বক্তা যিনি, তাঁকে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের ‘দ্রোণাচার্য’ বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। তিনি পুল্লেলা গোপীচাঁদ (Pullela Gopichand), যিনি সোমবার শহরে এসেছিলেন ‘ট্রেলব্লেজার্স ২.০’-র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে। কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবে বিকেল নাগাদ যা হল। তার আগে আসন্ন অল ইংল্যান্ড থেকে অলিম্পিক (Paris Olypmics), পিভি সিন্ধু থেকে কন্যা গায়ত্রী, সব কিছু নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে। শুনলেন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: সামনেই আগামী ১২ মার্চ থেকে অল ইংল্যান্ড ওপেন। প্রথম রাউন্ডেই আবার বিশ্বের এক নম্বর শাটলার ভিক্টর অ্যাক্সেলসেনের সামনে পড়েছেন কিদাম্বি শ্রীকান্ত। কী হবে বলে মনে হয়?
গোপীচাঁদ: টাফ টুর্নামেন্ট হবে। দেখুন, অল ইংল্যান্ড যে কেন্দ্রে খেলা হয়, তার একটা আলাদা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। স্লোপ কোর্টে খেলার শক্তি থাকতে হবে আপনার। কিন্তু আমার ধারণা, এবার ভালো করব আমরা।
প্রশ্ন: বলছেন?
গোপীচাঁদ: মনে তো হচ্ছে। সাম্প্রতিক অতীতে ভালো করেছি আমরা। বহু বছর আমরা অল ইংল্যান্ড জিতিনি। কাছে গিয়েছি। গিয়ে ফিরে এসেছি। এ বার সেই আক্ষেপ মিটবে মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন: আর মাস কয়েক বাদে প্যারিস অলিম্পিক। তার আগে অল ইংল্যান্ড তো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। বলতে চাইছি, একটা সার্বিক আগাম ধারণা তো নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে যে আমাদের দেশের শাটলাররা অলিম্পিকে কেমন করতে চলেছেন?
গোপীচাঁদ: বলতে পারেন। দেখতে গেলে অলিম্পিকের আগে এটাই সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট। সন্দেহ নেই যে, আমরা ভালো কিছু টুর্নামেন্ট জিতেছি। কিন্তু অল ইংল্যান্ড দেখে আমরা বুঝতে পারব, প্রস্তুতি অনুপাতে অলিম্পিকের আগে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে?
প্রশ্ন: অলিম্পিকের আগে পিভি সিন্ধু কী অবস্থায় রয়েছেন, তার ধারণাও তো অল ইংল্যান্ডে পাওয়া যাবে। গত বছর সাতটা টুর্নামেন্টে প্রথম রাউন্ডে ছিটকে গিয়েছেন যিনি।
গোপীচাঁদ: সিন্ধুর বিএটিসি পারফরম্যান্স ভালো ছিল। তাছাড়া ও জানে কী ভাবে বড় মঞ্চে পারফর্ম করতে হয়। প্লাস যে সব কোর্টে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন পড়ে, পিভি সেখানে সেরা। তবে ঠিকই বলেছেন। অল ইংল্যান্ড আর ফরাসি ওপেন একটা ধারণা দিয়ে যাবে পিভি এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে।
প্রশ্ন: একটা প্রশ্ন আপনাকে প্রায়ই শুনতে হয়। সেটা আবারও করব। তবে সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন করব।
গোপীচাঁদ: বলুন প্রথমটা।
প্রশ্ন: পিভি সিন্ধুর পরে কে?
গোপীচাঁদ: প্রচুর তরুণ প্রতিভা রয়েছে। আনমোল খার্ব নামে যে মেয়েটি এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ভালো করল, ও একটা নাম। কিন্তু তার জন্য আনমোলকে অনেক খাটাখাটনি করতে হবে। আরও কয়েক জন আছে। আগামী কয়েক বছরে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন: আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, কোচ পুল্লেলা গোপীচাঁদের পরে কে? ধরুন যে ব্যাডমিন্টন কোচিংয়ে আসতে চায়, তার আদর্শ ম্যানুয়াল কী হবে? গোপীচাঁদ হতে গেলে তাকে কী করতে হবে?
গোপীচাঁদ: আমার মতে, চ্যাম্পিয়ন প্লেয়ারের মতো চ্যাম্পিয়ন কোচ বের করতে সমগ্র সিস্টেমের সহায়তা প্রয়োজন। একজন কোচের সবচেয়ে বেশি কাম্য বস্তু হল সম্মান। উৎসাহ। আমাদের দেশে অনেকে আছে যারা কি না সদ্য খেলা ছেড়ে কোচিংয়ে এসেছে। যেমন অনুপ শ্রীধর। যেমন অরুণ বিষ্ণু। এদের প্রত্যেকের মধ্যে ক্ষমতা আছে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। মনে রাখা দরকার, চ্যাম্পিয়ন প্লেয়ার পেতে গেলে কিন্তু চ্যাম্পিয়ন কোচও প্রয়োজন।
[আরও পড়ুন: ‘অধিনায়কের জন্যই হারলাম’, রনজি থেকে বিদায়ের পর কোচের তোপ, ক্ষুব্ধ কার্তিক]
প্রশ্ন: আপনার কোচিং নিয়ে একটা কথা শুনেছি। খেলতেন যখন, তখন করতেন। এখনও করেন। খেলা চলাকালীন আপনি নাকি মনে মনে ম্যাচটাকে ‘রিওয়াইন্ড’ করেন?
গোপীচাঁদ: করি। ‘এন্ড গেম’-এর সময় প্লেয়ার কী চায়? কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক সে জানতে চায় না। সে চায় খোলাখুলি জানতে যে কী করতে হবে? কোন শটটা তাকে মারতে হবে। আমি তখন ম্যাচটাকে মনে মনে ফের দেখতে শুরু করি। ভাবি, প্লেয়ার পুরো ম্যাচে কোন শটটা খেলেনি। কোন শট খেললে প্রতিপক্ষ চমকে যাবে। তবে এক্ষেত্রে প্লেয়ারের সঙ্গে আমার পারস্পরিক বিশ্বাসটাও থাকা দরকার। প্লেয়ার বিশ্বাস করলে তবেই না আমার কথামতো খেলার অন্তিম মুহূর্তে নির্দিষ্ট শট খেলবে।
প্রশ্ন: আরও একটা জিনিস। আপনার মেয়ে গায়ত্রী গোপচাঁদকে নিয়ে আপনি তেমন কিছু বলেনই না। যিনিও দেশের প্রথম সারির ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার। গায়ত্রী গোপীচাঁদ কী ভাবে তৈরি হল, বলুন না।
গোপীচাঁদ: আমার ভাগ্য ভালো যে, গায়ত্রী এই পর্যায়ের ব্যাডমিন্টন খেলছে। খেলাটার শিষ্যা ও। ভালো এগোচ্ছে এখনও পর্যন্ত।
প্রশ্ন: কিন্তু মেয়ের ব্যাডমিন্টন র্যাকেট হাতে তুলে নেওয়া আপনাকে কি অনুপ্রাণিত করে না? আরও ভালো কোচ হওয়ার প্রেরণা জোগায় না?
গোপীচাঁদ: (হেসে) সেই ছ’সাত বছরে ব্যাডমিন্টন শুরু করেছিল গায়ত্রী। আমি ভোর চারটেয় নেমে পড়তাম। ও সাড়ে ছ’টায় আসত। দু’ঘণ্টা ট্রেনিং করত। ক্লান্ত হয়ে পড়ত তার পর। যে ক্লান্তিটা দেখে তৃপ্তি হত আমার। আনন্দ পেতাম। আর কী জানেন, গায়ত্রী ব্যাডমিন্টন খেলবে ঠিক করায় পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগটা থেকে গিয়েছিল। আমি অনেক ভোরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। ফিরতাম যখন, গায়ত্রী ঘুমিয়ে পড়ত। দেখাই হত না প্রায়। আর পাই তো অনুপ্রেরণা। আজ গায়ত্রী টিমের অংশ বলে ট্রাভেল করতে উৎসাহ পাই আমি।
প্রশ্ন: অল ইংল্যান্ড দিয়ে সাক্ষাৎকার শুরু করেছিলাম। অলিম্পিক দিয়ে শেষ করছি। টোকিওর পর দেশের পদক প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছে অনেক। ক’টা পদক আসতে পারে, পূর্বাভাস করুন না।
গোপীচাঁদ: টোকিওর চেয়ে বেশি পদক জয়ের আশা রাখছি প্যারিসে। ব্যাডমিন্টনে একাধিক ইভেন্টে আমাদের পদক জয়ের সুযোগ রয়েছে। সাত্ত্বিকসাইরাজ-চিরাগ জুটিকে হারানো প্রচণ্ড কঠিন হবে। আশা করছি, একের বেশি পদক নিয়ে ফিরব এবার। আর সেই পদকের রং সোনালি হবে!