নিউ ইয়র্কে বিয়ে-বহির্ভূত প্রেম আর ‘অপরাধ’ নয়। বৈধ-অবৈধর সীমারেখাও ফলে ধূসর হল। রক্ষণশীল মার্কিন সমাজ অভিঘাতময় হল।
প্রেমের স্বভাব প্রকাশে। নর-নারীর মধ্যে যদি ভালবাসার সম্পর্ক থাকে, সেটি সামনে প্রস্ফুটিত হতে চায় যে কোনও মূল্যে, যেন তা সম্পর্কের অমূল্য চিহ্ন, মন-চালাচালির স্মারক। এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন– অবৈধ সম্পর্কের বেলায়। কারণ, সহজপথে, স্বাভাবিক ছন্দে, সেই প্রেমকে সামনে আনা যায় না।
‘বহ্নি-পতঙ্গ’ উপন্যাসে, সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর মুখ দিয়ে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এই সত্যটিকেই আরও একবার বলিয়ে নিয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রেমিকের চোখের মণি নীল। সে-কথাটি প্রেমিকার মনে সবসময় আন্দোলিত হয়। কিন্তু প্রেমিকা বিবাহিতা। সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। বিয়ে-স্বামী ছাড়া, সে যে আরও একটি প্রেমজীবনের সন্ধান পেয়েছে, তা কী করে প্রকাশ করবে? উপায় হল: একটি তৈলচিত্র, যা প্রেমিকার আঁকা। পেন্টিংটি দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার। কিন্তু দেখা গেল, দুষ্মন্তের চোখের মণি নীল। এই একটি বিশেষ প্রয়োগ, ব্যোমকেশকে রহস্যভেদের দিকে ঠেলে দেয়।
প্রেমের অর্থ প্রেম। ভারতীয় সমাজে এই কথাটি নেহাত কাগুজে মহিমায় ব্যাপ্ত। প্রেমের বিভাজন আমরা ঘটিয়েছি প্রাতিষ্ঠানিক তাৎপর্যে। যেমন, ‘বিয়ে’ একটি প্রতিষ্ঠান। ফলে বিয়ে-সম্ভূত প্রেমের যে পরিসর আমাদের সমাজে গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে, প্রতিতুলনায় বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমের পরিসরটির অবস্থান যোজন দূরে। সমাজের গড়নপিটন অবিকৃত রাখতে বিয়ে-বহির্ভূত প্রেমকে প্রান্তবর্তী করা হয়েছে, তার গায়ে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে ‘অবৈধ’ তকমা। তবে মজার কথা, অবৈধ প্রেমকে কেন্দ্র করেই পল্লবিত হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পদ। অবৈধ প্রেম ঘিরে তৈরি হয়েছে প্রেমের নানা পর্যায়ের রসাস্বাদন। ভারতীয় সমাজ থেকে এর দৃষ্টান্ত দিতে বললে– বৈষ্ণব পদাবলি প্রথমেই উল্লিখিত হবে। রাধা-কৃষ্ণর প্রেম সমাজের বৈধ সম্মতি পায়নি, কিন্তু তাতে প্রেমের অন্তরঙ্গ সুবাসে কি ঘাটতি পড়ছে?
শ্বেতাঙ্গ মার্কিন সমাজ রক্ষণশীল বলে নিন্দিত। সেখানকার অন্তত ১৬টি প্রদেশে বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্ক ও প্রেম ‘অবৈধ’, গণ্য হয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে। কিন্তু সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক অন্য পথে হঁাটল। প্রায় ১১৭ বছরের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে– গভর্নর ক্যাথি হোচুল নতুন বিলে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, স্বামী বা স্ত্রী-কে ‘ঠকিয়ে’ অন্য সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া অপরাধ নয়, ফলে বৈধ-অবৈধের সীমারেখার কথা উঠছেই না।
বিবাহ বিচ্ছেদের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় অবৈধ প্রেম। তাই সেটিকে শাস্তির আওতায় রাখলে, জনমানসে ভীতি কাজ করবে, এই ছিল এত দিনের যুক্তি! কিন্তু সমাজের তকমা বনাম ব্যক্তি-স্বাধীনতার দ্বন্দ্বটি এবার নতুন মোড় মিল– নিউ ইর্য়কের পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে। বিয়েতে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি কতখানি তাৎপর্য রাখে? বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করতেন, সম্পর্কের বুনিয়াদি যাচাইকরণটি নির্ভর করে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির সাপেক্ষে। কোন সম্পর্ক টেকসই, কোন সম্পর্ক টেকসই হয়েও অনুদার– ‘তৃতীয় পক্ষ’ তা ধার্য করে দেয়– তাকে আমরা ‘প্রেম’ বলে ডাকতেই পারি।
(মতামত ব্যক্তিগত)