বিশ্বদীপ দে: এ এক ঘোর দুঃসময়। মঙ্গলবাসরীয় সন্ধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বুধবার তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা। শোকের সেই রেশের মধ্যেই বুধবারের সকাল বয়ে আনল আরেক দুঃসংবাদ। ভাল করে দিনটা শুরু হওয়ার আগেই জানা গেল, প্রয়াত হয়েছেন বাপি লাহিড়ী। সুরকার ও গায়ক বাপি লাহিড়ী। ‘ডিস্কো কিং’ বাপি লাহিড়ী (Bappi Lahiri)। বাঙালির আরেক বড় প্রিয় বড় আপন শিল্পী বাপি লাহিড়ী। দুই ভিন্ন যুগ ও একেবারেই ভিন্ন ঘরানা। পরপর দু’দিন দুই ইন্দ্রপতনের সাক্ষী রইল শীতের বিদায়ী বেলা।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাঙালির স্বর্ণযুগের প্রতিনিধি। আর বাপি এমন এক সময়ের প্রতিনিধি যখন চারপাশে এক খাঁ খাঁ শূন্যতা। চলে গিয়েছেন উত্তম কুমার। উত্তাল সত্তর পেরিয়ে সময় তখন যেন কেমন থমকে গিয়েছে। তথাকথিত স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। ঠিক সেই সময়ই একেবারে ভিন্ন আন্দাজে রুপোলি পর্দায় জাদু বিলোলেন এক বঙ্গসন্তান। তিনি মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun Chakraborty)। আর তাঁর কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন আরেক বঙ্গতনয়। বাপি লাহিড়ী। ‘আই অ্যাম এ ডিস্কো ডান্সার’ হোক কিংবা ‘ইয়াদ আ রাহা হ্যায়’- ‘ডিস্কো ডান্সার’ তৈরি করে দিল এক নয়া যুগ। সমসময় তাকে অনেক সময় ‘অপসংস্কৃতি’ বলে নাক সিঁটকোলেও তরুণ প্রজন্ম সেই গানেই খুঁজে পেল নিজের বুকের ভিতরে বইতে থাকা সমকালের হৃদস্পন্দন। যে যাই বলুক, আশির সেই ডিস্কো গান একেবারেই যুগধর্ম মেনেই আবির্ভূত হয়েছিল।
[আরও পড়ুন: কিশোর কুমারের প্রয়াণের পর গান ছাড়তে চেয়েছিলেন, ফিরে দেখা বাপিদার জীবনের অজানা গল্প]
ততদিনে রেকর্ডের যুগ পেরিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে ক্যাসেটের জমানা। রাহুল দেববর্মণের মতো এক জিনিয়াসের হাত ধরে ছয়ের দশক থেকেই একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছিল হিন্দি প্লেব্যাক গানের ধারা। ঢুকে পড়ছিল পাশ্চাত্য পপ কালচার। সেই ধারাকেই এক নতুন মোড় দিলেন বাপি লাহিড়ী। মাত্র ১৯ বছরে পাড়ি দিয়েছিলেন টিনসেল টাউনে। ১৯৭৫ সালে ‘জখমি’ ছবিতে প্রথমবার নিজেকে চেনান সেই তরুণ। কিন্তু তাঁর আসল দৌড়টা শুরু হয় আরেকটু পর থেকে। যা উত্তুঙ্গ উচ্চতায় উঠে যায় ‘ডিস্কো ডান্সার’ থেকে।
১৯৮৬ সালে ৩৩টি ছবির জন্য ১৮০টি গান রেকর্ড গড়ে ফেলা থেকে পরিষ্কার, সেই সময় তাঁর গানের চাহিদা কোথায় পৌঁছেছিল। ১৯৮৯ সালে জোনাথন রসের সঙ্গে লাইভ অনুষ্ঠান কিংবা হলিউড ছবিতে ‘জিমি জিমি আজা আজা’র ব্যবহার বুঝিয়ে দেয় কীভাবে জনপ্রিয়তা তাঁর শরীরের অলঙ্কারের মতোই জৌলুসময় হয়ে উঠেছিল মাত্র কয়েক বছরে। সেই যুগে বলিউডের দুই বিখ্যাত ‘ডান্সিং হিরো’ জিতেন্দ্র ও মিঠুনের একের পর এক হিট গানের আবেদন যে আজও কমেনি, তা বুঝতে একবার ইউটিউবে গানগুলির কমেন্ট সেকশনে উঁকি দিলেই যথেষ্ট। আবার ২০১১ সালে বিদ্যা বালনের ‘ডার্টি পিকচার’ ছবিতে ‘উ লা লা’ গানটির তরতাজা গড়ন বুঝিয়ে দিয়েছিল বয়স বাড়লেও ভিতরে ভিতরে বাপি রয়েছেন সমসাময়িকই।
[আরও পড়ুন: একদিনে দেশের করোনা সংক্রমণ বাড়ল ১১%, দুশ্চিতায় রাখছে মৃত্যুহার]
কেবল তো ডিস্কো নয়, রোম্যান্টিক গানেও তিনি বাজিমাত করেছেন বারবার। পাশাপাশি কাওয়ালি কিংবা রাগাশ্রয়ী গানেও চমকে দিয়েছেন। তবু… শেষ পর্যন্ত বাপি বলতে মানুষের মনে ডিস্কো গানের ঝকঝকে ‘বিট’ মনে পড়ে যেতে বাধ্য। ‘জিমি জিমি জিমি আজা আজা আজা’, ‘ইয়াদ আ রাহা হ্যায়’, ‘রাত বাকি বাত বাকি’, ‘জওয়ানি জানেমন’, ‘টাকি টাকি’, ‘ইয়ার বিনা চ্যান কাঁহা মেরে’, ‘ডান্স ডান্স’ একের পর এক গান আজও অনায়াসে বেজে ওঠে নৈশ পার্টির ঝিলমিলে চৌহদ্দিতে। সময় বদলেছে। যুগ বদলেছে। যৌবন কি বদলাতে পারে? বহিরঙ্গে বদলালেও ভিতরে ভিতরে তা যে অপরিবর্তনীয়, সেই সার সত্যিটা বুঝে গিয়েছিলেন বলেই বাপী সব সময়ই থাকতে পেরেছেন সমসাময়িক। কালো চশমা আর ভরি ভরি সোনার হারের জৌলুসময় আবেদনটুকুই নয়, বাপির আসল অলঙ্কার বোধহয় তাঁর গানের ভিতরে থাকা ‘বিট’, যা এক ঝলমলে রামধনুর মতো উদ্দাম বাঁধভাঙা যৌবনকে সংজ্ঞায়িত করে চলবে চিরকাল।