যে-শব্দের মধ্যে আশ্রিত প্রভুত্ববাদ, গায়ে লেগে আছে ইংরেজ শাসনের গন্ধ, সেসব বর্জিত হোক সরকারি নথি থেকে। এই দাবি কি সর্বৈব গ্রাহ্য?
কে. রাধাকৃষ্ণন, কেরলের মন্ত্রী। তিনি মন্ত্রিত্ব এবং এমএলএ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন ইস্তফাপত্রে এক অতুলনীয় নির্দেশ জারি করে– যে কোনও সরকারি নথিতে এমন কোনও শব্দের ব্যবহার এবার ‘নিষিদ্ধ’ হোক, যে-শব্দের মধে্য আশ্রিত প্রভুত্ববাদ, যে-শব্দের গায়ে লেগে আছে ইংরেজ শাসনের গন্ধ। যেমন একটি শব্দ ‘কলোনি’।
যঁারা কোনও কলোনির অধিবাসী, তঁারা ওই ‘কলোনি’ শব্দটির দ্বারা মানসিকভাবে আক্রান্ত হতে পারেন। ফলে, সামাজিক অপমানবোধে ভুগতে বাধ্য হতেও পারেন। কে. রাধাকৃষ্ণন তঁার ইস্তফাপত্রে লিখেছেন, ‘কলোনি’ শব্দের পরিবর্তে ‘নগর’ শব্দটি সহজেই ব্যবহার করা যায় বিকল্প শব্দ হিসাবে, যে-শব্দের গায়ে কোনও কলোনিয়াল হীনমন্যতা নেই।
এইরকম আরও কতকগুলো ইংরেজ-শাসনের অপছায়া বর্জিত বিকল্প শব্দের সন্ধান দিয়েছেন তিনি তঁার পদত্যাগপত্রে। কে. রাধাকৃষ্ণনের এই উদে্যাগ এবং মাঙ্গলিক ভাবনাকে স্বাগত জানাতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা কুণ্ঠা নেই। বরং, এই প্রচেষ্টায় সাধারণ ভারতবাসীকে আমরা প্রাণিতই করতে চাই। সেসব শব্দ, বিশেষ করে সরকারি নথিপত্রে যতদূর সম্ভব পরিত্যাগ করাই উচিত, যেসব শব্দ কোনওভাবে কারও মধে্য জাগাতে পারে অপরাধবোধ বা হীনতাবোধ। শুধু সরকারি নথিপত্রে কেন, প্রাত্যহিক সংলাপ থেকে সাহিতে্যর ভাষা– সর্বত্রই এমন শব্দ পরিত্যাজ্য, যারা কোনওভাবে অপমানকর, যা মানুষের মর্যাদাবোধকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। এমন দু’টি শব্দ– ‘নিগার’ বা ‘নিগ্রো’, যে-শব্দ এ-যুগে এত দূর বর্জনীয় যে, ‘নিষিদ্ধ’-ই বলা যায়। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক রোয়াল্ড ডাল-এর গল্পে এই ধরনের ঔপনিবেশিক, ‘অপমানকর’ শব্দের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড়ও উঠেছিল।
আবার, সাহিতে্যর গুণাবলি বিচার করে এবং সামাজিক প্রেক্ষিতের যাথার্থ্য বিচার করে অনেকে রোয়াল্ড ডালের গদে্য বা লেখায় এই শব্দগুলো রেখে দেওয়ার পক্ষেও রায় দেন। সুতরাং, কলোনিয়াল শব্দের বর্জন ভাল বলে মেনে নিয়েও আমাদের মধে্য যেন সূক্ষ্ম বিচারের জায়গাটা ঘোলা হয়ে না যায়, সে-বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। জর্জ অরওয়েলের ‘বার্মিজ ডেজ’ উপন্যাসটির কথাই ধরা যাক। আমরা জানি, ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল ভারতে জন্মেছিলেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তিনি ছিলেন নিগূঢ়বিরোধী। তবু তঁার ‘বার্মিজ ডেজ’ উপন্যাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও রাজতন্ত্রের অন্তরসত্য ফুটিয়ে তুলতে তিনি যেসব নিষ্ঠুর ঔপনিবেশিক ভারতবিদ্বেষী শব্দ ব্যবহার করেছেন, সেগুলোকে রেখে দেওয়ার প্রয়োজনও তো অস্বীকার করা যায় না।
যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই ভি. এস. নয়পলের ভারত নিয়ে বই ‘অ্যান এরিয়া অফ ডার্কনেস’-এ কলোনিয়াল শব্দের অব্যর্থ প্রয়োগ। ‘রাজা’-‘রানি’, ‘রাজকুমার’-‘রাজকুমারী’, এসব তো রাজতন্ত্রের বাহক শব্দ। কিন্তু তা’বলে রূপকথা থেকে তাদের বাদ দিলে রূপকথার আর থাকে কী?