shono
Advertisement

অমৃতকালের প্রার্থনা

ঘটনাময় সময় কাটতে চলেছে নতুন বছরে।
Posted: 02:47 PM Dec 29, 2023Updated: 02:47 PM Dec 29, 2023

নতুন বছর দোরগোড়ায়। এই বছরের তুলনায় আরও ঘটনাময় সময় কাটতে চলেছে নতুন বছরে। যেমন রয়েছে সাধারণ নির্বাচনের মতো বড় ঘটনা, তেমনই রয়েছে অলিম্পিক গেমস। আর একরাশ ধন্দ, চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা– অবশ‌্যই নতুন বছর নিয়ে। আগের বছরের চেয়ে যেন আরও ভালো কাটে। সেই প্রার্থনায় ধরা থাকল বিভিন্ন সমস‌্যা, সংকট– ভারত তথা বিশ্বব‌্যাপীর– যেগুলো থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই, পৃথিবীকে নতুন রূপে জাগরিত দেখতে চাই। কলমে রাজদীপ সরদেশাই

Advertisement

ঝঞ্ঝাময় একটা বছর শেষ হতে চলল। এবং খুব সম্ভবত, তার চেয়েও ঝোড়ো এক সময় আসতে চলেছে নতুন বছরে। তাই, ২০২৪-এ উন্নততর এক ভারত ও বিশ্বের উদ্দেশ্যে এ বছরের মতো শেষ প্রার্থনাটুকু রেখে যেতে চাই– ‘কবিগুরু’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই কবিতার আশ্রয় নিয়ে।

‘চিত্ত যেথা ভয়শূন‌্য, উচ্চ যেথা শির’– বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রর দেশে নির্বাচন যেখানে হবে প্রকৃত অর্থে স্বচ্ছ, দুর্নীতিহীন। নির্বাচন কমিশন যেখানে টি. এন. শেষন সুলভ কঠোরতার সঙ্গে নির্বাচন সামলানোর ধারা ফিরিয়ে আনবে, যেখানে ভারতের নির্বাচন কমিশন তাদের হারানো শিরদাঁড়া খুঁজে পাবে এবং নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান রূপে নিজেদের ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে। যেন এমন না হয়, হেরে গেলে পরে ইভিএম মেশিনের দোষ এবং জিতলে পরে সেই ইভিএম মেশিনই একদম সঠিকরূপে কার্যকর।

যেখানে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনী অভিযানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপ রাখবে বটে, কিন্তু কোনওভাবেই জাত ও ধর্মের নামে ইতর প্রতিশ্রুতি ও তরজার আশ্রয় নেবে না। যেখানে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনওভাবে জনতাকে উন্মত্ত করার মতো শত্রুতা ও বিরোধের পরিসর তৈরির চেষ্টা করা হয় না এবং তৈরি হলে পরে কঠোরভাবে তা রুখে দেওয়া হয়। যেখানে নির্বাচন-প্রার্থীকে বেছে নেওয়া হয় বুদ্ধিমত্তা-সততার নিরিখে, কোনও বংশপরম্পরার নেপথ‌্য পরিচয়ে নয়, পারিবারিক পরিচয় কিংবা জাতগত পরিচয় কোনওভাবে মানে রাখে না, বরং চরিত্রই হয়ে ওঠে মূল বিষয়। যেখানে নির্বাচনী রেউড়ি কিংবা টাকার খেলা কোনওভাবে রাজনীতির লড়াইকে কলুষিত করে না, এমনকী সেই লড়াই কখনওই তাদের পক্ষে যায় না যাদের সঙ্গে কেন্দ্রের ক্ষমতা ও সম্পদের যোগসাজশ রয়েছে। যেখানে বিজেতা প্রার্থী কেবলমাত্র তার সমর্থক শ্রেণির জন‌্য কাজ করে না, একইসঙ্গে সেই ভোটারদের হৃদয় জেতার জন‌্যও প্রয়াসী হয়, যারা তাকে ভোট দেয়নি।

যেখানে বিরোধী পক্ষর নেতৃত্বদের অতিষ্ঠ করার জন‌্য দেশের গোয়েন্দা দফতরগুলোকে ক্ষমতাসীন দল নিজের হাতিয়ার ও এজেন্ট রূপে ব‌্যবহার করে না। যেখানে গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ঠিক ততটাই কঠোর রূপে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে তদন্ত চালায়, যতটা বিজেপি-বিরোধী শাসিত রাজ্য তৎপর হয়ে থাকে। যেখানে এমন কখনওই হয় না যে, কোনও নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত খুব জোরদার হয়ে ওঠে যখন সেই নেতা বিরোধী পক্ষর হয়, আর যেই না সেই ব‌্যক্তি বিজেপি-ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে, সেই তদন্তে ধামাচাপা পড়ে যায়। যেখানে পুলিশ রাজনৈতিক স্বার্থে রুজু হওয়া বেআইনি গ্রেপ্তারকে অস্বীকার করে। 

যেখানে মহামান‌্য সুপ্রিম কোর্ট জনগণের স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকারের জন‌্য সর্বদা প্রয়াসী থাকে। যেখানে ‘জেল নয়, জামিন’-ই হয়ে ওঠে বিচারব‌্যবস্থার মূলমন্ত্র এবং বিচারাধীনদের বছরের পর বছর জেলে রাখা হয় না। যেখানে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল মামলাগুলো কোনও পক্ষপাতিত্ব বা চাপ ছাড়াই বিচার করা হয়। যেখানে প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতিগুলো শুধুমাত্র শক্তিশালী ও প্রভাবশালীদের জন্য নয়, আবশ্যিকভাবে প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য হয়।

[আরও পড়ুন: গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা]

যেখানে অযোধ্যায় রাম মন্দির রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আধিপত্যর প্রতীক হয়ে ওঠে না, সাম্প্রদায়িক সেতু নির্মাণের পরিবর্তে সম্প্রদায়কে মেরুকৃত করে না। যেখানে, মণিপুরে জাতিগত সংঘাতের দরুন একটা রাজ্য এবং তার জনগণের মধ্যে বিভাজনকে সুযোগ দেওয়া হয় না। যেখানে মেইতি এবং কুকি জনগোষ্ঠী একে-অপরকে সহানুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে ধরে এবং মিলেমিশে থাকা মণিপুরী পরিচয়ের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়। যেন নির্বাচন আয়োজিত হয় এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে শীঘ্রই রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে একটি সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন কাশ্মীরি মুসলিম এবং পণ্ডিতদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়, যার মাধ‌্যমে অতীতের সমস্ত ক্ষত সেরে যাবে।

যেখানে সংসদ– ভারতের গণতন্ত্রর মন্দির– সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যে আস্থার সম্পূর্ণ ভাঙনের কারণে কলুষিত হয় না। যেখানে সরকার সবসময় জবাবদিহির অবস্থানে থাকবে এবং বিরোধীরা হবে আরও কর্তব‌্যপরায়ণ। যেখানে গণ-পরিসরে সাসপেন্ড করা এড়ানো হয়, যেখানে প্ল্যাকার্ড নিয়ে সংসদের গর্ভে প্রবেশে নিরুৎসাহিত করা হয়। যেখানে বিশদ আলোচনার পরেই গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলো পাস করা হয়, যেখানে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিরোধী পক্ষর মধ্যে সংলাপের অভাবের কারণ হয় না কোনওভাবেই।

যেখানে জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণের পরিধি এমনভাবে প্রসারিত করা হয় না যা কেবল সমাজের ফাটলকে আরও প্রসারিত করে। যেখানে নিয়োগ পরীক্ষায় পেপার-ফাঁস যেন লাখ লাখ তরুণ চাকরিপ্রার্থীর স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস না করে। যেখানে রাজ্য জুড়ে পরীক্ষা-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেখানে আরও বেশি সরকারি চাকরি দেওয়ার তুলনায় বেসরকারি ক্ষেত্রকে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়াতে উৎসাহিত করা হয়। যেখানে অর্থনীতি সংক্রান্ত মূল তথ‌্য ঢাকাচাপা দেওয়া হয় না বা অস্বচ্ছ রাখা হয় না, বরং নিয়মিত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপলব্ধ থাকে। যেখানে জাতীয় সম্পদ একচেটিয়া আধিপত‌্য নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে হস্তান্তর করা হয় না, বরং স্বচ্ছ দরপত্রর মাধ্যমে নিলাম করা হয়। যেখানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার উচ্চাশা দুর্দান্ত বটে, তবে আয় বৈষম্য হ্রাস করা আরও প্রশংসনীয় উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।

যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে দেউলিয়া করে না, যা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ফুরিয়ে যাবে। যেখানে একটি দলের ‘রেউড়ি’ বা ভরতুকি অন্য দলের কল্যাণমূলক প্রকল্পে পরিণত হয় না। যেখানে উচ্চমানের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুবিধায় বিনিয়োগই মূর্তি ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পায়। যেখানে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টির মধ্যে ভারতের অন্তত আধডজন বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, যেখানে কিনা এই মুহূর্তে একটিও এমন বিশ্ববিদ‌্যালয় নেই। যেখানে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল সাধারণ নাগরিকদের নাগালের বাইরে নয়। যেখানে প্রতিটি নাগরিকের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা একটি জাতীয় মিশন হয়ে ওঠে। যেখানে, হিমালয় অঞ্চলের ব্যাপক পরিবেশগত ধ্বংসর অনুমতি দিয়ে আমরা একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের অধিবেশনে শীর্ষস্থানীয়
‘গ্রিন ওয়ারিয়র’ রূপে নিজেদের দাবি করি না।

[আরও পড়ুন: ‘কৃবু’, ‘নবু’, না ‘এআই’?]

যেখানে নারীর ক্ষমতায়ন শুধু একটি স্লোগান নয়, বরং অঙ্গীকার হয়ে ওঠে। যেখানে ভারতের ২৯টি রাজ্যে অবশ্যই একাধিক নারী মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন। যেখানে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত একজন সাংসদকে মুলতুবি তদন্ত থেকে সরে যেতেই হবে, যেখানে অলিম্পিকে জেতা কুস্তিগিরদের নিজের কথা পৌঁছে দিতে রাস্তায় নামার প্রয়োজন পড়বে না। যেখানে জনপ্রতিনিধিদের আরও লিঙ্গ সংবেদনশীল হতে উৎসাহিত করা হয়, যেখানে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ দ্রুত তদন্ত করা হয়।
যেখানে ইজরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা গাজার জনগণকে নিশ্চিহ্ন করা এবং মানবিক বিপর্যয়কে সমর্থন করে না। যেখানে প্রতিশোধমূলক বোমা হামলা আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লঙ্ঘন হয়ে ওঠে না। যেখানে একজন নিষ্পাপ প‌্যালেস্তিনীয় শিশুর জীবন একজন ইজরায়েলি শিশুর জীবনের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

যেখানে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক রূপে ভারত উদ্‌যাপন করবে বটে, কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রাসঙ্গিকতা হল বিশ্ব ফোরামে নৈতিক সাহসের শক্তি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরা, যদি সত্যিই আমরা গ্লোবাল সাউথের সত্যিকারের নেতৃত্বের অপেক্ষা করে থাকি। যেখানে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে ব্যক্তিগত তারকা পারফরম্যান্সের জন্য নয়, বরং ‘টিম ইন্ডিয়া’ হিসাবে সম্মানিত করা হয়, যে-দল কিনা টানা দশটি বিশ্বকাপের ম‌্যাচ জিতেছে। যেখানে আইপিএল নিলামে কোন খেলোয়াড় কত টাকা পেল, তা নিয়ে আচ্ছন্ন হওয়ার পরিবর্তে সারা দেশে জুনিয়র লেভেলের ক্রিকেটে কত টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখায় জোর দেওয়া হয়। যেখানে আমরা একটি অলিম্পিক বছরে প্রবেশ করছি, সেখানে আমাদের অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ এবং তাঁদের অর্জনকে যেন অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে পারি। যেন আমরা অলিম্পিক গেমসে আগের চেয়ে বেশি পদক জিততে পারি। একজন নীরজ চোপড়াকে দেখে যেন ভবিষ্যতের আরও অনেক চ্যাম্পিয়ন জন্ম নিতে পারে। তেমনই এক ‘অমৃতকাল’-এর স্বর্গে স্বাধীন ভারত ও বিশ্বকে জাগরিত যেন দেখতে পারি।

পুনশ্চ এবং অবশেষে মিডিয়া বর্গের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে একটি প্রার্থনা– বিশেষ করে টেলিভিশনের মিডিয়ার সদস্যদের– আসছে বছরের বড় নির্বাচন সামনে রেখে। আমরা যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমান-সমান খেলার ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পারি। আমরা কারও তোষামোদ করব না, বা কারও প্রতিপক্ষও হব না। বরং আমাদের যা হওয়া উচিত, সেটাই যেন ভালোভাবে হতে পারি, আর তা হল: উত্তেজনাপূর্ণ সময়ের লিপিকার। 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement