সব্যসাচী বাগচী: তখনও দেশ পরাধীন। ১৯৪২ সাল। বাংলা তথা গোটা দেশে চলছে ব্রিটিশ রাজ। এর আগে অবশ্য ১৯১১ সালে ইতিহাস গড়ে আইএফএ শিল্ড (IFA Shield) জিতে ফেলেছিল মোহনবাগান (Mohun Bagan)। ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে মাঠের যুদ্ধে হারিয়ে যেন ঘটেছিল ভারতীয় ফুটবলের (Indian Football) নবজাগরণ।
সেই জয় কি তাঁর মনের মধ্যে ফুটবলার হওয়ার বীজ বপন করেছিল? ইতিহাস তেমন তথ্য দেয় না। তবে কথিত আছে হাওড়ার সেই ছেলেটা মাত্র ১৮ বছর বয়সে দেশাত্মবোধ ও মোহনবাগানের লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত হয়েই সবুজ-মেরুন তাঁবুতে পা রেখেছিলেন। তিনি এক ও অদ্বিতীয় শৈলেন মান্না (Sailen Manna)। আজ তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী।
গোষ্ঠ পাল তাঁর ডিফেন্সিভ স্কিলের জন্য ভারতীয় ফুটবলে ‘চীনের প্রাচীর’ আখ্যা পেয়েছিলেন। প্রবাদপ্রতিম গোষ্ঠ পালের সুযোগ্য উত্তরসূরি শৈলেন মান্নার ডিফেন্সের ধাঁচও নাকি তেমনই ছিল। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতার মিশেল ঘটিয়ে অনায়াসে বিপক্ষের স্ট্রাইকারদের রুখে দিতেন।
[আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার কাছে নাস্তানাবুদ বাংলাদেশ, হেরেই এশিয়া কাপ অভিযান শুরু শাকিবদের]
১৯৪২ সাল থেকে সেই শুরু। এরপর কেটে গিয়েছিল টানা ১৯ বছর। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে সবুজ-মেরুনে কত ফুটবলার এসেছেন। অনেক ফুটবলার দলবদল করেছিলেন। তবে তাঁর জায়গা একমেবম অদ্বিতীয়ম। পরাধীন থেকে স্বাধীন দেশের ইতিহাস, আজও ক্লাবের প্রতিটা ঘাসে যেন শিশিরের মতো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
ভারতীয় ফুটবল কিংবদন্তীর জন্মদিনে বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় (Satyajit Chatterjee)। সংবাদ প্রতিদিন. ইন-কে টেলিফোনে তিনি বলেন, “শৈলেন মান্নার ব্যাপারে অনেক কিছুই বলার রয়েছে। উনি যে কখন আমার কাছে শৈলেন মান্না থেকে ‘মান্নাদা’ হয়ে গিয়েছিলেন মনে করতে পারি না। দলে যোগ দেওয়ার পর থেকে আজীবন মোহনবাগানের সঙ্গেই নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি। গোটা ক্লাবে তিনি বটগাছের মতোই বিরাজমান ছিলেন। তাঁর ছায়াতেই আমরা সকলে প্রতিপালিত হতাম।”
মোহনবাগানের ইতিহাসে সত্যজিতের অবদান অপরিসীম। তবে যে মানুষটা খেলোয়াড় জীবনে সবুজ-মেরুন জার্সিকে নিজের ঘাম-রক্তের মতো আগলে রেখেছিলেন, সেই সত্যজিতের মোহনবাগানের হয়ে খেলার কথাই ছিল না। বরং তিনি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলে সই করে দিচ্ছিলেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে গল্পে শৈলেন মান্নার আগমন না ঘটলে, ইতিহাস অন্য ভাবে তৈরি হতেই পারত।
স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে সত্যজিৎ শোনালেন মজার গল্প। বলছিলেন, “মান্নাদা না থাকলে আমি মোহনবাগানের হয়ে খেলতেই পারতাম না। আমাকে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে হত। জুনিয়র ন্যাশনাল খেলে আসার পর আইএফএ থেকে আমাদের স্পট করা হয়েছিল। সেই সময় আইএফএ-এর সচিব ছিলেন প্রদুৎ দত্ত। আমাদের মূলত অমল দত্তের কোচিংয়ে সন্তোষ ট্রফির ট্রায়ালে ডাকা হয়েছিল। একইসঙ্গে সেই সময় সন্তোষের ট্রায়ালে আমাদের ইস্টবেঙ্গলের কয়েকজন কর্তাও দেখতে এসেছিলেন। আমার খেলা ভাল লেগে আমাদের পাড়ার এক দাদা-র মাধ্যমে ইস্টবেঙ্গল যোগাযোগ করে। কিন্তু সেখানে অনুশীলন করতে গিয়ে ঘটল আরেক ঘটনা। আমি সুব্রত ভট্টাচার্য, কৃষ্ণেন্দু রায়দের নজরে পড়ে যাই। কিন্তু আমি মোহনবাগান কর্তাদের স্পষ্ট না বলে দিয়েছিলাম। কারণ আমার সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের পাকা কথা হয়ে গিয়েছিল।”
[আরও পড়ুন: প্রিয় দলের খেলা দেখতে গিয়ে মাঠেই মৃত্যু, মহামেডান স্পোর্টিং সমর্থকের প্রয়াণে শোকের ছায়া ময়দানে]
সন্তোষ ট্রফির ট্রায়াল থেকে লাল-হলুদেও চলে এসেছিলেন। কিন্তু, কীভাবে এই অসাধ্যসাধন সম্ভব হল? কীভাবে ঘুরল খেলা? সত্যজিৎ ফের যোগ করলেন, “মান্না দা হাওড়ার লোক ছিলেন। আমরাও তখন হাওড়াতেই থাকতাম। সেইসূত্রে আমার দাদুর সঙ্গে ওনার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। দাদুও ফার্স্ট ডিভিশন খেলতেন। বাড়িতে মাঝেমধ্যেই যাতায়াত করতেন। সেই সুবাদে মান্না দা আমার দাদুকে বলেছিলেন, ‘এটা কেমন ব্যাপার হল! আপনার নাতি ইস্টবেঙ্গলে খেলবে?’ দাদু তখন মান্না দা-কে কথা দিয়েছিলেন। আর দাদুর কথা ফেলে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।”
এমনই ব্যক্তিত্ব ছিল অজাতশত্রু মানুষটির। প্রায় ১৯ বছর একটানা মোহনবাগানের হয়ে খেলেছেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর হাতে ছিল সবুজ-মেরুনের আর্মব্যান্ড। তাঁর মতো ডিফেন্ডার ভারতীয় ফুটবল ইতিহাসে একেবারেই হাতেগোনা, সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু ক্লাব নয়, জাতীয় দলেও তো একটা সময় দাপিয়ে পারফর্ম করেছেন তিনি। ১৯৪৮ সালে তিনি লন্ডন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়া ১৯৫৪ সালে এশিয়ান গেমস এবং ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকেও তিনি ছিলেন ভারতের অধিনায়ক। ১৯৫১ সালের এশিয়ান গেমসে ভারত সোনার পদক জিতেছিল। এছাড়া ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পরপর তিন বছর ভারতীয় ফুটবল দল চতুর্দেশীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে জয়লাভ করেছিল।
সত্যজিৎ শেষে বলছিলেন, “মান্নাদা-র খেলা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে ম্যানেজার হিসেবে ওনাকে অনেক বছর পেয়েছিলাম। একবার খেলার মাঝে খুব মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। মেজাজ হারিয়ে বিপক্ষের ফুটবলারদের সঙ্গে ঝগড়া করে ফেলেছিলাম। ম্যাচের শেষে মান্না দা আমার কাছে এসে বলেছিলেন, ‘আমার গা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা কর। আর কোনওদিন কারও সঙ্গে ঝামেলা করবি না।’ সেই শেষ। এরপর থেকে আমি ময়দানে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। কারণ মান্নাদা-কে বাবার মতো সম্মান করি। শুধু কলকাতা নয়, ভারতীয় ফুটবলে এমন ব্যাক্তিত্বের মানুষ আর আসবেন না।”
কালের নিয়মে শৈলেন মান্না নেই। ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চিরঘুমে চলে গিয়েছেন ‘অজাতশত্রু’। কিন্তু দেশের ফুটবল সমর্থকদের চিন্তন এবং মননে রেখে গিয়েছেন গভীর ছাপ। সেইজন্য ২০০০ সালে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন তাঁকে ‘সহস্রাব্দের সেরা ফুটবলার’-এর খেতাব মুকুট করে তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিল। তবে তার আগেই অবশ্য ভারত সরকার তাঁকে ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ২০০১ সালে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় মোহনবাগান রত্নের খেতাব।
আইএসএল আসার পর থেকে ভারতীয় ফুটবল আরও উন্নত হয়েছে। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তারকারা এখন মোবাইলের এক ক্লিকের দূরত্বে রয়েছেন। তবে এত কিছুর পরেও শৈলেন মান্নার মত মানুষ, নিজের কৃতিত্বে সমান ভাবে উজ্জ্বল। সবার কাছে এখনও একইরকম ভাবে শ্রদ্ধেয় অজাতশত্রু ‘মান্নাদা’।