গণতন্ত্র ও বিশৃঙ্খলা হাত ধরে চলে। কথাটি প্লেটোর। শৃঙ্খলাহীনতার দিকটি আরও প্রকট ও পাশবিক হয় ভোটের দিন-কালে!
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!’ এ-গান কোন বাঙালির বুকে আবেগশিরায় টান দেয় না? এ-গান কার লেখা, কোন বাঙালিকে বলে দিতে হয়? এ-গানের হয়তো কোনও প্রয়োজনও নেই উদ্ধৃতি-চিহ্নের। কেননা, এ-গান প্রত্যেক বাঙালির, মিশে আছে প্রতিটি বাঙালির অন্তর উচ্চারণে! এই গান রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন’-এর সময়, ১৯০৫ সালে, তাঁর ৪৪ বছর বয়সে। ১১৮ বছর আগে, বাংলার এক বিপুল দুঃসময়ে, প্রতিটি বাঙালির স্বপ্নের সামনে, তাঁর এই গানে তিনি সমস্ত বঙ্গদেশের দরজা খুলে দিয়েছিলেন সোনার মন্দিরে।
সেই সোনার মন্দিরের সিঁড়িতে এত রক্ত কেন? কোথা থেকে এল মানুষের মনে এত ঈর্ষা, বিদ্বেষ, রাগ? এমন কুৎসিত ক্ষমতার নির্ঘোষ, কখনও মুখে, কখনও শরীরে, কখনও-বা বন্দুকে-বোমায়, লাঠিতে-ছুরিতে? ভোট যত কাছে এসেছে, নির্বাচনের হার-জিত, আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ যত প্রকট হয়েছে, ততই কেন বেড়েছে ক্ষমতার দাপট, রক্তপাত, এবং খুন? তাহলে কি, সুকুমার রায়ের ‘গোঁফ দিয়ে যায় চেনা’-র মতো অবিস্মরণীয় কৌতুকী পঙ্ক্তিতে বসাতে হবে এই বিহ্বল বিদ্রুপ: ‘ভোট দিয়ে যায় চেনা’? যত কাছে আসতে থাকে ভোট, ততই কেন দূরে সরে যেতে থাকে আমাদের সাধারণ শিক্ষাদীক্ষা, মনুষ্যত্ব, দয়া-মায়া? খুলে পড়ে আমাদের মুখ থেকে মুখোশ? আমরা দলমত নির্বিশেষে হয়ে উঠি সমান হিংস্র ও হীন? এই প্রশ্ন উঠবেই, সভ্যতা তাহলে আমাদের কী দিল? কতটুকু এগিয়ে নিয়ে গেল? এমন সংশয়ও হয়তো জাগতে পারে, আমরা কি শিক্ষায়, দীক্ষায়, মূল্যবোধে, সমাজচেতনায় এবং জীবনবোধে আরও পিছিয়ে পড়ছি না?
[আরও পড়ুন: টম্যাটোর সেঞ্চুরি, লঙ্কার দামে পকেটে ফোসকা, মানুষ খাবে কী?]
না, তা বোধহয় নয়। রাজনীতির ঈর্ষা, ক্ষমতার খুনোখুনি, নির্বাচনী রক্তপাত, প্রবলের অত্যাচার আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। কমে থাকলেও আশ্চর্য হব না। কিন্তু দাপটের দৃশ্য, খুনের রাজনীতি, রক্তপাতের ঘটনা, অত্যাচারের কাহিনি তখনও এমন প্রত্যহের জ্যান্ত ছবি হয়ে প্রতি মুহূর্তে আমাদের ঘরে, সংসারের অন্দরমহলে ঢুকত না। প্রতি সন্ধ্যায় টেলিভিশনে খুন-জখম-রক্তপাত নিয়ে রাজনীতির তরজা এমনভাবে জমে উঠে আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই করুণ ও কর্কশ বাস্তব রূপকে এমনভাবে প্রকাশিত করত না! টেলিভিশন-পূর্ব যুগে গ্রামবাংলায় রাজনৈতিক অত্যাচার, খুন, পুড়িয়ে মারা, পুলিশি-এনকাউন্টার, দলীয় দাদাগিরি এবং দিবানিশি মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার কম হয়নি।
বাংলার রাজনীতিতে নির্বাচনী রক্ত চিরকাল ঝরেছে। কিন্তু সেই পাশবিকতার ছবি এতখানি সামনে আসেনি প্রযুক্তির অভাবে। এখন পুরনো সত্য নতুন করে যেন ফিরে আসছে টেকনোলজিরই সৌজন্যে! তা-ই ইচ্ছা করছে আরও পুরনো সত্যে যেতে। গণতন্ত্র বিষয়ে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর উক্তিই মনে পড়ে যাচ্ছে: ‘ডেমোক্রেসি ইজ আ চার্মিং ফর্ম অফ গভর্নমেন্ট ফুল অফ ভ্যারাইটি অ্যান্ড ডিসঅর্ডার!’ গণতন্ত্রের সেই বিশৃঙ্খলাকে ভোট দিয়েই যায় চেনা!