ভারতের সাংস্কৃতিক চেতনা প্রকৃতিকে পুজো করে– নদী দেবী, বন পবিত্র এবং পশুরা
দেবতার বাহন। কিন্তু যখন শহরগুলি জেগে ওঠে এবং শহুরে বিস্তার গ্রামীণ এলাকা গ্রাস করে–
এই আধ্যাত্মিক বন্ধন ভেঙে পড়ে, পিছনে রেখে যায় এমন এক বিশৃঙ্খল পরম্পরা, যা পরিবেশগত সচেতনতা হারিয়েছে। লিখছেন স্বাগতম দাস।
বটগাছের কথা ভাবুন—– দৃঢ় এবং স্থিতিশীল। এর শিকড় মাটিতে গভীরভাবে প্রোথিত, অথচ এর শাখাগুলি উঠেছে আকাশের দিকে। শতাব্দীর-পর-শতাব্দী ধরে ভারত এই ছবিটির প্রতীক হয়ে দঁাড়িয়েছে– একটি দেশ, যা প্রকৃতির প্রতি আধ্যাত্মিকভাবে নিবেদিত, আবার একই সঙ্গে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য ছুটছে। কিন্তু এই রূপকের নিচে লুকিয়ে রয়েছে এক নিদারুণ অন্তর্দ্বন্দ্ব: নদীর কান্না, জঙ্গলের শ্বাসরোধ এবং ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশের আর্তনাদ। ‘ইকো সাইকোলজি’, পরিবেশ দূষণ, এবং রাজনীতি এখানে একে-অপরের সঙ্গে এমন একটি জটিল ও ধ্বংসাত্মক মিথষ্ক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা শুধুমাত্র নীতি ও নাগরিক আচরণের ব্যর্থতা প্রকাশ করে না, বরং প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করার এবং একই সঙ্গে তাকে শোষণ করার মধ্যবর্তী অসংগতিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
ভারতের সাংস্কৃতিক চেতনা প্রকৃতিকে পুজো করে– নদী দেবী, বন পবিত্র এবং পশুরা দেবতার বাহন। কিন্তু যখন শহরগুলি জেগে ওঠে এবং শহুরে বিস্তার গ্রামীণ এলাকা গ্রাস করে, এই আধ্যাত্মিক বন্ধন ভেঙে পড়ে, পিছনে রেখে যায় এমন এক পরম্পরা, যা পরিবেশগত সচেতনতা হারিয়েছে। গঙ্গাকেই ধরা যাক, একটি নদী যা কোটি-কোটি মানুষের জন্য পবিত্র। প্রতিদিন ভক্তরা এর ঘাটে জড়ো হয়, ফুল এবং প্রার্থনা অর্পণ করে, কিন্তু একই সঙ্গে অপরিশোধিত দৈনন্দিন ও শিল্প-বর্জ্য তথা প্লাস্টিক ফেলে রেখে আসে। একদিকে এই নদী জীবনধারার প্রতীক, আর অন্যদিকে এটি প্রতীক হয়ে দঁাড়িয়েছে এক বিতর্কের: পবিত্র কিন্তু শ্বাসরুদ্ধ, পুণ্যতোয়া কিন্তু নাগরিক সভ্যতার পাপের ভারে ন্যুব্জ, গতিহীন। ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প, গঙ্গাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চালু করা একটি প্রধান উদ্যোগ, বহু কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও– এর লক্ষ্যগুলির একটি সামান্য অংশই পূরণ হয়েছে। এই নদী এখনও দূষিত, একটি ব্যর্থ প্রকল্প এবং প্রতিযোগিতামূলক আমলাতান্ত্রিক স্বার্থের শিকার। গণেশ চতুর্থী, ছট বা দুর্গাপুজোর মতো উৎসবের সময়, সারা ভারতজুড়ে নদী এবং জলাশয়গুলি বিষাক্ত রং ও অ-বায়োডিগ্রেডেব্ল সামগ্রী দ্বারা দূষিত হয়। নাগরিকরা এমন আচার পালন করে, যা হয়তো শুরু হয়েছিল বহু যুগ আগে প্রকৃতিকে সম্মান জানাতে, অথচ নিজের অজান্তেই তাদের সেই আচার পালন প্রকৃতিকে নষ্ট করতে থাকে, এটি প্রকৃতির প্রতি বিপজ্জনক এক সচেতনতার অভাবেরই পরিচায়ক।
ইকো সাইকোলজিস্টদের মতে, এই ধরনের আচরণ মূলত একটি পুরনো বিশ্বাসের ফল, যেখানে মনে করা হত, প্রকৃতি অসীম স্থিতিস্থাপকতা ধারণ করে। কিন্তু আধুনিকীকরণ এবং নগরায়ন সেই বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করেছে।
প্রতি শীতকালে, দিল্লি একটি ধোঁয়ায় ঢাকা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। বন্ধ হয়ে যায় স্কুল, ফ্লাইট বাতিল হয়, এবং বাসিন্দাদের ঘরের ভিতরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়– যখন শহরের ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’ ছুঁয়ে ফেলে বিপজ্জনক মাত্রা। প্রধান কারণ, যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্পদূষণ এবং ফসলের খড় পোড়ানো ভালভাবে জানা সত্ত্বেও সমাধান এখনও অধরা। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগুচ্ছ যদিও কাগজেকলমে উচ্চাভিলাষী, প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়শই দুর্বল। ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’ ২০%-৩০% বায়ুদূষণ কমানোর জন্য ২০২৪ সালের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু স্বাধীন মূল্যায়নে দেখা গিয়েছে যে, বেশিরভাগ শহর এই লক্ষ্যপূরণ থেকে যোজন দূরে। উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার দিকে দিল্লি আঙুল তোলে ফসলের খড় পোড়ানোর জন্য, এবং এই রাজ্যগুলি পাল্টা যুক্তি দেয় যে, কৃষকদের ‘বিকল্প’ সমাধানের জন্য আর্থিক সহায়তা অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক দোষারোপ সমবায় সমাধানের জায়গা দখল করে, নাগরিকদের শ্বাসরোধী বায়ুর শিকার
হতে হয়।
স্থানীয় রাজনীতির দ্বিচারিতা এখানেও প্রকাশিত। মুম্বইয়ে, শিবসেনা সরকারের সবুজ উদ্যোগ– আরে কলোনিতে একটি মেট্রো কারশেডের জন্য দু’হাজারের বেশি গাছ কেটে ফেলার কারণে খবরের শিরোনামে এসেছিল। প্রকল্পটি জনসাধারণের ক্রোধের মুখোমুখি হয়েছিল, কর্মীরা শহরের একমাত্র সবুজ ফুসফুসের ধ্বংসের প্রতিবাদ করেছিল। উন্নয়নের নামে উপস্থাপিত হলেও, এমন সিদ্ধান্তগুলো দেখায় যে, নগরোন্নয়নের ওজনের তুলনায় পরিবেশগত উদ্বেগ প্রায়শই গুরুত্বহীন হিসাবে বিবেচিত হয়। ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবেশ নীতিতে বৈপরীত্যপূর্ণ। একদিকে, কেন্দ্র সরকার পৃথিবীতে জলবায়ু সংশোধনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান নেওয়ার স্বপ্ন দেখে, ‘প্যারিস চুক্তি’-র অধীনে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির জন্য উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য স্থির করে। অন্যদিকে, সেই সরকারই কয়লা খনন এবং তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সম্প্রসারণ চালিয়ে যায়, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির অজুহাতে। ঝাড়খণ্ডের কয়লা খনি থেকে শুরু করে বুলেট ট্রেন প্রকল্প পর্যন্ত, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য– উভয়স্তরের প্রশাসন প্রকৃতির দাম দিয়ে উন্নয়নের পক্ষে সওয়াল করে। এ-কথা বহু আলোচিত যে, ভারতের বহু মেট্রো শহর আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শুকিয়ে যাবে, যেমন যাচ্ছে চেন্নাই– কিন্তু বিপদ একেবারে ঘরে এসে পড়ার আগে স্থানীয় সরকার নির্বিকার। নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, স্থানীয় নেতৃত্বের আত্মতুষ্টি এবং কেন্দ্রীয় নীতির অর্ধেক প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ– এই তিনের সমন্বয়ে এমন এক চক্র তৈরি হয়েছে, যা উন্নয়ন এবং পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে অপারগ বা অনিচ্ছুক।
এর সঙ্গে অবশ্যই যোগ করতে হবে শব্দদূষণের কথা, যেটা নিয়ে স্কুলস্তরে রচনা লেখা বাদ দিলে, মানুষের মধ্যে কোনও সচেতনতা নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ সহনাগরিক ভাবে যে, ‘এটা তো আমাদের আনন্দের সময়। এইটুকু শব্দে, এক-আধদিন কার-ই বা অসুবিধে হবে!’ কিন্তু তারা বোঝে না যে, এই শব্দ শুধু প্রতিবেশীদের জন্যই বিরক্তিকর নয়, এটি শহরের পরিবেশ এবং আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করতে পারে। বিশেষত– শিশু, বৃদ্ধ এবং মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা এসব শব্দের কারণে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আতশবাজি, বরযাত্রীদের বা ভাসানের বাজনা, হর্ন, মাইকিং– এসবের মধ্যে এক ধরনের ‘ইকো-অবরোধ’ তৈরি হয়, যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে, এবং অদূরভবিষ্যতে মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগের মতো রোগের সৃষ্টি করতে পারে। সরকারের তরফে এই বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, তা সীমিত এবং কার্যকর নয়।
মুম্বই শহরের আদালত, উদাহরণস্বরূপ, কিছু বছর আগে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি আইন পাস করেছিল, কিন্তু তার বাস্তবায়ন খুবই দুর্বল। দীপাবলি উপলক্ষে বাজি ফাটানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরেও, পুরো শহরেই, নানা জায়গায় শব্দদৈত্যের তাণ্ডব ছিল অব্যাহত। বিভিন্ন উৎসব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর নীতির অভাব এবং তদারকি না-হওয়ায়, এই সমস্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে। ‘ইকো সাইকোলজি’-র একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব: ‘অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিজম’ বা মানুষকেন্দ্রিকতা, যা মানুষের প্রকৃতির প্রতি একধরনের দখলদার মনোভাবকে বোঝায়। শহুরে এলাকায় যখন মানুষ শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে পরিবেশকে ব্যবহার করতে থাকে, এবং এর প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে উপেক্ষা করে, তখন তারই ফলস্বরূপ শব্দদূষণ এবং অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হয়। শীতের মুখে সারা রাত জুড়ে বিয়ের মরশুমে বাজনা বাজানোর সময়, বা বাজি-পটকা ফাটানোর সময় ক’জন আমরা রাস্তার কুকুর বা এই শহরের অতিথি কিছু পরিযায়ী পাখিদের দিশাহারা, অসহায় ভাবের তোয়াক্কা করি? আসলে আমরা ভুলে যাই যে, পৃথিবীটা শুধু মানুষের জন্য নয়, কোনও দিন ছিল না।
দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পরোয়া না-করে স্বল্পমেয়াদি লাভের লোভে মেতে ওঠাটাই আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে দঁাড়িয়েছে। এর মধ্যেও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব, যদি কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পরিবেশ আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। রাজনৈতিক চাপের মাঝে সাধারণ মানুষ এবং পরিবেশবাদী সংগঠনদের একত্র হয়ে আইন ও নীতির বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিকভাবে এই আন্দোলনগুলো সরকার এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পরিবেশের গুরুত্ব তুলে ধরতে পারে। সরকারকে পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ, বনাঞ্চল রক্ষা এবং জীববৈচিত্র সংরক্ষণ বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। পাশাপাশি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়াটা জরুরি। সোলার প্যানেল, বায়ুশক্তি এবং জলবিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। শুধু স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই নয়, পরিবেশ-বিষয়ক সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতা, বিধায়ক ও সাংসদদের মধ্যেও, যাতে তঁারা বোঝেন যে, পরিবেশের সুরক্ষা দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা করার পক্ষে সীমান্ত রক্ষার মতোই জরুরি।
মানুষের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা গড়ে তোলা দরকার, যা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরই বিস্মৃত উত্তরাধিকার। পরিবেশের সুরক্ষা যদি আমাদের জাতীয় পরিচয় হয়ে ওঠে, তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইএসআই কলকাতার অধ্যাপক
swagatamdas19@yahoo.co.in