‘মানি পাওয়ার’, ‘মাস্ল পাওয়ার’, ‘মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট’ ভাঙার প্রচেষ্টা এবং ‘মিসইনফরমেশন’। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা– এই চার ‘এম’-এর বিরুদ্ধেই তাদের লড়াই। এ কোনও নতুন কথা নয়। প্রসঙ্গত, ভোটে ‘মানি পাওয়ার’ তথা কালো টাকার প্রকোপ কমাতেই নির্বাচনী বন্ডের প্রবর্তন ঘটেছিল। অথচ, সেখানে তো অসাম্যর হদ্দমুদ্দ! লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
ভোট ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে তাদের লড়াই মূলত চারটি ‘এম’-এর বিরুদ্ধে। এই চার ‘এম’ হল– ‘মানি পাওয়ার’, ‘মাস্ল পাওয়ার’, ‘মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট’ ভাঙার প্রচেষ্টা এবং ‘মিসইনফরমেশন’। নির্বাচন কমিশন যে প্রথমবার এই কথা বলল, তেমন নয়। প্রতি বছর ভোটের আগেই তারা অন্তত তিন ‘এম’-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে থাকে। এবার হয়তো ‘মিসইনফরমেশন’-এর বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। সমাজমাধ্যমের প্রসার লাভ ঘটায় এখন ভুয়া তথ্য বা ‘মিসইনফরমেশন’-এর রমরমা। ভোটে ‘মিসইনফরমেশন’ বড় প্রভাব ফেলতে পারে। সমাজমাধ্যমে যে কোনও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক লাভ তোলা সম্ভব। সে-কারণে ‘মিসইনফরমেশন’-এর বিরুদ্ধে লড়াইটা জরুরি।
ভোটে ‘মানি পাওয়ার’ ও ‘মাস্ল পাওয়ার’ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ‘মানি পাওয়ার’ থাকলে ‘মাস্ল পাওয়ার’ তৈরি হয়। দেশে যে চরম আর্থিক অসাম্য চলছে, তার প্রতিফলন রাজনীতিতেও রয়েছে। এখানেও কিছু দলের হাতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সেই আর্থিক সম্পদকে ভোটে ব্যবহার করে তারা ক্ষমতাকে কবজা করছে। ভোটে সাফল্যের ক্ষেত্রে ‘মানি পাওয়ার’ থাকা কার্যত একটি পূর্বশর্ত হয়ে গিয়েছে। ‘মানি পাওয়ার’ থাকলে ‘মাস্ল পাওয়ার’ জোগাড় করতে সমস্যা হয় না। ফলে, কমিশনের ‘মানি পাওয়ার’ ও ‘মাস্ল পাওয়ার’-এর বিরুদ্ধে লড়াইটা একসঙ্গেই চলতে থাকার কথা।
[আরও পড়ুন: যতকাণ্ড যোগীরাজ্যে, সরকারি টাকা হাতাতে দিদির কপালেই সিঁদুর দিলেন ভাই!]
নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত যে-তথ্য আপাতত প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখাই যাচ্ছে যে, কর্পোরেট সংস্থাগুলির দেওয়া সিংহভাগ টাকা একটি রাজনৈতিক দলের পকেটে ঢুকেছে। এই ‘মানি পাওয়ার’ সহজেই তাকে ‘মাস্ল পাওয়ার’ এনে দেয়। ‘মানি পাওয়ার’ ও ‘মাস্ল পাওয়ার’-এর যোগফল হল ভোটে অনিবার্য জয়। অর্থনীতিতে অসাম্য যেমন ক্রমশ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বেঁচে থাকাকেই ক্রমশ অর্থহীন করে তুলছে, তেমন নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘মানি পাওয়ার’-এর বৈষম্য গণতন্ত্রকে অসাড় করে দিচ্ছে।
‘মানি পাওয়ার’-এর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের লড়াইটা কীভাবে পরিচালিত হবে, তা সহজে বোধগম্য নয়। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার তাঁর সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছেন, গত একবছরে যে ১১টি রাজে্য বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, সেখানে তাঁরা ৩,৪০০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছেন। এই বিপুল টাকা বাজেয়াপ্ত হয়েছে বলেই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনগুলিতে যে ‘মানি পাওয়ার’-কে খর্ব করা গিয়েছে তেমনটা নয়। এই নির্বাচনগুলির মধে্য দক্ষিণের দুই রাজ্য, কর্নাটক ও তেলেঙ্গানার ভোট রয়েছে। দক্ষিণের রাজে্য ভোটে টাকার উপস্থিতি অনেক বেশি। কমিশনের টাকা বাজেয়াপ্ত করার ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলি বিপাকে পড়েছিল, এমন খবর গোটা বছরে একবারও প্রকাশ হয়নি।
[আরও পড়ুন: আরও বিপাকে রামদেব, পতঞ্জলির বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন মামলায় সুপ্রিম তলব যোগগুরুকে]
নির্বাচন কমিশন অর্থ বাজেয়াপ্ত হওয়ার পরিসংখ্যান দিয়ে ‘মানি পাওয়ার’ নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। শুধু অর্থ বাজেয়াপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে যে ‘মানি পাওয়ার’ নিয়ন্ত্রিত হয় না, তা বুঝতে রকেট সায়েন্স জানার প্রয়োজন নেই। যত অর্থই বাজেয়াপ্ত হোক, ভোটে টাকার খেলা সহজে বন্ধ হয় না। দেশে কালো টাকার কারবার চালানোর একটা ব্যবস্থা রয়েছে। ভোটের ‘মানি পাওয়ার’ তথা টাকার সার্কুলেশন যে এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই পরিচালিত হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘হাওয়ালা’, ‘হুন্ডি’ ইত্যাদি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ভোটের সময় বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের অর্থ আবর্তিত হয় বলে শোনা যায়। এবারও নির্বাচন কমিশনের চোখ এড়িয়ে সেই ঘটনাই ঘটবে।
ভোটে ‘মানি পাওয়ার’ তথা কালো টাকার প্রকোপ কমাতেই নির্বাচনী বন্ডের প্রবর্তন ঘটেছিল। সম্প্রতি নির্বাচনী বন্ডের তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর দেখা যাচ্ছে যে, কীভাবে শুধুমাত্র একটি দল সিংহভাগ টাকা কুক্ষিগত করেছে। এটা অনেকটা দেশের আর্থিক অসাম্যের চেহারার মতোই। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে গত ছ’বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজনৈতিক দলগুলি পেয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র বিজেপির ভাঁড়ারেই গিয়েছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা।
নির্বাচনী বন্ডের টাকাটা যে হিমশৈলের চূড়ামাত্র, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, নির্বাচনী বন্ডের টাকাটা তো সাদা টাকা। নির্বাচনী বন্ড চালু থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের হিসাবেই গত একবছরে দেশের বিভিন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ৩,৪০০ কোটি কালো টাকা বাজেয়াপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ, নির্বাচনী বন্ড ভোটে কালো টাকার রমরমা বন্ধ করতে পারেনি।
[আরও পড়ুন: যতকাণ্ড যোগীরাজ্যে, সরকারি টাকা হাতাতে দিদির কপালেই সিঁদুর দিলেন ভাই!]
নির্বাচনী বন্ডের তথে্য দেখা গিয়েছে বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলকে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে যে ৩০টি বাণিজি্যক সংস্থা রয়েছে তার মধ্যে ১৪টিতে ইডি, সিবিআই বা আয়কর দফতর সাম্প্রতিককালে তল্লাশি চালিয়েছে। যে হিসাব তুলে বিরোধীরা অভিযোগ করছে, কেন্দ্রীয় এজেন্সি ব্যবহার করে বিজেপি তোলাবাজি চালিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে ব্যাখ্যা দিতে হবে, এই ‘তোলাবাজি’ বন্ধ করতে তারা কী পদক্ষেপ করেছিল? নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, কেন্দ্রে শাসক দলের বিরুদ্ধে কমিশনকে কখনওই সক্রিয় হতে দেখা যায় না।
সুপ্রিম কোর্ট স্টেট ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দিয়েছে, বৃহস্পতিবারের মধে্য বন্ডের গোপন কোড নম্বর-সহ যাবতীয় তথ্য প্রকাশ্যে আনতে। স্টেট ব্যাঙ্ক কোর্টের নির্দেশ পালন করলে জানা যাবে, গত ৬ বছরে বন্ডের মাধ্যমে কোন ব্যবসায়িক সংস্থা কোন দলকে কত টাকা দিয়েছে। কিন্তু এই তথ্য প্রকাশ্যে এলে দেশের স্যাঙাততন্ত্রের আবরণ কিছুটা উন্মোচিত হওয়া ছাড়া, আর কিছুই ঘটবে না। নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অবৈধ হয়ে গিয়েছে। বন্ড পরবর্তী ব্যবস্থায় কি টাকার খেলা কোনওভাবে বন্ধ হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে দেশের একজন নাগরিকও না বলবেন না। যে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি বন্ডের মাধ্যমে টাকা জুগিয়েছে, তারা-ই এবার নগদে কিছু বাছাই করা রাজনৈতিক দলকে টাকা দেবে। অর্থাৎ, ভোটে টাকার খেলা থাকবে এবং রাজনৈতিক দলগুলির টাকা আয়ের ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য চলতে থাকবে। যার অনিবার্য প্রভাব গিয়ে পড়বে নির্বাচনের ফলাফলে।
রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী খরচ-খরচার সব দায় যত দিন না রাষ্ট্র বহন করবে, তত দিন এই ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে না। একসময় রাষ্ট্রীয় খরচে ভোটে রাজনৈতিক দলগুলির প্রচারের প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হত। ইদানীং তা কার্পেটের তলায় চলে গিয়েছে। ব্যবস্থার আমূল বদলের ভাবনাচিন্তা ছাড়া, নির্বাচনী কমিশনের চার ‘এম’-এর বিরুদ্ধে লড়াই কোনও দিনই সফল হবে না। কমিশন প্রতি বছরই ‘মানি পাওয়ার’, ‘মাস্ল পাওয়ার’-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলবে, কিন্তু ভোট শেষের পর দেখা যাবে পরিস্থিতি সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। এইরকম চলতে থাকলে ক্রমশ দেশের গণতন্ত্রের ভিতটাই দুর্বল হতে থাকবে।