বাংলা ‘ধ্রুপদী’ ভাষার স্বীকৃতি পেল। তো! বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ার সুযোগ অনেকটা বেড়ে যাবে। তো! ‘তৃতীয় ভাষা’ হিসাবে বাংলা নিতে পারবে অনেকে। তো! কেউ আশাবাদী নয়। এমন কেন হল? লিখছেন অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
চলুন, একটু শৈশবের দিনগুলিতে ফিরে যাই। মনে পড়ে যাবে– ছোট্ট আপনি নিজে-নিজে চেয়ারে উঠতে চাইছেন, আর অভিভাবকেরা টেনে নামিয়ে দিচ্ছেন। গাছে উঠতে চাইছেন, অভিভাবকেরা টেনে নামিয়ে দিচ্ছেন। শুধু ‘নেমে আয়, নেমে আয়’। আমার এক ভাইপো প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। ফলাফল ভালই হয়েছে।
কিন্তু চিৎকার করে তার সে কী কান্না! ‘নামব কী করে! নামিয়ে দাও, নামিয়ে দাও।’ অভিভাবকেরা অবশ্য কেবলমাত্র আমাদের টেনে নামিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না। অন্য কোনও ব্যক্তি যদি একটু অন্যরকম ভাবছেন বা করছেন বা ধরুন লেখালিখিই করছেন– তাহলে তাকেও টেনে নামাতে পিছপা হতেন না। এখন আমরাও সেই ‘ঐতিহ্য’ বহন করে চলেছি।
আমরাও টেনে নামাচ্ছি। বাংলা ভাষা ‘ধ্রুপদী’ ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। তো! এবার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ার সুযোগ অনেকটা বেড়ে যাবে। তো! বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের দেশে ‘তৃতীয় ভাষা’ হিসাবে যে কোনও একটি ‘ধ্রুপদী’ ভাষা নিতে হয়। বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি ছেলেমেয়েরা এবার থেকে তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ‘তৃতীয় ভাষা’ হিসাবে নিতে পারবে। তো!
কিছু-কিছু মানুষ গর্বিত তো হলই না। উল্টে টেনে নামাতে উঠে পড়ে লেগে গেল। কেউ বলল– এবার থেকে কি বাংলা ভাষাকে মিউজিয়ামে পাওয়া যাবে? আবার কেউ বলল– এটা কেবলমাত্র একটা সরকারি তকমা। এর তেমন কোনও গুরুত্ব নেই। সাহিত্যে বলুন বা প্রাত্যহিক সমাজ জীবনে, কোথাও এর কোনও প্রভাব নেই। টেনে নামাও, টেনে নামাও।
পরাধীন ভারতে, এই রাজ্যের আইনসভায়, ১৯৪৩ সালের ৮ জুলাই মাননীয় অধ্যক্ষ বললেন– তিনি আইনসভায় বাংলায় আলোচনা করার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন ঠিকই, কিন্তু ‘বেঙ্গলি শর্টহ্যান্ড রিপোর্টার’-এর খামতি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। তবুও ব্যবহারিক জীবন থেকে বাংলা ভাষাকে টেনে নামাও। বিধানসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত, নীতি ইত্যাদি কেন্দ্রকে জানাতে হবে। অতএব ইংরেজিতে লেখা হল। বাংলাতেও লেখা উচিত। নেই কেন? ডা. বিধানচন্দ্র রায় বললেন (৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮)– ‘উই হ্যাভ নো ফান্ডস
টু ট্রান্সলেট দ্যাট’। বিধানসভায় ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সামান্য আটকে গেলেই ‘বাংলায় বলুন বাংলায় বলুন’ বলে চিৎকার ও হাসাহাসি আরম্ভ হত (৮ জুলাই, ১৯৪৮)। আবার বাংলায় বলতে গিয়ে ‘সংবিধান’ শব্দটিকে ‘কনস্টিটিউশন’ বলে ফেলেছিলেন হেমন্তকুমার বসু (৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮)। পরিণাম? কেউ বললেন, “আপনি সব বাংলায় বলুন। ‘কনস্টিটিউশন’ কি বাংলা কথা?” আবার কেউ-কেউ একধাপ এগিয়ে বললেন, ‘কনস্টিটিউশন’ কথার কোনও বাংলা নেই। শেম, শেম।’
আবারও টেনে নামাও, টেনে নামাও। পরিভাষা নেই। পরিভাষা দরকার। পরিভাষা সংসদ গঠিত হল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন প্রধান সচিব সুকুমার সেন তঁার প্রথম ‘স্তবক’-এ লিখেছিলেন (১৯ জানুয়ারি, ১৯৪৮), ‘কিছুকাল পূর্বে সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রচলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।’ তারপর থেকে ২১ বছর ধরে আরও পঁাচটি ‘স্তবক’ প্রকাশিত হয়েছিল।
ওহ্, এখানে বলে রাখা ভাল যে, ‘স্তবক’ অর্থে গ্রন্থের খণ্ডকে বোঝানো হয়েছিল, অর্থাৎ ‘প্রথম স্তবক’ মানে ‘প্রথম খণ্ড’। সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলা ভাষা। এই যেমন ‘কোর্ট’ শব্দটির পরিভাষা ‘আদালত’ বা ‘বিচারালয়’ না-করে ‘ধর্মাধিকরণ’ করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষ– কেউই এই ‘পরিভাষা’ গ্রহণ করেনি।
জনজীবনের সাধারণ প্রচলিত ভাষার সঙ্গে এই পরিভাষার প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই মিল ছিল না। জনজীবনের কথা যখন উঠলই– একটা কথা না-বলে পারছি না। দেখবেন, সমাজের বিশেষ-বিশেষ ক্ষেত্রের তারকা সাক্ষাৎকারে বাংলা ভাষার সঙ্গে কেমন কঁাধ ঝঁাকিয়ে-ঝঁাকিয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে-বেঁকিয়ে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। আপনি বলবেন, তো! আমি বলব, আরে, এঁদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে তো সাধারণ ছেলেমেয়েরাও এইভাবে কথা বলছে। ‘স্মার্ট’ হওয়ার চেষ্টা করছে। কেননা, প্রেম করার ক্ষেত্রে এই ধরনের কথা বলাটা বেশ জরুরি একটা শিল্প। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, মাঝে রোমান হরফেও বাংলা লেখার কথা উঠেছিল।
ভাবুন তো, যদি সত্যিই তাই হত! বাংলা ভাষার হরফই থাকত না! তাহলে অবশ্য ‘ধ্রুপদী’ ভাষার প্রশ্নই উঠত না। তখন এই উদ্যোগ আটকে দেওয়া গিয়েছিল। এখনও এমন একটা উদ্যোগ নিতে হবে। ধ্রুপদী ভাষা স্বীকৃতির জন্য যে অনুদান পাওয়া যাবে, সেটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। প্রথমেই দরকার ভিনরাজ্যের বাঙালি ছেলেমেয়েদের তৃতীয় ভাষা হিসাবে বাংলা পড়ার পাঠ্যপুস্তক তৈরির কাজে হাত দেওয়া। সারা দেশে অনেক বাঙালি ছেলেমেয়ের চাকরি হবে তাতে। আর ছাত্রছাত্রীরাও প্রাণের আরাম খুঁজে পাবে। আমাদের রাজ্যে তো বাংলায় কাজ করার ক্ষেত্র প্রচুর– তা সে শিক্ষা ক্ষেত্রেই হোক বা সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রেই।
তবে এবার কিন্তু প্রশাসন থেকে সামাজিক– প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণা করে একেবারে বাংলা ভাষার মাধুর্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাধারণ ব্যবহারিক জীবন থেকে উঠে আসা বাংলা শব্দগুলিকেই বেছে নিতে হবে। অনুদান থাকাতে এবার হয়তো আর্থিক দিকটা কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যেতে পারে। সাধারণ মানুষ কিন্তু কেবল তাদের মাতৃভাষাটিই জানে। তাই এই কাজটাকে কিছুতেই আর জনগণের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। এর দায়িত্ব নিতে হবে, এই আমাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের। আমরা জানি, তাড়া না-খেলে বিড়াল গাছে ওঠে না। আমাদের এবার এই কাজটা করতে হবে।
২৫ বছর আগে (৬ আগস্ট, ১৯৯৯) কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘কথায় আর কাজে’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন– ‘থানায় ডায়েরি অবশ্যই বাংলায় হওয়া চাই। তাতেও কিন্তু আদালতে রেহাই নেই। যতক্ষণ না মূল আইন বাংলায় হচ্ছে। নইলে তর্জমার বাংলা কখনও প্রামাণ্যের মর্যাদা পাবে না। বহুভাষী এই দেশে মুখের ভাষাকে কদর দিতে হবে। জনপ্রতিনিধিরা যেন সংসদে নিজের ভাষায় মুখ খুলতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ভবনে, আর কেন্দ্রে, থাকা দরকার অনুবাদ দপ্তর। যাতে ইংরেজি না-জানা যে কোনও নাগরিক তার নিজের ভাষায় মনের কথা জানাতে পারেন। বিদেশিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় দোভাষী মারফত নিজের ভাষায় মনের কথা বলতে দেখলে দেশের মানুষ মনে জোর পাবে।
তারা এটা ভেবে দেখেন না কেন! আজাদ কিম্বা কামরাজকে স্মরণ করুন। কিংবা স্তালিন। ইংরেজি জেনে বুঝেও দোভাষী ছাড়া এক পা-ও চলতেন না। মাছি মারা কেরানি কমিয়ে অনুবাদক আর দোভাষীর দল ভারী হোক। তাতে কাজে মন লাগবে। চাই কেন্দ্রে আর রাজ্যে অনুবাদ সার্ভিস। পরিভাষার ক্ষেত্রে কোনরকম ছুঁৎমার্গ থাকা উচিত নয়। হিন্দিতে এই নিয়ে বিস্তর কাজ হয়েছে। সেসব আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত। যে উৎস থেকেই নিই তা যেন আমাদের ভাষার প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই হয়।... সর্বতোভাবে বাংলা ব্যবহার ফরমান দিয়ে হবে না। বাঙালি মনের পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করতে হবে। গলা চড়িয়ে শক্তি ক্ষয় না করে ঘাড় গুঁজে কাজ করে গেলে বাংলাভাষী সবাই আমাদের পাশে দঁাড়াবে।’
আমরা তো জানি ভাষা, অর্থনীতি, রাজনীতি আর ক্ষমতা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তাই আর টেনে না-নামিয়ে চলুন এবার কাজে নামা যাক। কেবল বাংলা বর্ণমালাই বা কেন ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ হয়ে থাকবে?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
anupart59@gmail.com