সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ভারতীয় সেনার অন্দরমহলে কান পাতলে আজও শোনা যায় স্যাম বাহাদুরের নাম৷ দেশের প্রতিরক্ষায় অসমসাহসের পরিচয় রেখেছেন অনেকেই৷ কিন্তু বীরত্ব, হিউমার, সাহস সব মিলিয়ে শ্যাম যেন এক বর্ণময় কিংবদন্তি৷ সোমবার তাঁর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দেশজুড়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন।
ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশকে স্যাম বাহাদুর বা স্যাম ‘দ্য ব্রেভ’ নামেই চেনেন সকলে৷ একসময় ভেবেছিলেন ডাক্তার হিসেবে৷ কিন্তু মত পরিবর্তন করে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে৷ ভাগ্যিস করেছিলেন! নইলে এমন বর্ণময় চরিত্র পেত না ভারতীয় সেনাবাহিনী৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসম সাহসিকতার কথা আজও ভোলার নয়। ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ তাঁর নিজের বীরত্বের প্রথম স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ১৯৪২-এর যুদ্ধেই৷ তাঁকে ব্রিটিশ সামরিক সম্মান মিলিটারি ক্রস দেওয়া হয়েছিল৷ আর তিনি নিজে সাহসিকতা এবং বীরত্বের জন্য ভারতীয় বাহিনীর গোর্খা সৈন্যদের খুব পছন্দ করতেন৷ ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে গোর্খা সৈনিকদের অসাধারণ শৌর্য ইতিহাস হয়ে আছে৷ সেই যুদ্ধের পর ফিল্ড মার্শাল মানেকশ বাঙালির ঘরে ঘরেও পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন৷ বহু যুবক সেই সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন শুধুমাত্র মানেকশ-কে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে৷ এখনও তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর কাছে গর্বের এক সম্পদ৷
পুরো নাম স্যাম হোরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ৷ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদ্যরা তাঁকে ডাকতেন স্যাম বাহাদুর বলে৷ বাহাদুর তো তিনি ছিলেনই, যুদ্ধক্ষেত্রে বার বার সেই বাহাদুরির প্রমাণও মিলেছে৷ কিন্তু এই নামকরণের কারণটা একটু অন্য৷ ফিল্ড মার্শাল মানেকশ-র খটোমটো পার্শি নাম উচ্চারণ করতে পারছিলেন না এক গোর্খা সৈন্য৷ তাঁর মুখে যে শব্দটা সবথেকে সহজে, সবার আগে এসেছিল, সেই বাহাদুর জুড়ে দিয়েছিলেন প্রিয় ফিল্ড মার্শালের নামের পাশে৷ সেই থেকেই সহযোদ্ধাদের কাছে স্যাম বাহাদুর৷ আর সরকারি পরিচয় জ্ঞাপনে কিংবা সামরিক নথিতে ফিল্ড মার্শাল মানেকশ৷
কেমন এই শ্যাম বাহাদুরের কীর্তি? কয়েকটি নমুনাতেই স্পষ্ট হবে কেন তিনি দেশের ডেয়ারডেভিল আর্মি জেনারেলদের একজন৷ ১৯৭১-এ পাক সেনার অনুপ্রবেশ আটকানো সম্ভব হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বেই৷ এরকমই এক যুদ্ধক্ষেত্রে মারাত্মক জখম হয়েছেন শ্যাম৷ শরীরে বিঁধে আছে সাত সাতটা বুলেট৷ চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের সময় জানতে চাইলেন, হয়েছে কী? শ্যাম বাহাদুরের নিরুত্তাপ জবাব, ‘ও কিছু নয়, একটা বাঁদরে লাথি মেরেছে এই যা৷’
এরকমই বাহাদুর ছিলেন শ্যাম৷ ঘোর বিপদেও কীভাবে যে তিনি তাঁর রসিকতাবোধ ধরে রাখতে পারতেন, তা তাঁর সতীর্থ তো বটেই, পরবর্তী প্রজন্মের সেনাদের কাছেও এক রহস্য৷ সেনার মধ্যে বিদ্রোহ বা ক্যু-এর গুজব শুনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ব্যাপারটা সত্যি কি না৷ শ্যামের সপ্রতিভ উত্তর ছিল, ‘আপনি আপনার ব্যাপার নিয়ে থাকুন, আমি আমার৷ আপনি আপনার কাছের মানুষকে চুমু খান, আমি আমার৷ আমি রাজনৈতিক বিষয়ে নাক গলাব না, যদি না কেউ আমার সেনার ভিতরে নাক গলায়৷’ এ কথাতেই যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, আর উচ্চবাচ্য করেননি৷ রাজনীতিবিদদের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা কীরকম ছিল? শ্যামের মন্তব্য, ‘আমি ভাবি প্রতিরক্ষার দায়িত্বে যে রাজনীতিবিদরা থাকেন তাঁরা আদৌ মোটর আর মর্টার, গেরিলা আর গরিলার তফাৎ করতে পারেন কি না! তবে গরিলার সঙ্গে ওঁদের অনেকেরই মিল পাওয়া যায়৷’
শোনা যায়, স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁর মোটরবাইকটি কিনেছিলেন৷ সেই আমলে তার দাম ছিল ১,০০০ টাকা৷ কিন্তু দাম আর দেওয়া হয়নি৷ পরে এ নিয়ে শ্যাম বাহাদুরের মন্তব্য ছিল, ইয়াহিয়া আমার বাইকের দাম দেয়নি, এখন দেশের অর্ধেক দিয়ে দাম মেটাচ্ছে৷ তরুণ সেনারাও এই জেনারেলকে প্রায় ভগবানের মতো ভক্তি করতেন৷ আর করবেন নাই বা কেন! একবার এক সেনা গুলির আঘাতে জখম৷ তাঁকে দেখতে গিয়ে শ্যাম বলেছিলেন, ‘এই বয়সে তুমি তিনটে গুলি খেয়েছ, আর এই বয়সে আমি পাঁচটা গুলি খেয়েছিলাম৷ আর দেখ, আজ আমি ভারতীয় সেনার কম্যান্ডার৷ আর এক সেনার মালপত্র বয়ে দিচ্ছেন স্বয়ং জেনারেল৷’ সেই সেনা তো আপ্লুত৷ তিনি বললেন, ‘আমি সবসময় এই সাহায্য করে থাকি৷ অবসর সময়ে এঁদের নির্দেশও দিই৷’
এরকমই বর্ণময় চরিত্র তিনি৷ ফিল্ড মার্শাল হিসেবে তিনিই প্রথম ফাইভ স্টার পান ভারতীয় সেনায়৷ ২০০৮ সালে ৯৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়৷ কিন্তু আজও সেনাবাহিনীর অন্দরে আনাচে-কানাচে কান পাতলেই শোনা যায় স্যাম বাহাদুরের গল্প৷
The post ‘৫০০ টাকা দেয়নি ইয়াহিয়া, অর্ধেক দেশ দিয়ে ঋণ মেটাচ্ছে পাকিস্তান’ appeared first on Sangbad Pratidin.