shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: ‘র‌্যাগিং’-এর জন্ম

কোথা থেকে এল র‌্যাগিং রোগ?
Posted: 06:02 PM Aug 14, 2023Updated: 06:02 PM Aug 14, 2023

যাদবপুর বিশ্ববিদ‌্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রমৃত্যুর ভয়াবহ ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিল ‘র‌্যাগিং’ নিয়ে। র‌্যাগিংয়ের শুরু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। পাড়া-পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রত্যন্ত সীমান্তের নির্জনতম এলাকায় দিনের পর দিন পড়ে থাকা সেনাদের প্রবণতা জন্মায় র‌্যাগিংয়ের। হস্টেলের র‍্যাগিংয়ের উৎস ও বিস্তারের হেতুও অবিকল সেটাই। কলমে শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

Advertisement

স্টেল-জীবনে সিনিয়র হয়ে যাওয়া মানেই ‘বেঁচে ছিলাম বলেই সবার কিনেছিলাম মাথা’! কিন্তু সেই মাথা কিনতে গিয়ে যে ‘ঝরছে কী খুন’- হস্টেলে না থাকলে সেটা বোঝা খুব মুশকিল। অথচ, তা বোঝা না গেলে তো র‍্যাগিংয়ের রোগটা সারানোও যাবে না।

সংখ্যাগুরু মানুষই চায় ‘র‍্যাগিং বন্ধ হোক’। তবে প্রশ্নটা তাদের নিয়ে, যারা চায় ‘র‍্যাগিং চলুক’। আর দুর্ভাগ‌্যজনক, বোধহয় এই একটিমাত্র বিষয়েই সংখ্যালঘুরা যা ভাবে, তা-ই চলতে থাকে বছরের পর বছর! কেন, কীভাবে? ‘মাস সাইকোলজি’-তে সিগমুন্ড ফ্রয়েড লিখছেন, ‘ক্ষমতার বড়াই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিকতা হল, তার হিংস্র আস্ফালন। এই জাহিরগিরিটাই মনোরোগের উপসর্গ।’ এই লক্ষণটা এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-একরকম হয়। তাই ক্ষমতাবান হয়েও কেউ হয় ক্ষমাশীল, আর কেউ হয় খড়্গহস্ত। কেউ কেউ কথায় কথায় যুদ্ধ চায়, মারপিট চায়। কেউ কেউ শুধু তর্কযুদ্ধ চায়, কেবল ‘যুক্তির মার’ মারে।

ইতিহাস বলে, ওই যুদ্ধ দিয়েই কিন্তু ‘র‍্যাগিং’ শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দেশে ফিরে ফরাসি সেনাবাহিনী এই পৃথিবীতে প্রথম সমাজজীবনে র‍্যাগিংয়ের ফিতে কেটেছিল, যার নাম ছিল ‘বিজুতেজ’। এই র‍্যাগিং রেসের সেকেন্ড বয় ছিল শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী। যুদ্ধফেরতা তারাও সমাজে ওই সংক্রমণ ঘটিয়েছিল ‘রাকিন’ নাম দিয়ে। পরাধীন ভারতে র‍্যাগিং আমদানি করেছিল যুদ্ধফেরত ব্রিটিশ ফৌজ। ইউরোপকে অন্ধের মতো অনুসরণ করে পৃথিবীর স্বঘোষিত ‘সভ্যতম’ আমেরিকাতেও র‍্যাগিং ঢুকিয়েছিল জওয়ানরাই, ‘হ্যাজিং’ নাম দিয়ে। ঠান্ডা যুদ্ধের পর রাতারাতি ‘সামন্ত প্রভু’ বনে যাওয়া আমেরিকা, ইংরেজদের তৈরি ‘হ্যাজিং’ শব্দটা মুছে ‘বুলিং’ শব্দটা বাজারে ছেড়ে দেয়!

যাকগে, নামে কী এসে যায়! বরং দেখা যাক, যে ‘সেনাবাহিনী’ দেখলেই আমরা দেশপ্রেমে গদগদ হয়ে যাই, তারা র‍্যাগিং চালু করল কেন? পাড়া-পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রত্যন্ত সীমান্তের নির্জনতম এলাকায় দিনের পর দিন পড়ে থাকা। বিনোদন বলতে তাই এর-তার পিছনে লাগা, একে-তাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপের নাম করে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা। এবার কারা র‍্যাগিং করবে, আর কারা তার শিকার হবে- তা ঠিক করবে পেশাগত ক্ষমতা। মজা লোটার নাম করে ঊর্ধ্বতনরা অধস্তনদের দিয়ে নানা শ্লীল-অশ্লীল ফাইফরমাশ খাটিয়ে নেবে। বিত্ত-বিদ্যা-আদবকায়দায় পিছিয়ে থাকা জওয়ানরা ভয়ে, কুণ্ঠায় জড়োসড়ো হয়ে থাকবে। তাতেই মেজর বা কর্নেলদের ‘গোবধে আনন্দ’। তবে সব সেনাকর্তা তো অমন নয়, কেউ কেউ ওরকম। যারা ওরকম, তারা চিকিৎসা না পাওয়া মনোরোগী। এই রোগীদের সমস্যা হল, তারা নিজেদের অসুস্থতার কুফল চাপিয়ে দেয় অন্যের উপর।

হস্টেলের র‍্যাগিংয়ের কার্যকারণ, উৎস এবং বিস্তারের হেতুও অবিকল সেটাই। লিখছেন গুলশন নবীন, তাঁর ‘র‍্যাগিং: দ‌্য রেড অ্যালার্ট’ বইয়ে। তিনি লিখছেন, হস্টেলের সব সিনিয়র র‍্যাগিং করে না। র‍্যাগিং করে তারা-ই, যারা পাড়ার নেড়ি কুকুরটার লেজে পটকা বেঁধে ফাটিয়ে, একটা নিরীহ পশুর হাহাকারে উল্লাসে মাতে। কিংবা যারা একটা জ্যান্ত ফড়িংকে দেশলাইয়ের বাক্সে পুরে জ্বলন্ত উনুনে ছুড়ে ফেলে দেয়। যারা হস্টেলে র‍্যাগিং করে, তারা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে গণপিটুনি চলছে দেখলেই, কারণে-অকারণে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ভিড়ের একজন হয়ে যায়। কাজেই র‍্যাগিং কোনওভাবেই একটা ‘ব্যবস্থা’ নয়, বরং একটা অসুস্থ মনোবৃত্তি। সমস্যা হল, এই রোগ বড় সংক্রামক। মর্মান্তিক, অ-শনাক্ত এবং চিকিৎসাহীন ট্রমার কারণে যারা ‘র‍্যাগ্‌ড’ হয়, তাদের কেউ কেউ নিজে সিনিয়র হওয়ামাত্র অকথ্য র‍্যাগিং শুরু করে। ঠিক যেমনভাবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিতা নতুন বউ, নিজে শাশুড়ি হওয়ার পর মনের ঝাল মেটাতে বধূ নির্যাতন শুরু করে। কাজেই একটা ট্র্যাজিক ট্র্যাডিশন শৃঙ্খল-প্রক্রিয়ায় চলতেই থাকে। আবহমান র‍্যাগিংয়ের মস্ত বড় কারণ এটাই।

গুলশনের মতে, এর আর-একটা কারণ হল, ‘সোশ্যাল পারমিসিবিলিটি’। যারা র‍্যাগিং করে, তাদের বাবা-মায়েরা বলেন, ‘ছেলেমানুষরা ওরকম একটু-আধটু করে।’ ঠিক যেভাবে, কোনও শিক্ষক বা অভিভাবক ছাত্র বা ছেলেমেয়েদের পেটালে আমরা বলি, ‘একটু-আধটু শাসন তো করতেই হবে।’ কোনও কোনও ফাস্ট বোলার উইকেট নিতে না পারলে রাগের চোটে বাউন্সার ছুড়ে ব্যাটারকে জখম করে দেন। পা থেকে বল কেড়ে না নিতে পারলে কোনও কোনও স্টপার আক্রোশে ল্যাং মেরে উইঙ্গারের পা ভেঙে দেন। আমরা বলি, ‘পার্ট অফ দ‌্য গেম’। মানে, যেন এটাই পৌরুষ।

[আরও পড়ুন: বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বাঙালির মুখে]

এই ‘স্যাডিস্ট’ পৌরুষ থাকে না বলেই মেয়েদের হস্টেলে র‍্যাগিং কম হয়। নিজেদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকে মেয়েরা সবার কাছে শাসিত হয়। সেটা তাদের অভ্যাসও হয়ে যায়। তারা নিজেরই অজান্তে একটা পারমিসিবিলিটিতে চলে যায় যে, বংশতিলক হিসাবে পরিবারের শাসক ছেলেরাই। ক্ষমতায়নের অভ্যাস না থাকায় মেয়েরা হস্টেলে গিয়েও অনেক সময় টেরই পায় না যে, র‍্যাগিংয়ের মধ্যে একটা ‘নিষিদ্ধ’ আনন্দ আছে। এই পারমিসিবিলিটি ক্রমশ একটা পরম্পরা, একটা হেরিডিটি হয়ে ওঠে। আর সমাজের অন্য সব ব্যবস্থার মতোই, এই পারমিসিবিলিটিও পুরুষদের প্রতি পক্ষপাত করে। ছেলেরা বুঝে যায় যে, ইচ্ছা করলেই বাড়ির সবাইকে তড়পানো যায়। সেই ছেলেদের কেউ কেউ হস্টেলে গিয়ে ওই মানসিক ও শারীরিক বলপ্রয়োগের শিকার হিসাবে জুনিয়রদের বেছে নেয়। সেই ছেলেটাই হস্টেল থেকে বেরিয়ে হয় বউকে নয় অফিসের কর্মীকে টার্গেট করে।

র‍্যাগিং এতটাই ব্যাপক। এটা শুধু হস্টেলে হয় না। র‍্যাগিংয়ের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া হস্টেলগুলি আসলে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক নির্যাতন-প্রবণ সমাজেরই একটা ইউনিট বা একক। আপাতভাবে অনেকে ডায়াগনসিস করতেই পারেন যে, র‍্যাগিংয়ের নেপথে‌্য মূল কারণ, রাজনৈতিক মদত এবং প্রশাসনিক ঢিলেমি। এটা অংশত ঠিক বটে। তবে আবারও, হস্টেলের অধিকাংশ বহিরাগত বা অবৈধ আবাসিক কিন্তু র‍্যাগিং চায় না। বেশিরভাগ ছাত্র-নেতাই র‍্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে। তবু র‍্যাগিং চলতেই থাকে। হস্টেলে ভর্তির সময় মুচেলকা লিখিয়ে, সিসিটিভি বসিয়ে, দিনে একবার রাউন্ড দিয়ে র‍্যাগিং বন্ধ করা যাবে না। ঘরে না হলে বারান্দায় কিংবা শৌচাগারে অথবা আহার-কক্ষে নানাভাবে চোরাগোপ্তা র‍্যাগিং চালিয়ে যাবে কিছু ছাত্রের অন্ধকার মন। ইভটিজিং যেমন শুধু পুলিশ দিয়ে নির্মূল করা যাবে না, তেমনই প্রশাসন বা আদালতকে দিয়ে র‍্যাগিংয়ের পূর্ণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ফ্রয়েড লিখেছেন, ‘র‍্যাগিং ইজ আ ফর্ম অফ সিরিয়াল কিলিং।’

তাহলে উপায়? ছাত্রদের বুঝতে হবে, হস্টেল-মেট দুই ধরনের হয়, মানুষ আর অমানুষ। পুরুষও দুই ধরনের হয়, রক্ষক আর ভক্ষক। মা-বাবাদের শিশুকালেই ছেলেদের শিখিয়ে দিতে হবে, সংহার নয়, সখ্য-ই পথ। চ্যাপলিন বলতেন, ‘শুধুমাত্র ক্ষতি করার জন্যই ক্ষমতা দরকার হয়। তাছাড়া আর সবকিছুই করা যায় ভালবাসা দিয়ে!’

[আরও পড়ুন: শহরের রসদ জোগায় গ্রাম, চাঙ্গা করতে হবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement