড়ে। স্বদেশি বোধ ছড়াতে সেটাই তো দরকার। তাই পুজোতে সুভাষের দারুণ উৎসাহ। তত দিনে বিলেত ঘুরে কুমারটুলি পাড়ায় নিজের স্টুডিও খুলে বসেছেন কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পাল ওরফে জি. পাল।

তিনিই তখন কলকাতার আলো জ্বালানো ভাস্কর। ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের ভাষায় ‘দ্য লাইটেনিং স্কাল্পটর’। ঘূর্ণিতে ছোটলাটের চোখের সামনে মাটির তালকে বদলে দিয়েছিলেন দুর্গাপ্রতিমায়। ‘গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ’-এর অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের উদ্যোগে বিলেতে যান। ‘ডিউক অফ কনটের’-এর চোখের সামনে তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে মাটির মূর্তি গড়ে দিয়েছিলেন পাঁচ মিনিটে। বিলেতের কাগজ ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ লিখেছে, জি. পাল নিছক মৃৎশিল্পী নন, তিনি হলেন ‘দ্য লাইটেনিং স্কাল্পটর’। সোনার পদক পেয়েছেন। এখন স্টুডিও কুমারটুলিতে। তাঁকেই ধরলেন সুভাষচন্দ্র।

পরদিন দেবীর বোধন। এক রাতের মধ্যে গড়ে দিতে হবে মাতৃপ্রতিমা। দেখাতে হবে জি. পালের ম্যাজিক। গোপেশ্বর রাজি হলেন। রাতারাতি প্রতিমা গড়ে দেবেন তিনি। তবে একচালায় সপরিবার দুর্গাকে গড়ে তোলা এক রাতের মধে‌্য সম্ভব নয়। একাধিক শিল্পীকে কাজে লাগাতে হবে। পাঁচটি পৃথক-পৃথক চালায় তৈরি হবেন দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশ। তা-ই হল। পাশাপাশি পুরনো রীতির ঘোড়ার মাথাওয়ালা সিংহের বদলে গড়লেন কেশরযুক্ত সিংহ। তাক লেগে গেল মানুষজনের। বাংলা খবরের কাগজ ঠাট্টা করে যাই লিখুক, জনসাধারণ গ্রহণ করল এই শিল্পরীতি। সুভাষচন্দ্রর হাত ধরেই এক চালচিত্র থেকে দেবীপ্রতিমার পাঁচটি পৃথক চালচিত্রে বিবর্তন।

ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতনে আর-একটি সর্বজনীন পুজো, যেখানে একচালা প্রতিমার বদলে পাঁচচালা দেবীপ্রতিমা পূজার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন সুভাষচন্দ্র। তবে সেই প্রতিমা পরিকল্পনার নেপথ্যে তাঁর ভূমিকা ছিল না। সেখানে প্রতিমার পরিকল্পনা বিবেকানন্দর ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তর। সেই পুজোর নাম ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’-র। পুজোর প্রবর্তক জোড়াবাগানের বসু বাড়ির ছেলে অতীন্দ্রনাথ বসু। ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর বিপ্লবী। অরবিন্দ ও বাঘাযতীন ঘনিষ্ঠ। প্রতি বছর সেখানে বসত ‘স্বদেশী মেলা’। পালিত হত বীরাষ্টমী ব্রত।

এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগীর যতীন্দ্রনাথ গুহ, যিনি ‘গোবর গোহ’ নামে সমধিক পরিচিত। এই গোবর গোহ, অতীন্দ্র বসু প্রমুখের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯২৮ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন অন্য মাত্রা পেয়েছিল। ওই অধিবেশনে সুভাষকে গুরুত্বহীন করার জন্য স্রেফ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর, তাতেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সুভাষ– ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’-র লোকজনের সহায়তায়। সেবার পার্ক সার্কাসে বসেছিল জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন। অধিবেশন-শেষে সেই বিরাট মণ্ডপে বসেছিল দঙ্গল, পেশাদারি কুস্তি প্রতিযোগিতার আসর। মূল আকর্ষণ বাংলার গোবর গোহের সঙ্গে পাঞ্জাবের ছোট গামার লড়াই।

সে-লড়াই দেখতে কলকাতা ভেঙে পড়েছিল। ১৯৩০ সালে ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’-র প্রথম সর্বজনীন পুজো কমিটি, ডেকে এনে, সুভাষচন্দ্রকে সভাপতির দায়িত্ব দেয়। ১৯৩৯ সালে নতুনভাবে পুজোতে প্রতিমার বেদিবিন্যাস সম্পন্ন হয়। বেদি রইল একটাই, কিন্তু একই বেদিতে পঁাচটা আলাদা-আলাদা চালচিত্র, আর সেগুলোতে আলাদা-আলাদা প্রতিমা। ৫০ ফুটের বেশি। প্রতিমার দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট। প্রতিমাশিল্পী নিতাই পাল। পরিকল্পনা, পূর্বেই উল্লিখিত, মহেন্দ্রনাথ দত্তর। ডাকের সাজ তখন আসত বিদেশ থেকে। তাই ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’-র দেবীপ্রতিমায় মাটির গয়না পরতেন দেবী। পরনে খাদির কাপড়। প্রতিমার আবরণ উন্মোচন করলেন সুভাষ। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ সেই প্রতিমা দেখে লিখল, ‘অপূর্ব বর্ণচ্ছটায় রঞ্জিত সুদৃশ্য দেবী প্রতিমা দর্শকগণের চিত্ত ও নয়নকে যুগপৎ মুগ্ধ করে। দেবীর ত্রিনয়ন হইতে যেন অজস্র করুণা ধারা ঝরিয়া পড়িতেছে।’ সেবারই ওয়ারধা কংগ্রেস অধিবেশনে সুভাষের সঙ্গে কংগ্রেসের তীব্র মতবিরোধ। পরিণতিতে কংগ্রেস সুভাষচন্দ্রর উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করল। তাতে কিন্তু ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’-র পুজোর কর্মসূচিতে বদল এল না। গুয়াহাটি থেকে ফিরে, প্রতিমার আবরণ উন্মোচন করেন, সুভাষ। অন্নকূট উৎসবে মেজদা শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে মাটিতে বসে প্রসাদ খান।

আরও একটি সর্বজনীন দুর্গোৎসবে জড়িত ছিলেন সুভাষচন্দ্র, যেখানকার প্রতিমা কলকাতার তখনকার আর-পঁাচটা বারোয়ারির মতো একচালা ছিল না। মধ্য কলকাতার ‘৪৭ পল্লী’-র পুজো। ১৯২৯ সালে এই পুজোর শুরু। প্রথম বছরেই প্রতিমার উদ্বোধক সুভাষচন্দ্র। তাঁকে দেখতে পুজো প্রাঙ্গণে ব্যাপক ভিড়। এখানে প্রতিমা মহিষাসুরমর্দিনী নন। অকালবোধনের মূর্তি। সেজন্য মাতৃমূর্তির পাশে অনুপস্থিত লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশ। তার জায়গায় উপস্থিত শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষ্মণ, বিভীষণ। কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণ’-এর অকালবোধনের কুশীলবরা। পরবর্তী সময়ে এই পুজো গোপাল মুখোপাধ্যায় ওরফে ‘গোপাল পঁাঠার পুজো’ নামে খ্যাত হয়। ‘বাগবাজার সার্ব্বজনীন দুর্গোৎসব’-এর সঙ্গে সুভাষের সংযোগ তঁার কলকাতার মেয়র পদে থাকার সময় থেকে।

১৯৩৬ সালে এই পুজোর অঙ্গ হল ‘বীরাষ্টমী উৎসব’। উদ্যোক্তা রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি সরলা দেবী। এই বীরাষ্টমী উৎসবেই পূজাপ্রাঙ্গণে লাঠিখেলা থেকে শরীরচর্চার প্রদর্শন। দু’-ঘণ্টা অনুষ্ঠান দেখলেন সুভাষ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘কাপুরুষতা, ভীরুতা সব মায়ের চরণে অর্পণ করে দেশমাতৃকার পূজার জন্য তৈরি হতে হবে। সে পূজার জন্য প্রয়োজন শুধু ত্যাগ।’ সেবার বাগবাজারের পুজোর সভাপতি ছিলেন না সুভাষচন্দ্র। সেবার শুধু পরিসমাপ্তি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়  তাঁকে। সভাপতি হলেন ১৯৩৮ এবং ’৩৯ সালে। ১৯৪০ সালে পুজোর সময় তিনি প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি। সেখানেই পুজো করেন। আর, ১৯৪১ সালে তো মধ্যরাত্রে মহানিষ্ক্রমণ।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
debashispathak@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • বাগবাজারের পুজোর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রর যোগসূত্রও কিন্তু জগদ্ধাত্রী আর শচীন্দ্রর বাবা, সলিসিটর দুর্গাচরণ।
  • ১৯৩৬ সালে এই পুজোর অঙ্গ হল ‘বীরাষ্টমী উৎসব’।
Advertisement