ইদ-এ-মিলাদ। চুপিসাড়ে, ধীর পায়ে এসে কড়া নাড়ল এই শীতের সকালের দরজায়। ধাক্কা দিতে থাকল বিস্মৃতির খড়খড়িতে। সেই খড়খড়ি খুলতেই, শার্সির ফাঁক দিয়ে ইতিহাসের পথ ছুঁয়ে মনের মধ্যে এসে পড়ল সোনালি রোদের বেলা। আর ঝড় উঠল মরুপথের ধুলো উড়িয়ে। তার মাঝে কী ভাবে লুকিয়ে রইল নবি হজরত মহম্মদের জন্মদিন, সেই মিলন-বিরহের উদযাপনের গান গাইলেন অনির্বাণ চৌধুরী
নীরদ সি চৌধুরি একদা তাঁর বইতে বেশ কড়া ভাবেই আঙুল তুলেছিলেন বাঙালির দিকে। বলেছিলেন, বাঙালি না কি আত্মবিস্মৃত জাতি! হবেও বা! তা নইলে আজ কার জন্মদিন, তা আমাদের খেয়াল থাকে না কেন?
ডিসেম্বরে জন্মদিন বললেই সবার আগে মনে পড়ে যায় সেই সুপুরুষ সন্তের কথা। তিনি ঈশ্বরের আপন পুত্র। তার পরেও তাঁর শরীরে কত ধুলোবালি, মায়ের স্নেহ, শাসকের অত্যাচারের ক্ষত। আপন নারীর প্রেমের ছোঁওয়াও কি একেবারেই ছিল না সেই শরীরে? যদিও সে বড় বিতর্কের কথা। কিন্তু সেইসব বিতর্ক আর বিশ্বাস নিয়েই একজোটে ডিসেম্বরে মনে করিয়ে দেয় যিশু খ্রিস্টকে। হলেই বা মাসের শেষে জন্মদিন, উৎসবের তোড়জোর শুরু হয়ে যায় মাস পয়লা থেকেই।
আর তারই ভিড়ে একটু একটু করে কোণঠাসা হতে থাকে নবি হজরত মহম্মদের জন্মদিনের কথা। তাঁরও তো জন্মদিন এই মাসেই। সূক্ষ্ম হিসেবের পথ পেরিয়ে এসে ঠিক আজকের দিন- এই ১২ ডিসেম্বর। মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশ, বনু হাশিম গোত্র। কিন্তু তা আমাদের খেয়াল থাকে না কেন?
মনোস্তত্ত্ব বলে, আমরা তা-ই ভুলে যাই, যা মনে রাখতে চাই না। কিন্তু ভারতের মতো একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশে হিসেবটাও এতটাও সহজ নয়। এই দেশ যেমন হিন্দুর উৎসবে মাতে, তেমনই খ্রিস্টানের পরব পালন করে ধুমধাম করে। পাশাপাশি মিছিল করে হেঁটে যায় শিখ-বৌদ্ধ-জৈনের গুরুত্বপূর্ণ তিথি আর তার জাঁকজমকও। ইসলামি পরবেও কি আর ছুটি থাকে না? থাকে তো! ইদের কথা ভুলে গেলে চলবে কেন? তাছাড়াও আছে মহরম, শব-এ-বরাত! সেই সব যখন ভুলে যাচ্ছি না, তখন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক নবির জন্মদিনে এমন উদাসী হাওয়া কেন?
একটা কারণ হতে পারে জন্মদিনটি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতপার্থক্য। অনেকে বলছেন, হজরত মহম্মদ জন্ম নেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট। আরবি রবিউল আওয়াল মাস ধরলে তার ১২ তারিখে। কিন্তু এই নিয়ে কোনও সঠিক ধারণায় পৌঁছনো সহজ নয়। কেন না, নবি নিজে তাঁর জন্মদিনটি নিয়ে কিছু বলে যাননি। ঐতিহাসিকরা এমন নিদর্শনও দেখাতে পারেন না যেখানে নবির জীবদ্দশাতেই তাঁর জন্মদিনের উৎসব পালন করা হচ্ছে!
না-ই বা পালিত হল নবির জীবদ্দশায় তাঁর জন্মদিনের উৎসব। যে কোনও ধর্মের দিকেই যদি তাকাই- সব জায়গাতেই চোখে পড়বে একই ছবি। কোনও ধর্মপ্রবর্তকই তাঁর জন্মদিন পালন নিয়ে মাতামাতি পছন্দ করেননি! খ্রিস্ট জীবিত থাকতে থাকতে তো শুরু হয়নি বড়দিন পালনের এমন ধুমধাম। বা, গুরু নানক, গৌতম বুদ্ধ- কেউই বেঁচে থাকতে থাকতে নিজের জন্মদিন পালনের উৎসবে অনুরাগীদের উৎসাহ দেননি।
এই সব ধর্মপ্রবর্তকদের জন্মদিন পালন শুরু হল তখন, যখন তাঁরা আর এই পৃথিবীর জল-হাওয়ায় নিশ্বাস নিচ্ছেন না। তাঁরা চলে গিয়েছেন অমৃতলোকে। অনুরাগীরা স্বাভাবিক ভাবেই দিশাহারা! এত দিন তাঁদের অভ্যাস ছিল মহামানবটিকে চোখের সামনে দেখা, কোনও সমস্যা হলেই তাঁদের উপদেশ গ্রহণ। সেই সব উপদেশ যদিও হারিয়ে যায়নি। তা যথেষ্ট যত্নেই ধরা রয়েছে একের পর এক ধর্মগ্রন্থে। কিন্তু, মানুষটা তো আর চোখের সামনে নেই! ফলে, শুরু হল এমন একটা বিশেষ দিনের সন্ধান, যে দিন তাঁকে স্মরণ করা হবে অন্য দিনের চেয়ে আলাদা করে। সেই দিনটা জন্মদিন ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে!
নবির বেলাতেও তাই হল! জীবদ্দশায় তিনি স্থাপন করে গেলেন একের পর এক ভিত্তিপ্রস্তর। কখনও ধর্মের, কখনও আদর্শ জীবনচর্যার, কখনও বা রাজনীতির। কেন না, নিজের ধর্মাচারণের কথা জোর গলায় বলতে গেলে, তাকে একটি সুমহান পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে বিশাল এক জনতার সমর্থন প্রয়োজন। প্রয়োজন এক সম্মিলিত সহাবস্থানের। যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া আর কী ভাবেই তা সম্ভব? কেন না, যাঁরা নিজে থেকে স্বতস্ফূর্ত ভাবে কোনও একটি বিশেষ ধর্মকে বেছে নিচ্ছেন না অথচ প্রয়োজন সেই ধর্মের বিস্তারের, সেক্ষেত্রে কিছুটা গা-জোয়ারি বাধ্যতামূলক। তা হিন্দুরা করেছে, মুসলমানরা করেছে, করেছে খ্রিস্টানরাও। তার পরেও খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক কাছের মানুষ, অথচ নবি কেন রইলেন দূরেই? ভারত কি তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ধর্মনির্লিপ্ত হয়ে গেল?
প্রশ্নের উত্তর আসবে বেশ অস্বস্তিকর পথে। যদি এই দেশের কথাই ধরতে হয়, তাহলে আমরা দেখব- ইসলামি শাসকদের অত্যাচারের বহর ছিল কিছু বেশিই! জোর করে ধর্মান্তরিত করা, বিজাতীয়র রমণী এবং সম্পদ বলপূর্বক হরণ- বাদ যায়নি কিছুই। খ্রিস্টান শাসকরা সেইসব কাজ করেছেন বেশ কায়দা করে। সরাসরি ধর্মের পথে না এগিয়ে, অনেক বেশি রাজনীতির পথ ধরে। তার উপরে আবার ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল- হিন্দু আর মুসলমানের ধর্মে রয়েছে নানা কৃচ্ছপালন! সেই তুলনায় খ্রিস্ট ধর্মের দিকে তাকালে বাহ্যিক আমোদটাই আগে চোখে পড়ে।
এভাবে যত দিন যেতে থাকল, আমরা একটু একটু করে পশ্চিমি শিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। ভুলে গেলাম যা একদা আমাদের ছিল, তেমন অনেক কিছুর কথাই! সেই ভাবেই ভুললাম নবির জন্মদিনের কথাও। কেন না, অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন মুসলমানরা। তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি তেমন নেই, নেই ঝাঁ-চকচকে দেখনদারিও! ফলে যা হওয়ার, তাই হল! ইসলামের ধর্মাচরণ এবং তার উৎসব রয়ে গেল নির্দিষ্ট এক গোষ্ঠীর মধ্যেই। যে ভাবে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশ হয়ে গেল, সেভাবেই আমরাও বেছে নিলাম একেকটা আরামের খোপ। যার যেটা মনে ধরে আর কী! এবং, বাকি সব কিছুর কথা একেবারেই গেলাম ভুলে!
তাই খেয়াল করেও করলাম না- আজ সরকারি তরফে ছুটি! মুসলমানদের পরব। কারও কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় কী পরব, উত্তর আসবে খুব দায়সারা ভাবে। কী জানি গোছের একটা উত্তর। অথচ যাঁরা জানেন, তাঁরা কিন্তু সুখাদ্যে-নতুন পোশাকে আনন্দে মেতেছেন। পালন করছেন ইদ-এ-মিলাদ। সকালে নামাজ আদা করেছেন, তার পরে শুরু হয়েছে উৎসব। যে ধর্মের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে জীবনের এবং প্রতিটি দিনের ভিত্তি, তার প্রবর্তককে ঘিরে নতুন করে বাঁচা।
ইদ-এ-মিলাদ তাই সে অর্থে কোনও ধর্মীয় পরব নয়। এ নতুন আনন্দে জেগে ওঠার উৎসব। এ নতুন ভাবে নিজেকে চিনে নেওয়া। সেই চেনা সাঙ্গ করে কাছের মানুষের কাছে ফেরা, জীবনের কাছে ফেরা। তাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলা- ভালবাসি, ভালবাসি! সেই ভালবাসার কথা কি নবিও আর বলে যাননি? জীবনকে ভালবাসতে না পারলে তো বেঁচে থাকাই অর্থহীন হয়ে যায়। জীবনকে ভালবাসি বলেই তো আমরা নিজেদের এবং কাছের মানুষদের জন্মদিন ভুলি না!
এই হিংসার পৃথিবী থেকে কি নবি তাহলে চলেই গেলেন? এমন নীরব করে যে আমরা তাঁর জন্মদিনটা ভুলেই গেলাম? না কি আমরা ভুলে গেলাম ভালবাসতে?
কে জানে!
The post আজ কার জন্মদিন, আপনি ভুলে যাচ্ছেন না তো? appeared first on Sangbad Pratidin.