‘কাবুলিওয়ালা’-র ডাবিংয়ের সময় তখন তিনি কলকাতায়। রাজারহাটের এক অভিজাত হোটেলে বসে মিঠুন চক্রবর্তী শোনালেন ‘রহমত’ হয়ে ওঠার গল্প। শুনলেন শম্পালী মৌলিক।
প্রথমেই জানতে চাই, ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হলেন কেন?
অ্যাকচুয়ালি ভেরি ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, আমি ‘হ্যাঁ’ বলিনি, ‘না’-ও বলিনি প্রথমে। আমি তখন মুম্বইয়ে, শুটিং করছি, সুমন (ঘোষ) বলল, ‘দাদা, আপনি আমার সঙ্গে আর কাজ করবেন না?’ আমি বললাম, ‘কেন করব না। দেখো, সেই রোল আনতে হবে, যা আজকেও আমাকে এক্সাইট করবে। সব বই আর করতে ইচ্ছে করে না।’ ও তখন হঠাৎ বলল, “কাবুলিওয়ালা’ করবেন? আমি ছবিটা করব আর আপনাকে ছাড়া করব না।” আমি চুপচাপ ছিলাম, কারণ, অবাক হয়েছিলাম। কারণ, এর আগে যে দুজন করেছেন, তাঁরা হলেন ফিল্ম জগতের মহারথী, ইমমর্টাল অ্যাক্টর্স। আমি ভাবলাম– যদি কোনও কিছু উলটোপালটা হয়, আমার যা ধোলাই হবে! তার থেকে চুপচাপ থাকাই ভালো। সুমনও আর কথা না বাড়িয়ে চলে গিয়েছিল। তার অনেকদিন পর সুমন আবার বলে, দেখা করতে চায়, অন্য একটা বই নিয়ে। আমি বললাম, এসো। অ্যাকচুয়ালি, ও আবার ওই বইটা নিয়েই বসতে চেয়েছিল। ঘুরে-ফিরে ‘কাবুলিওয়ালা’ নিয়েই এল (হাসি)।
তারপর?
আমি বললাম, ঠিক আছে। আমি পারব কি না দেখি। এই প্রসঙ্গে বলি– আমার একজন বন্ধু ছিল, জামালউদ্দিন খান। আফগানিস্তানের পাঠান। রাঁধুনি ছিল। ও আমাকে খাবার করা শিখিয়েছে। খুব ভালোবাসত আমাকে। যেখানেই শুটিং করতাম, ডাব্বা করে কখনও মাটন, চিকেন, ফিশ বা সবজি নিয়ে আসত। আর ও লক্ষ্য রাখত, আমি কখন খাব। মানে ওই খাবারটা আমি কাউকে দিতে পারব না। সে আমি যেখানেই থাকি, জামাল ঠিক পৌঁছে যেত। সবাইকে বলে দিয়েছিলাম, ওর সঙ্গে যেন ভালো ব্যবহার করে। ও আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। যদি কখনও আমার আগে চলে আসে, ওকে যেন বসতে চেয়ার দেওয়া হয়। জামালের হাঁপানি ছিল। যে কারণে, কথা বলাটা একটু অন্যরকম ছিল। বাক্যের শেষটা স্তিমিত হয়ে আসত। বলত, ‘আমি আল্লাহ্কে বলেছি তুই নাম্বার ওয়ান হবি।’ সেই সময় সবে আমি স্টারডমে প্রবেশ করছি। বহুকাল আগের কথা। যাই হোক ফের সুমন আমাকে ফোন করে যে, দাদা কিছু ভাবলেন? আমি ওকে, সংলাপ বলে শোনাই, যে কেমন লাগছে বলো। ‘খোঁকি কেমন আছিস?’– ঠিক জামাল হলে যেমন বলত, সেই ভাবে। বললাম, এই হল আমার ‘রহমত’। সুমন ওয়াজ অ্যাবসোলিউটলি ফ্লোরড। বলল, এই রহমতকেই চাই। ওকে আসতে বললাম, আর প্রযোজক শ্রীকান্তের সঙ্গে কথা হল। ওরা মুম্বই এল, স্ক্রিপ্ট ফাইনাল করার জন্য। আমি বললাম, ‘আগে আমার পরীক্ষা দিতে চাই। পাস করছি কি না দেখো। নয়তো আমি করব না।’ শ্রীকান্তকে ঠিক সেভাবেই শোনাই। বলল– ‘আমরা এটাই চাই। আপনি করুন’।
এই সময়ে এসে আপনি ‘কাবুলিওয়ালা’-য় করছেন। টাইমলেস ক্লাসিক। এই
যুগে দাঁড়িয়ে তার প্রাসঙ্গিকতা কতখানি মনে হয়?
দেখো, যারা এই মুহূর্তে তিরিশের ওপরে তাদের ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হবে। কারণ, তারা স্কুলে পড়েছে। সবাই পড়েছি আমরা। কবিগুরুর এমন লেখা, এত ফাইনেস্ট তাঁর গল্প। সুদূর আফগানিস্তান থেকে আসা একটা লোকের গল্প, আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। আজকের সমাজের যা অবস্থা, সেখানে একজন মুসলমান লোক আর ছোট্ট হিন্দু মেয়ে গল্পের কেন্দ্রে। ইট্স আ লাভ স্টোরি বিটুইন ফাদার অ্যান্ড ডটার। ছোট্ট মেয়েটা কত কিছু শেখায় রহমতকে। যেমন– জিগ্যেস করে, “তোমার ঠাকুর আছে? তার নাম কী?’ রহমত বলে– ‘আছে, তার নাম আল্লাহ্’। মিনি বলে– ‘ও তোমার ঠাকুরের নাম আল্লাহ। আর আমার ঠাকুরের নাম ‘ঠাকুর’। এই নাও প্রসাদ খাও।” রহমত খেতে যেতেই মেয়ে বলে– ‘আগে নমো করো।’ বাচ্চা মেয়েটা যা শেখায় রহমত সেটাই ধারণ করে শেষ অবধি। শেষে যখন মিনি চিনতে পারে না, তখন রহমত একটা লাইন বলে, ‘বাবুজি, মেরে মন্দির সে মেরা ভগবান চলা গ্যায়া।’
এই যে দুজন অসমবয়সি মানুষের বন্ধুত্ব। এটা আপনার মন ছুঁয়ে গিয়েছে।
নিশ্চয়ই। আমার ‘ডান্স বাংলা ডান্স’ দেখো, বা যা-ই দেখো– আমি বাচ্চাদের বড় ভালোবাসি। মিনির সঙ্গেও আমি সেইভাবে মিশেছি। ওকে কিছু বুঝতেই দিইনি। ও আমার কোলে ছাড়া বসতে চাইত না। শুটিংয়ে এমন একটা সময় এল যে, আমরা ইনসেপারেবল।
শুটিং কোথায় হয়েছে?
আমি প্রথমেই সুমনকে বলেছিলাম, ‘কাবুলিওয়ালা’ করতে গেলে সেরকম প্রোডিউসার চাই। যার ছবি করার প্রতি ভালোবাসা আছে এবং এর কোনও বাজেট থাকবে না। বাজেট বেঁধে ফেললে এই ছবি করা উচিত নয়। তবে এসভিএফ এগিয়ে এসেছে। আজকের দিনে ১৯৬৫ সালের কলকাতা তৈরি করা সহজ নয়। তেমন একটা সেট কিন্তু করেছে। তার পরের জার্নি ছিল পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত, কারগিল। আফগানিস্তান যাওয়ার চেষ্টা করলেও ওখানে তো পারমিশন দেবে না। কিন্তু আমরা বর্ডারের একদম কাছেই গিয়েছিলাম। পাকিস্তান বর্ডার দেখা যায় এমন জায়গায় শুটিং করেছিলাম আমরা। একটু চিন্তা ছিল আমার। কারণ, ডাক্তার বলেছিল, দশহাজার ফিটের ওপরে এখন আপনার ঝুঁকি নেওয়া উচিত না। তবে পরে জানলাম শেষদিন যেখানে শুটিং হয়েছিল, বারো হাজার ফিট। একটু কষ্ট হয়েছিল মধ্যিখানে দ্যাট ওয়াজ নেগলিজেব্ল। এই সিনেমার জন্য এই কষ্টটা করা যায় (স্মিত হাসি)।
এই ছবিটা করতে কী কী চ্যালেঞ্জঅনুভব করেছেন?
প্রথম হল, কথার অ্যাকসেন্ট। এই ফিল্মটা আমি জামালকে ডেডিকেট করছি। জানি না জামাল বেঁচে আছে কি না। ও আফগানিস্তান চলে গিয়েছিল ওর মেয়ের বিয়ের সময়। আমি বলেছিলাম, কিছু দেব? জামালের প্রশ্ন ছিল ‘কিঁউ? মেরি বেটি হ্যায়। তু কিঁউ দেগা?’ আর কোনও যোগাযোগ নেই। কিন্তু মনে ইমপ্রিন্ট হয়ে আছে। অ্যাকচুয়ালি আমি জামালের স্টাইলটা নিয়েছি এখানে। ছবিতেও আছে রহমত শ্বাসের রোগী। এখন দেখি (হাসি)। আমি চাইব কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে যারা, তারাও দেখুক। ইট ইজ নট আ ফিল্ম। আজকের সোশাল মিডিয়ার যুগে, সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজার আগে হাতে ফোন। সর্বক্ষণ হাতে ফোন। সেখানে এটাই বোঝানোর যে, এর আগেও, এসব ছাড়াও জীবন আছে। এটা হল সত্যিকারের ইমোশন। জাতপাত ধর্ম, কিছুই ম্যাটার করে না এখানে।
ছবিতে মিনির বাবার চরিত্রে আবির চট্টোপাধ্যায়, মায়ের ভূমিকায় সোহিনী সরকার। ওঁদের সঙ্গেও তো আপনার সিকোয়েন্স রয়েছে।
অনেক দৃশ্য। দে হ্যাভ ডান একসিলেন্ট জব। পিকচারটা দেখলে, বুঝতে পারবে। সবাই চরিত্রের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে।
ছোট্ট মিনি যে করেছে অনুমেঘা…
আমার মনে হয় শি ইজ গোয়িং টু বি আ সুপারস্টার। এইরকম এফর্টলেস অভিনয়, এইটুকু মেয়ের! কখনও-সখনও বলেছে– ‘তোমরা গিয়ে বসো, আমি অভিনয় করছি দেখো।’ (হাসি) আমি তো স্টানড! বড় বড় সংলাপ এক-এক টেক-এ ওকে করেছে।
১৯৫৭ সালে তপন সিংহ যে ‘কাবুলিওয়ালা’ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাহিনির আধারে, তার চেয়ে এই ছবিটা কতটা আলাদা?
আমি বলতে পারব না। দেখো, কবিগুরুর গল্পতে কেউ আঁচড় কাটবে সেটা আমি হতে দেব না। আমি করব না ছবিটা, সেটা হতে পারে। ওটা নয়। তবে ক্যারেক্টারওয়াইজ সবাই নিজের মতো করেছে। বা ডিরেক্টর কনসিভ করেছে, সেটা করেছে। একজন রিয়্যাল আফগান কেমন হতে পারে, রহমতের মধ্যে তাকে আমি তুলে ধরেছি।
যাঁরা তপন সিংহর ছবিটা দেখেছেন (নামভূমিকায় ছবি বিশ্বাস), বা বলরাজ সাহানির অভিনয় (পরিচালনায় হেমেন গুপ্ত) দেখেছেন, তাঁদের কোথাও গিয়ে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে তুলনার কথা মনে আসতে পারে।
আই হ্যাভ নেভার থট অফ ইট। আমি দেখিওনি। তবে দুজনেই টেরিফিক করেছে। দুটোই সুপারহিট হয়েছিল। দুজনেই তো মহারথী। আপনি তো ‘মহাগুরু’। আপনার ইন্টারপ্রিটেশন আলাদা হবে বলেই মনে হয়। একদম, পুরোপুরি আলাদা। রহমতকে আমি অন্য চোখে দেখি।
[আরও পড়ুন: সমুদ্রের ধারে হৃতিকের ঠোঁটে ঠোঁট রাখলেন দীপিকা! শুধু রোমান্স নয়, অ্যাকশনে ভরা ‘ফাইটার’ টিজার]
২০১২-য় আপনি সুমন ঘোষের সঙ্গে ‘নোবেল চোর’ করেছেন। তার ১১ বছর পর ‘কাবুলিওয়ালা’ করলেন। এতটা ব্যবধান কেন?
সেটা আমি বলতে পারব না, ওই পারবে। সুমনকে একটা ক্রেডিট দেব। নোবেল তো চুরি হয়েছে। কার সেই গাট্স ছিল, এইটা নিয়ে ছবি করার? আবার আজকের দিনে যদি দেখো, ‘কাবুলিওয়ালা’। লোকে তো ভয় পাবে। তপন সিংহ করেছেন। হি হ্যাজ দিস কনভিকশন। সেটা আমার খুব ভালো লাগে। ওর মধ্যে একটা সততা আছে। সোজা করে ফিল্মটাকে বোঝায়। আমাদের মধ্যে সুন্দর আন্ডারস্ট্যান্ডিং। শুটের আগে ও আমার ভ্যানিটিতে আসবে। বলবে, দাদা এইরকম। ও জানে আমি প্ল্যান করে কিছু করি না। ডায়লগ মুখস্থ করি না। ক্লাইম্যাক্সে ও খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। আমি মজা করতে করতে তার একটু পরেই শট দিয়েছিলাম। কারণ, আমি চাই আমি কাঁদব না, আমার অডিয়েন্স কাঁদবে। তবেই আমি সফল। এটাই আমার প্রসেস।
‘প্রজাপতি’ করার পর কি বাংলা ছবি করার ইচ্ছে বাড়ল?
না, সেরকম কিছু নয়। অনেকে অনেক কিছু বলে কিন্তু তারা মিথ্যে কথা বলে। প্রত্যেক বছর আমি একটা বাংলা কাজ করি। মধ্যিখানে হিন্দিও করিনি। কারণ আমার পিঠে যে লেগেছিল, বহুদিন আমি উঠতে পারিনি।
বড়দিনে আরও দুটো ছবি আসবে। দেবের ‘প্রধান’ এবং শাহরুখ খানের ‘ডাঙ্কি’। জোরদার লড়াইয়ের সম্ভাবনা। ‘কাবুলিওয়ালা’ কি স্ট্যান্ড আউট করবে?
বলা মুশকিল। বাট আই উইশ গুড ফর এভরিওয়ান। সবার ছবি ভালো চলুক। আমারটাও চলুক।
কোথাও দেবের সঙ্গেও কিন্তু আপনার প্রতিযোগিতা।
কীসের প্রতিযোগিতা! আই ডোন্ট বিলিভ ইন কমপিটিশন। নেভার-এভার।
আমি যখন নাম্বার ওয়ান স্টেটাসে তখনও কম্পিটিটর হিসাবে কাউকে দেখিনি। আমি আমার কাজটা অনেস্টলি করব। তারপরে কে কী হচ্ছে কোনওদিন দেখিনি। লোকে এসে বলত, দাদা আপনার ছবি এত কোটি বিজনেস করেছে। আমি বলতাম– ভালো, প্রোডিউসার কামিয়েছে।
দেবের সঙ্গে আগামী দিনে ছবি করার ইচ্ছে আছে?
ও আমাকে গল্প শুনিয়েছে। দেখি। তবে এখন মনে হচ্ছে যা, বুম্বার সঙ্গে একটা পিকচার করার ইচ্ছে আছে। কারণ, বুম্বা আমাকে বলেছিল, ‘দাদা, এবার আমার পালা।’ সেটা আমি শ্রীকান্তের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। হি উইল ফাইন্ড আ সাবজেক্ট। আর এখন সোহমের প্রযোজনায় একটা ছবি করব। জানুয়ারিতে টেক অফ (হাসি)।