গোটা কলকাতার আনাচে কানাচে টিমটিম করে যেসব বাংলা মিডিয়াম স্কুল আজও চলছে, সবগুলোরই একই বেহাল দশা। সেখানে এখন যায় সমাজের একেবারে প্রান্তিক অংশের নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা। বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে অনেকেই হয়তো মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ করে দেবে অর্থাভাবে। কলমে অরূপ কর
বাংলা ভাষার হেরিটেজ মর্যাদা চেয়ে সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিতে তিনি চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। এই প্রথম নয়, আগেও তিনি বাংলার ধ্রুপদী ভাষার তকমার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর এই উদ্যমকে সাধুবাদ। যে কোনও জাতিই গর্ব করে তার মুখের ভাষা, মাতৃভাষার জন্য। মাতৃভাষা তার প্রাণ। তার যথাযোগ্য মর্যাদার জন্য আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। আর বাংলা ভাষার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্থান করে নিয়েছে ক্যালেন্ডারে। দিনটির সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই, সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এহেন প্রেক্ষাপটে কেন আজও বাংলা ভাষা ধ্রুপদী মর্যাদা পায়নি, সেটাই প্রশ্নের।
মুখ্যমন্ত্রীর সওয়াল, বাংলা ভাষার ঐতিহ্য আড়াই হাজার বছরের পুরানো। কেন্দ্রের সরকার তামিল, তেলুগু, সংস্কৃত, কন্নড়, মালয়ালম, ওড়িয়া ভাষাকে হেরিটেজ মর্যাদা দিয়েছে, তাহলে বাংলা ভাষা কেন পাবে না?
ভাষা চলমান নদীর মতো। সময়ের স্রোতে সে অনেক ভাঙাগড়া প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। সমৃদ্ধ হয়। আবার কখনও কখনও তার প্রতি ভালোবাসা, অন্তরের আবেগের টান শুকিয়ে গেলে তা ধাক্কাও খায়। প্রাণের ভাষা, নিজের মুখের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে সংশ্লিষ্ট জাতির উদ্যোগও হেরিটেজ মর্যাদার থেকে বোধহয় বেশি দরকারি। সেই উদ্যোগ, কর্মসূচি এখানে কোথায়? বরং নেতিবাচক ছবিটাই প্রবল। দিনকয়েক আগে একটা দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলাম। রাগ হচ্ছিল, দুঃখও হচ্ছিল। সেটাই বলি।
[আরও পড়ুন: হাসিনার স্বস্তি থাকবে তো? ভারত-চিন টানাপোড়েনে কী করবেন মুজিবকন্যা]
দক্ষিণ কলকাতার কয়েক দশকের পুরানো এক নামজাদা, অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম মেয়েদের স্কুলের দরজা থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে সংলগ্ন সকালের ব্যস্ত বাজারে একটা অটো দাঁড়িয়ে। এলাকারই একটি বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ভর্তির প্রচার হচ্ছিল রেকর্ড করা বার্তায়। ‘ভর্তি চলছে, ভর্তি চলছে। প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পড়ানো হয়। আপনার বাড়ির বাচ্চাকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করান।’ আমার মতো তল্লাটের ৫০ পেরনো অনেকেরই ছাত্রজীবন কেটেছে ওই স্কুলে। ওখান থেকেই বৃহত্তর জীবনের ময়দানে বিশ্বের নানা শহরে ছড়িয়ে পড়ে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত অনেকে। আজ সেই স্কুল উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে।
ওই স্কুল একটা উদাহরণ মাত্র। গোটা কলকাতার আনাচে কানাচে টিমটিম করে যে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলো আজও চলছে, সবগুলোরই আজ বেহাল দশা। সেখানে এখন যায় সমাজের একেবারে প্রান্তিক অংশের নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা। বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে অনেকেই হয়তো মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ করে দেবে অর্থাভাবে। কোথাও বা দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা স্কুলে চলছে বহুতল নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। অথচ সাত-আটের দশকে যথার্থই ছাত্রপ্রেমী শিক্ষকরা ভালবাসা দিয়ে পড়ুয়াদের মনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতেন। কালে কালে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দাপটে নাভিঃশ্বাস উঠেছে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলির। আটের দশকে পড়ুয়াদের ওপর বোঝা কমানোর নামে বামেদের প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দিয়ে ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ স্লোগান গেলানোর উদ্যোগের বিষময় ফল ফলেছে। চটকদারি, আবেগসর্বস্ব স্লোগান দেওয়া হলেও বাংলায় পঠনপাঠনের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একটু সঙ্গতিসম্পন্ন অভিভাবকরা দলে দলে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে লাগলেন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। না বাংলা, না ইংরেজি–কোনওটাই ঠিকঠাক শিখে ওঠা হল না অনেকের। ‘বাংলা বনাম ইংরেজি’র মাসুল দিল ওরা। পরে উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পৌঁছে পদে পদে হোঁচট খেতে হল।
বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারত বুনিয়াদি স্কুলগুলো। কিন্তু সেই স্কুলগুলোকে যাবতীয় পরিকাঠামো দিয়ে শক্তিশালী করার উদ্যোগ কোথায় সরকারি স্তরে? সেই সদিচ্ছা না থাকলে বাংলা ভাষা ‘হেরিটেজ’ সম্মান পেলেও আখেরে কোনও লাভ হবে না। কলকাতায় ট্রাম পরিবহণ কার্যতঃ শিকেয় তুলে যেমন কিছু ট্রামের গায়ে ‘হেরিটেজ’ লিখে ঝকঝকে রূপ দিয়ে বিশেষ কিছু রুটে চালানোর উদ্যোগ হয়েছে, যাতে আম পাবলিকের কোনও সুরাহা হয়নি, তেমনই বাংলা ভাষার জন্য বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোর পুনরুজ্জীবন না ঘটালে কোনও ফল মিলবে না।
পর্যবেক্ষকদের একাংশের ধারণা, আসন্ন ভোটের আগে বাংলা ভাষা ঘিরে বাংলায় আবেগ সৃষ্টি করতে চান মুখ্যমন্ত্রী, তাই ধ্রুপদী তকমার জন্য এই উদ্যোগ। যেমন, ২০২১ এর বিধানসভা ভোটের আগে ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’ স্লোগানের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল। রাজনীতির কারবারীরা ভোটের অঙ্ক মাথায় রেখে ভাবনাচিন্তা করেন।
কিন্তু রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসলে গভীর ভাবে ভাবতে হবে আমরা দৈনন্দিন জীবনে ঘরে-বাইরে পারস্পরিক আদানপ্রদানের সময় কি শুধু বাংলা বলব, লিখব না বাংলার মধ্যেই হিন্দি, ইংরেজি শব্দ গুঁজে দিয়ে কাজ চালিয়ে যাব। আজ আমাদেরও আত্মসমীক্ষা করার সময় এসেছে।