কিংশুক প্রামাণিক: বিজেপিকে হারাতে ২০১৯-এ বিরোধী জোট হয়নি। ২০২৪-এ হবে কি? ৫৪৩টি লোকসভা আসনে সত্যিই কি ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থী কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে দেওয়া সম্ভব?
সত্যি কথা বলতে কী, এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। বিরোধীরা কতটা একজোট, সেটাই পরিষ্কার নয় এখনও। যদিও চোরাস্রোত রয়েছে। এরই মধ্যে বোমা ফাটিয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভয়ংকর পুলওয়ামা কাণ্ড নিয়ে তাঁর বিস্ফোরক অভিযোগ। সত্যপাল সেদিন শ্রীনগরের রাজভবনে। ঘটে সড়কপথে ভয়াবহ জঙ্গিহানা। জওয়ানদের কেন বিমানে
আনা হল না, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, তখন তাঁর মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়। কেন বলা হয়?
সে-কথাই ফাঁস করেছেন সত্যপাল। মৌচাকে এভাবে ঢিল মেরে সত্যবাবু পালাবেন কোথায়! তৎক্ষণাৎ তাড়া করেছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। তাঁকে অবশ্য বাগে আনা যায়নি। দমে না-গিয়ে তিনি আরও কড়া অবস্থান নিয়েছেন। বলেছেন, “সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছি। ‘একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী’ দিতে সবাই একমত। যদি সেটা হয়, তবে দিল্লিতে বিজেপি বাঁচবে না। ওরা যদি ফের ক্ষমতায় চলে আসে তাহলে দেশ বাঁচবে না। সবার জীবনে সর্বনাশ নামবে।”
সত্যপালের এই কথন খানিক সত্য বটেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে বিজেপি যতটা অ্যাটাকিং খেলা শুরু করেছে, তৃতীয়বার ফিরলে তার গতি যে চারগুণ বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অভীষ্ট সব লক্ষ্য পূরণ করতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন শুধু মুঘল সাম্রাজে্যর পড়াশোনা লাটে তোলা বা ডারউইনের তত্ত্ব খারিজে বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হয় না। বহুত্ববাদের দেশ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত হবে। যেমন হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। রবীন্দ্রচিন্তায় ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ সোনার পাথরবাটির রূপ নেবে।
ফলে খুব আটঘাট বেঁধে বিজেপি ’২৪-এর যুদ্ধে নামতে চলেছে। যতদূর খবর, সামনের বছর রাম মন্দিরের উদ্বোধন করেই ভোটে যাবে গেরুয়া শিবির। সেক্ষেত্রে আগামীর লোকসভা লড়াই হয়তো কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসি-এমবাপের যুদ্ধকেও হার মানাবে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, পুলওয়ামায় সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা বিজেপিকে উনিশের ভোট জেতাতে সাহায্য করেছিল। পাক মদতপুষ্ট জইশ-ই-মহম্মদের হামলার পর তাজা জওয়ানের রক্তাক্ত লাশ দেখে দেশজুড়ে সহানুভূতির হাওয়া বয়ে যায়। কফিনবন্দি দেহগুলি যত দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছিল, তত ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত হয়েছিল ক্রোধের আগুন। এর মধে্যই বালাকোটে পাল্টা জঙ্গি শিবির গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি, অভিনন্দন বর্তমানের বন্দি হয়ে অাবার ফিরে আসা– এই বার্তাই দিয়েছিল যে নরেন্দ্র মোদি ‘লৌহপুরুষ’। তঁার হাতে দেশ নিরাপদ। উত্তর ভারত জুড়ে ভোটবাক্সে পদ্মফুলের জয়জয়কার হয়। এমনকী, বাংলার মতো রাজ্যে নজিরবিহীন ফল করে ১৮টি আসন পায় বিজেপি। অথচ পুলওয়ামার আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটে বিজেপির অনুকূল ছিল না। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্য বিজেপির হাতছাড়া হয়েছিল। গুজরাতে ক্ষমতা থাকলেও লড়াই হয়েছিল তুল্যমূল্য। পরবর্তী সময়ে গো-বলয়ে একের পর এক আসনের উপ-নির্বাচনে বিজেপি হারছিল। গোরক্ষপুর, ফুলপুরের মতো দুর্গ ভেঙে যাওয়া চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল বিজেপি নেতাদের। সবাই যখন মনে করছে লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদির জিতে আসা সম্ভব নয়, তখনই পুলওয়ামার ঝড়।
ঠিক যেমন হয়েছিল ১৯৮৪ সালে লোকসভা ভোটে। দেহরক্ষীর গুলিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রাণ হারানোর পর দেশজুড়ে এমন সহানুভূতির হাওয়া ওঠে যে, কংগ্রেস ৫১৬টি আসনের মধে্য একাই ৪০৪টি পায়। সেই জয় যে আবেগের ভোটে এসেছিল তা প্রমাণ হয়ে যায় পাঁচ বছর পর। ১৯৮৯ সালে লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের আসন নেমে অাসে ১৯৭-এ। বিরুদ্ধে জনতা দল ১৪৩, বিজেপি ৮৫ ও বামপন্থীরা ৩৩ আসন পায়। সবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে রাজীব গান্ধীকে সরিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। অর্থাৎ, পুলওয়ামা সহানুভূতির হাওয়ায় ৩০৩ আসন পাওয়া বিজেপি যে ২০২৪-এ ক্ষমতায় আসবেই, তা মনে করার কোনও কারণ নেই। কংগ্রেসের মতো তারাও ধাক্কা খেতেই পারে। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব– যখন সব বিরোধী দল এক ছাতার তলায় এসে বিজেপি বিরোধী কোনও মঞ্চ গড়তে পারবে। ‘একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী’ নিশ্চিত করতে পারবে। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি অাজ এতটাই ক্ষমতাশালী দল যে, কারও একার পক্ষে তাদের সরানো সম্ভব নয়। ভুলে গেলে চলবে না, রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে দেশের সব রাজনৈতিক দল এক হয়েছিল।
গো-বলয়ে জনতা দল ও বিজেপির সরাসরি জোট হয়। তাতে শামিল হয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশের তেলুগু দেশম নেতা এন. টি. রামা রাও, তামিলনাড়ুর করুণানিধি, অসমের অসম গণ পরিষদ। কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রীরাও সেই জোটে ছিল। ২ জুলাই শহিদ মিনারে জে্যাতি বসুকে মধ্যমণি করে মঞ্চে বসেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংরা। সেই জোটের ইতিহাস কেউ ভুলে যায়নি। মানুষ সমর্থন দিয়েছিল।
ফের সহানুভূতির হাওয়া উঠেছিল ১৯৯১ সালের লোকসভা ভোটের মাঝপথে শ্রীপেরামপুদুরে রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর। ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, কংগ্রেস ‘ম্যাজিক ফিগার’ প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।
রাজীব-হত্যার পরে যেখানে ভোট হয়েছিল, মূলত সেখানেই কংগ্রেসের জয়জয়কার। প্রধানমন্ত্রী হন পামুলাপর্তি ভেঙ্কট নরসিমা রাও।
[আরও পড়ুন: আতিক আহমেদের এনকাউন্টারে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন]
মজার কথা হল, সেই সময় লোকসভা ভোটের সঙ্গে এক বছর এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনও হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার চেয়েছিল বলে। বাংলায় ভোট হয় ২১ মে রাজীব হত্যার আগে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা অাক্ষেপ করেছিলেন, বিধানসভা ভোট রাজীবের মৃত্যুর পর হলে কিছুতেই বামফ্রন্ট জিতত না। সহানুভূতির হাওয়ার ’৯১-এই পরিবর্তন এসে যেত মহাকরণে। এখন প্রশ্ন, ২০২৩-এর ভোটে বিরোধীরা কি সার্বিক ঐক্য গড়তে পারবে? ৫৪৩ অাসনে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থী হওয়া কোনও দিনই সম্ভব নয়। অবাস্তব ভাবনা। কিন্তু বিজেপি যে-যে রাজে্য শক্তিশালী সেসব রাজ্য অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, বিহার, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, ছত্তিশগড়, অসমে যদি সব অাসনে বিরোধীদের একটি করে প্রার্থী থাকে তাহলে কিন্তু বিরাট চাপে পড়ে যাবে গেরুয়া শিবির। বিরোধীদের ছত্রখান দশা হলেও পরিস্থিতির চাপে এবার একটু বেশি তাগিদ। কারণ, বিজেপির আগ্রাসনে সবাই আক্রান্ত। যে-কথা বলেছেন সত্যপাল। সেই প্রেক্ষিতে বিশ্বাসের সুতোয় কি সত্যিই বাঁধবে সব বিরোধী দলের মন? আশাবাদী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। তিনি বলেছেন, ‘সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ রয়েছে। সময়ে বিরোধী জোট টর্নেডোর রূপ নেবে।’ জোটের প্রথম মিটিংয়ের প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন জয়প্রকাশ নারায়ণের বিহারে। এই পর্যন্ত সবটাই ইতিবাচক দিক।
কিন্তু কংগ্রেস কী করবে? তারা কি দাদাগিরির পথ ছাড়বে? শরদ পাওয়ারের মতো শেষ মুহূর্তে ডুবিয়ে দেওয়া মানুষদের ভূমিকা কী হবে? নিজের দলের ভোটপ্রাপ্তির আশায় সর্বত্র প্রার্থী দিয়ে বসবেন না তো কেজরিওয়াল? নীতীশ কুমারকেও তো বিশ্বাস করা যায় না। তাই মনে হয়, আগে বিশ্বাসের ভিত পোক্ত হোক। মানুষ তবে ভরসা পাবেন। ইন্দিরা-রাজীবকে তারা-ই হারিয়েছে। নরেন্দ্র মোদিও অপরাজেয় নন।