‘নিট’ ও ‘নেট’-এর দুর্নীতির শিকড় যে অনেক গভীরে, তা গোড়াতেই টের পাওয়া যাচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁসের যে-ঘটনাটি সামনে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে চক্রের চাঁইরা ৩০-৩২ লক্ষ টাকায় প্রশ্ন বিক্রি করেছে। নিটে ৬৭ জনের ৭২০ পাওয়া এবং ‘র্যাঙ্ক ইনফ্লেশন’ দুর্নীতিকে প্রকাশ করে দিল। লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
প্রবেশিকা ও চাকরির পরীক্ষা ঘিরে দেশে প্রশ্নপত্র ফঁাস, উত্তরপত্র তৈরি ইত্যাদির চক্রটি কীভাবে কাজ করে, তা নিট ও নেট দুর্নীতি ফের সামনে নিয়ে এল। পিঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো এখন এই দুর্নীতির একের-পর-এক মোড়ক ছাড়ানোর ঘটনা ঘটেই চলবে। দুর্নীতির শিকড় যে অনেক গভীরে, তা গোড়াতেই টের পাওয়া যাচ্ছে। দাবি উঠেছে, এক্ষেত্রেও তদন্তকারীদের দুর্নীতির মাথা পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তে সবসময় কান টানলে মাথা আসে না। ফলে, এই দুর্নীতির মাথা পর্যন্ত আদৌ পৌঁছনো যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়। কিন্তু মাথা পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই যে বড়-বড় চক্র জালে পড়বে, তা নিয়ে সংশয় নেই। সিবিআই তদন্তভার নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধে্যই এই দুর্নীতিতে জঙ্গি-যোগ চলে এসেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, জাল কত দূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
আটের দশকে রাজীব গান্ধী (Rajiv Gandhi) যখন নয়া শিক্ষানীতি করে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদির পঠনপাঠনে ঢালাও বেসরকারিকরণের রাস্তা তৈরি করেছিলেন, তখনই আশঙ্কা করা গিয়েছিল যে, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসার সাম্রাজ্য এক বিপুল চেহারা নেবে। যদিও বেসরকারি মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রাজে্য-রাজে্য অাটের দশকের গোড়া থেকেই তৈরি হচ্ছিল। রাজীব গান্ধীর নয়া শিক্ষানীতি অাসে ১৯৮৬ সালে। মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির জন্য চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা থাকার কারণে অাশঙ্কা দানা বঁাধে, হাজার-হাজার কোটির ব্যবসার হাত ধরে অাসবে নানা ধরনের দুর্নীতিও। তার সুযোগ নেবে কিছু অসাধু লোক। মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষাকে ঘিরে যে-ব্যবসা, সেখানেও এখন হাজার-হাজার কোটি টাকার হাতবদল হচ্ছে।
[আরও পড়ুন: মাছ ধরতে যাওয়াই কাল! আচমকা পাথরপ্রতিমার নাবালককে টেনে নিয়ে গেল কুমির]
নিট ও জয়েন্ট মেইন্সের মতো প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিতে শুধুমাত্র রাজস্থানের কোটাতেই ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। পুরো দেশে প্রবেশিকা পরীক্ষার কোচিং দেওয়া সংস্থাগুলির ব্যবসা হয়তো লক্ষ কোটি টাকা ছাড়াবে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়তে কোটি টাকার উপর খরচ লাগে। বেশ কিছু বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও লক্ষ-লক্ষ টাকা টিউশন ফি নেয়। এসব কলেজে পড়ার জন্য যারা বিস্তর টাকা খরচ করে, তারা যে প্রবেশিকা পরীক্ষার সফল হওয়ার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকবে, তা বলা বাহুল্য। নিটের প্রশ্নফঁাসের যে-ঘটনাটি সামনে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে চক্রের চঁাইরা ৩০-৩২ লক্ষ টাকায় প্রশ্ন বিক্রি করেছে।
প্রবেশিকা পরীক্ষায় যে এই প্রথম প্রশ্নপত্র ফঁাস হল, তেমনটা নয়। কারণ, এই সূত্রে উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh) থেকে ‘সলভার গ্যাং’-এর যে মূলচক্রীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, সে এর আগেও প্রশ্নপত্র ফঁাসের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে। দেব অরিত্র নামে ওই মেধাবী যুবক প্রায় দু’-দশক ধরে প্রশ্নপত্র ফঁাস, ভুয়া পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষা দেওয়া, উত্তর তৈরি করে দেওয়া ইত্যাদিতে যুক্ত। কোটায় বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের কাছেও সে একটি পরিচিত মুখ। তদন্তকারীরা তার পরিবারের সূত্রেই জেনেছে যে, ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে এই জালিয়াতি ব্যবসাকে পেশা হিসাবে নিয়ে অরিত্র রীতিমতো ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।
[আরও পড়ুন: ভারসাম্যের খেলা বর্ষার! উত্তরে অতিবৃষ্টি, কত ঘাটতি দক্ষিণবঙ্গে? হিসেব দিল হাওয়া অফিস]
অরিত্রর মতো চরিত্ররা যখন এক দশকের বেশি সময় ধরে সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন বোঝা-ই যায় যে, নিট ও নেটের প্রশ্নপত্র ফঁাসের এই ব্যবসা নতুন কিছু নয়। অার রাজনৈতিক প্রশ্রয়পুষ্ট না-হলে যে এই ধরনের ব্যবসা বছরের পর বছর চালানো যায় না, তা কে না বোঝে! ফলে যতই তদন্ত হোক, তদন্তকারীদের পক্ষে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যথেষ্ট কঠিন। নেটের পর নিট দুর্নীতির তদন্ত হাতে নিয়ে সিবিঅাই খুব তৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু এই তৎপরতা কতদিন চলবে, তা নিয়ে সংশয় দেখানোর যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
৬৭জন ৭২০ তথা ফুল মার্কস না-পেলে হয়তো এবারও নিট দুর্নীতি পুরোপুরি আড়ালে চলে যেত। ৬৭জনের ৭২০ পাওয়াটা প্রত্যেকের মনে সন্দেহের বীজ বুনে দেয়। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে নিটে ৭২০ পেয়েছিলেন মাত্র দু’জন। ২০২২ সালে কেউ ৭২০ পাননি। তা’বলে ২০২২ বা ২০২৩ সালে নিটে কোনও দুর্নীতি হয়নি, সে-কথা হলফ করে কেউ বলতে পারবে না। কারণ, যে-চক্রগুলি এবার দুর্নীতি করেছে, তারা ২০২২ বা ’২৩-এ হাত গুটিয়ে বসেছিল– এমনটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।
লোকসভা ভোটের ফলের দিন আচমকা নিটের ফলপ্রকাশ করা হয়েছিল সব বিতর্ককে আড়াল করতে। কিন্তু ৬৭জনের ৭২০ পাওয়া এবং ‘র্যাঙ্ক ইনফ্লেশন’ পুরো দুর্নীতিকে প্রকাশ করে দিয়েছে। নম্বর দেখে প্রাথমিকভাবে পড়ুয়ারা বুঝতেই পারেননি কী স্তরের দুর্নীতি ঘটেছে। যিনি এবার ৬৫০ পেয়েছেন, তিনি ছয়-সাত হাজার র্যাঙ্ক আশা করে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রথম দিন। কিন্তু পরের দিনই তিনি জানতে পারেন ৬৫০ নম্বর পেয়েছেন এবার ৫০ হাজারের বেশি পডুয়া। ফলে ভাল কোনও সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির কোনও আশাই নেই। ‘র্যাঙ্ক ইনফ্লেশন’-এর জেরে অাশাভঙ্গ হয়ে ২৪ ঘণ্টার মধে্যই গোটা দেশে হাজার-হাজার নিট পরীক্ষার্থী বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নামেন। তাতেই এই দুর্নীতির চক্র এইভাবে প্রকাশে্য চলে আসে।
এর পরও নিট দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে। পরীক্ষার দিনই বিহার পুলিশ প্রশ্নপত্র ফঁাসের অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছিল। অথচ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান সেই ঘটনাটাকে গুরুত্বহীন করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। পড়ুয়াদের বিক্ষোভের আগুন ধীরে ধীরে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়াতেই কেন্দ্র কিছুটা চাপে পড়ে। এখনও নিট বাতিল হয়নি। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের হাতে গিয়েছে বলে সরকার দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ ২৪ ঘণ্টার মধে্য বাতিল হয়েছে ইউজিসি-নেট পরীক্ষা। অনুষ্ঠিত হয়নি সিএসআইআর-ইউজিসি-নেট ও নিট-পিজি। সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) ৮ জুলাই নিট-ইউজি নিয়ে শুনানি। অনেকে মনে করছেন, শীর্ষ আদালতে পুনরায় নিট পরীক্ষা গ্রহণের পক্ষে রায় হতে পারে। যদিও সরকার তার অাগেই ফের নিট পরীক্ষা নেওয়ার কথা ঘোষণা করতে পারত। সুপ্রিম কোর্ট কয়েক দিন আগে নিট-ইউজির তদন্তে সিবিআইয়ের দাবি খারিজ করেছিল। কিন্তু সরকার মুখরক্ষা করতে সংসদ শুরু হওয়ার অাগে নিট তদন্ত সিবিআইকে দিয়ে দিল। ফলে ফের নিট পরীক্ষা হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্তও সুপ্রিম কোর্টের ঘাড়ে ঠেলার কোনও কারণই নেই।
সর্বভারতীয় স্তরের প্রবেশিকা ও চাকরির পরীক্ষার প্রতি আস্থা ফেরানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিট (NEET), নেট (NET) দুর্নীতিতে পড়ুয়া এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ভীষণভাবে ধাক্কা খেয়েছে। স্বচ্ছতার সঙ্গে আবার নতুন করে নিট পরীক্ষাই কিন্তু একমাত্র আস্থা ফেরানোর একটি রাস্তা হতে পারে।