shono
Advertisement

বেঠিক সময়ে নিয়ন্ত্রণের তাড়না?

ক্ষমতায় আছে বলে বিজেপি যে আইন আনছে, সরকার চলে গেলে সেই আইন থেকে নিজেদের বাঁচাবে কী করে?
Posted: 03:08 PM Jun 03, 2021Updated: 03:08 PM Jun 03, 2021

১৮১৫-র ১৮ জুনের ওয়াটারলু যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে এই জুনে লেখা শুরু করার কারণ, গত কয়েক মাসে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং একের পর এক পদক্ষেপ। যেমন, করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ সামলাতে হিমশিম সরকার ও অনাগত তৃতীয় তরঙ্গের আশঙ্কায় দিন গুনতে থাকা ভারতবাসীর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের এই চেষ্টা? ক্লসউইৎজের প্রশ্নটাই মাথার মধ্যে ফিরে আসে, অবিসংবাদিত নায়ক কি সময় বাছতে ভুল করছেন? লিখছেন  সুমন ভট্টাচার্য। 

Advertisement

 

বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ওয়াটারলু নামে একটা ছোট্ট শহরে যে কেউ যান, আসলে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ণায়ক যুদ্ধের স্মৃতিকে উলটেপালটে দেখতে।

[আরও পড়ুন: কোণঠাসা হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের জাগরণ চাইছে বিজেপি?]

অনেক বছর আগে সমর-বিশেষজ্ঞ যে ভদ্রলোক আমাকে কিংবদন্তি ফরাসি সেনানায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জন্য বিখ্যাত এই যুদ্ধক্ষেত্র দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন ‘গ্রাউন্ড জিরো’-তে দাঁড়িয়ে যেন উপলব্ধি করি দিগ্বিজয়ী রণনায়কের কেন পরাজয় হয়েছিল। ওয়াটারলুতে দাঁড়িয়ে, ওই দিগন্তবিস্তৃত সবুজ আর বেশ কয়েকটি মিউজিয়াম দেখতে-দেখতে যেটা যে কেউ বুঝতে চাইবেন, সেটাই প্রুশিয়ান সমর বিশেষজ্ঞ কার্ল ভন ক্লসউইৎজ চমৎকারভাবে লিখেছেন। তাঁর বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, তিনি ওয়াটারলু যুদ্ধের মোড় ঘোরানো প্রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। ওয়াটারলু যুদ্ধে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (Napoleon Bonaparte) আক্রমণের জন্য ভুল সময় বেছে নেন- ক্লসউইৎজের এই ব্যাখ্যা পরে অনেকেই মেনে নিয়েছেন। এমনকী, বিজয়ী পক্ষের সেনাপতি ডিউক অফ ওয়েলিংটন-ও এই তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

আগের রাতে বৃষ্টির পর ওয়াটারলুতে ফরাসি ঘোড়সওয়ার বাহিনীর আক্রমণের ক্ষমতা কতটা থাকবে, নেপোলিয়ন সেই হিসাবে ভুল করেছিলেন। একই সঙ্গে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ফরাসি সেনানায়ক, যিনি ওয়াটারলু যুদ্ধের সকালেও বলেছিলেন, প্রাতরাশ শেষ করার মতোই দ্রুত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে উড়িয়ে দেবেন, খেয়ালই রাখেননি- কখন ব্রিটিশদের সাহায্যে প্রাশিয়ার সেনাবাহিনীও পৌঁছে গিয়েছে।

১৮১৫-র ১৮ জুনের ওয়াটারলু যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে এই জুনে লেখা শুরু করার কারণ, গত কয়েক মাসে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং একের পর এক পদক্ষেপ। যেমন, করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ সামলাতে হিমশিম সরকার ও অনাগত তৃতীয় তরঙ্গের আশঙ্কায় দিন গুনতে থাকা ভারতবাসীর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের এই চেষ্টা? ক্লসউইৎজের প্রশ্নটাই মাথার মধ্যে ফিরে আসে, অবিসংবাদিত নায়ক কি সময় বাছতে ভুল করছেন? তাহলে কি বিরোধীদের অভিযোগটাই ঠিক? সবই সমালোচনায় লাগাম পরানোর চেষ্টা?

প্রথমে এটা বুঝে নেওয়া যাক- টুইটার, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ ভারতে যে-নীতি অনুসরণ করে চলছে, তা তাদের আন্তর্জাতিক নীতি। অর্থাৎ ঠিক যে-কারণে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটের পাশে টুইটার কর্তৃপক্ষ সঠিক তথ্য নয় বলে ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে দিয়েছিল, সেই একই যুক্তিতে সম্বিত পাত্র বা অন্য বিজেপি নেতার টুইটের পাশে ম্যানিপুলেটেড মিডিয়ার তকমা লাগানো হয়েছে। টুইটারের দিল্লি অফিসে পুলিশ পাঠিয়েও সেই ট্যাগ সরেনি। বরং ভারতে কথা বলার অধিকার বা গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। মনে রাখতে হবে, চমকে বা ধমকে টুইটারকে বাগে আনা কঠিন। ভারত যত বড় বাজারই হোক, যেটা ডোনাল্ড ট্রাম্প পারেননি, সেটা অন্য কোনও রাজনীতিকের জন্যও কঠিন।

কারণ, তাহলে এসব তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার শেয়ারে ধস নামবে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা টলে যাবে।
এবার আসা যাক কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন আইন এবং সেটা নিয়ে মার্ক জুকারবার্গের মালিকানাধীন আর-এক সংস্থা হোয়াটসঅ্যাপের আপত্তি নিয়ে। হোয়াটসঅ্যাপ ইতিমধ্যেই এই আইনের বিরুদ্ধে দিল্লি হাই কোর্টে গিয়েছে অর্থাৎ অনুমান করে নেওয়া ভাল, আইনি লড়াই চলবে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির অভিযোগ শোনার জন্য অফিসার নিয়োগ বা সমস্যা সমাধানে নোডাল অফিসার মনোনয়নে আপত্তি নেই। তাদের আপত্তি: কোনও পোস্ট বা মেসেজ, যেটা ‘শেয়ার’ হতে থাকছে, তার ‘অরিজিন’ বা কোথা থেকে উৎপত্তি, সেটা চিহ্নিত করে সরকারের হাতে তুলে দেওয়া বিষয়ে। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের যুক্তি, এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে। ভারতের বিরোধী দলগুলিও মনে করছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনায় জেরবার কেন্দ্রীয় সরকার বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে চাপে রাখতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী বা কোনও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে করা কার্টুন বা মিম-এর অরিজিন বা উৎসস্থল চিহ্নিত করে ফেলতে পারলে শাস্তি দেওয়া তো কঠিন কাজ নয় (অশ্লীল ও অরুচিমূলক কার্টুন বা মিমের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু সে-প্রসঙ্গে এই আলোচনা নয়, বলা বাহুল্য)।

এবার এর বিপরীত দিকটা দেখা যাক। কংগ্রেসের একজন সাংসদ, যিনি সংসদে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার বা বিধি-নিষেধ ইত্যাদি নিয়ে সরব বা নতুন আইনটাকে নেড়েচেড়ে দেখেছেন, তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় যে-কথাটা বলেছেন, সেটা যেমন তাৎপর্যপূর্ণ এবং তেমনই মজার। তাঁর কথায়, আজ ক্ষমতায় আছে বলে বিজেপি যে-আইনটা আনছে, সরকার চলে গেলে গেরুয়া শিবির সেই আইন থেকে নিজেদের বাঁচাবে কী করে? এই নতুন আইনে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, নারীবিরোধী কথাবার্তা, ঘৃণা ছড়ানোর মতো যেসব বিষয়ের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেসব অভিযোগ সবচেয়ে বেশি করে ওঠে বিজেপি-র আইটি সেলের বিরুদ্ধে! তাহলে, ওই কংগ্রেস নেতার মতে, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার না থাকলে তো প্রতিদিন বিজেপির আইটি সেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হবে এবং গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে শাস্তির খড়্গ নেমে আসবে!

ওয়াটারলুর যুদ্ধে আত্মবিশ্বাসী নেপোলিয়ন ভাবতেই পারেননি, ফরাসি বাহিনীর হাতে পরাজিত প্রুশিয়ার সেনাবাহিনী বেলজিয়ামের রণাঙ্গনে এসে ডিউক অফ ওয়েলিংটনের পাশে আবার দাঁড়িয়ে যাবে। আর, ফরাসি বাহিনীকে ধরাশায়ী করে দেবে। জিততে অভ্যস্ত নেপোলিয়নের আত্মবিশ্বাস তাঁকে খেয়ালই রাখতে দেয়নি, যারা আগে বারবার তাঁর কাছে হেরেছে, তারা যদি একজোট হয়, তাহলে কী হতে পারে? ওয়াটারলু শুধু তাই একটা ইতিহাস-বিখ্যাত রণাঙ্গন নয়, রাজনীতি এবং সমরনীতির কৌশল শেখার অন্যতম স্কুলও। ওয়াটারলু, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলির সংঘাত এবং ভারতে বিজেপির সরকারের সঙ্গে ফেসবুক-টুইটারের লড়াইকে এক পরিসরে আনলে কী বুঝব?

‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ ২০২০ সালের ২৯ মে ট্রাম্প বনাম টুইটার নিয়ে যেটা লিখেছিল, সেই একই চিত্রনাট্য ভারতেও অভিনীত হচ্ছে। অর্থাৎ ট্রাম্পের মতো দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকের উত্থান হয়েছিল টুইটার বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু ট্রাম্প যখন শাসক হয়ে গেলেন এবং এসব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম তাঁর আজগুবি বক্তব্যে বেড়ি পরাতে শুরু করল, তখনই প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট খেপে গিয়েছিলেন। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। ভারতেও মেনস্ট্রিম মিডিয়ার কাছে ব্রাত্য বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার আউটরিচের সুবাদে, ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’র দৌলতে। কিন্তু এখন বিজেপি (BJP) যখন শাসন ক্ষমতায়, আর গেরুয়া শিবিরের অতিকথন বা অতিরঞ্জনে যখন সোশ্যাল মিডিয়া বাধা দিচ্ছে, তখন নেতাবদ্যিরা চটে যাচ্ছেন। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে এটাই সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।

ওয়াটারলু দিয়ে শুরু করেছিলাম, প্রসিদ্ধ ওই রণাঙ্গন দিয়েই শেষ করি। মে থেকে জুন তো আসলে অনেক কথা-ই বলছে। দুর্ভেদ্য নেপোলিয়নকে যিনি ওয়াটারলুতে হারিয়েছিলেন, সেই ডিউক অফ ওয়েলিংটন কিন্তু পরে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আমরা তাঁকে চিনি আর্থার ওয়েলেসলি বলে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
suman09bhattacharyya@gmail.com

[আরও পড়ুন: তিনি জননেত্রী, নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement