বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য ও শান্তনু কর : তীব্র তাপদহে মরুভূমির চেহারা নিয়েছে উত্তরের বিস্তীর্ণ এলাকার চাষের মাঠ। সেচের জল মিলছে না। রোদে ঝলসে উধাও সবুজ। পাট, ভুট্টা, বাদাম থেকে সবজি---রক্ষা পায়নি কিছুই। জলের অভাবে চাষের এলাকাও কমেছে। কোচবিহার থেকে মালদহ ছবিটা একই। প্রায় খরা পরিস্থিতিতে আট জেলার লক্ষাধিক কৃষক বিপাকে। যদিও কৃষি দফতর এখনও হিসেব করে উঠতে পারেনি জেলাগুলোতে কত হেক্টর জমির ফসল তাপদাহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উত্তরে তাপমাত্রার পারদ ৩৫ ডিগ্রি থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। গৌড়বঙ্গের তিন জেলায় তাপপ্রবাহের তীব্রতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সমতলের অন্য তিন জেলা কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়িতেও চলছে একটানা তাপদাহ। তারই জেরে চা বাগানের পাশাপাশি ভয়ঙ্কর ক্ষতির মুখে গ্রীষ্মকালীন সবজি, পাট, ভুট্টা, বাদাম, বোরোধান। গ্রীষ্মকালীন সবজি বলতে চাষ শুরু হয়েছিল পটল, বেগুন, কুমড়ো, ঢেড়শ, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, শশা, লঙ্কা, সজি কচু, স্কোয়াশের। কিন্তু তাপপ্রবাহের জন্য গাছের পাতা, গোড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। বেড়েছে মাকড় জাতীয় পোকার আক্রমণ। গাছ শুকিয়ে মরছে। একই দশা হয়েছে বাদাম, ভুট্টা, পাটের। এমনিতেই এবার অনাবৃষ্টির জন্য পাটবীজ রোপণের সময় পিছিয়েছে প্রায় একমাস। চাষিরা মার্চমাসে যে বীজ বুনেছিলেন সেটারই চারা দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সেই চারাও তাপদহে ঝলসে ঝিমিয়ে শেষ হয়েছে। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বিঘার পর বিঘা চাষের মাঠ দেখে মনেই হবে না এখানে কোনও ফসল ছিল। মাটি শুকিয়ে রীতিমতো ধূলো উড়ছে। উত্তর দিনাজপুরের কৃষি অধিকর্তা পার্থ রায় বলেন, "পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মাটিতে রস নেই। পাটচারা শুকিয়ে মরছে। এই মূহুর্তে সেচের ব্যবস্থা খুব প্রয়োজন।" কিন্তু কৃষিকর্তা সতর্ক করলে হবে কি, চাষিরা পারছেন কোথায়? একদিকে খরচের ধাক্কা সামলে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ায় জলের আকাল শুরু হয়েছে। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের অসম মোড় সংলগ্ন এলাকার পাটচাষি সত্যেন রায় জানান, চারবিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। চারা শুকিয়ে মরেছে। টাকার জন্য সেচের ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। কত খরচ? সত্যেনবাবু বলেন, "পাম্প মেশিন ভাড়া করে একবিঘা জমিতে সেচ দিতে খরচ হয় ১ হাজার টাকা। চারবিঘা জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।" এদিকে কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমার ধাপড়া এলাকার পাট চাষি দেলোয়ার হোসেন বলেন, "পাম্প চালিয়েও জল উঠছে না।"
[আরও পড়ুন: ‘তৃণমূলী সন্ত্রাসে ঠান্ডা জল ঢালবে বিজেপি’, সুকান্তর সঙ্গে পান্তাভাতে মধ্যাহ্নভোজ সেরে হুমকি দিলীপের]
সমস্যার কথা স্বীকার করলেও বিকল্প উপায় বাতলাতে পারছেন না কৃষিকর্তারা। কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তরের পাহাড় ছাড়া প্রতিটি জেলায় পাট চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি পাট চাষের এলাকা রয়েছে কোচবিহার ও উত্তর দিনাজপুর জেলায়। দুই জেলায় প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। দক্ষিণ দিনাজপুরে পাট চাষের এলাকা প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর, মালদহে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর, জলপাইগুড়িতে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর এবং আলিপুরদুয়ারে ২ হাজার দুশো হেক্টর। মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে তাপপ্রবাহ চলছে। মালদহ জেলার বেশি পাটচাষ হয় চাঁচল মহকুমায়। এলাকার পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার হেক্টর। এখানে পাটচারা শুকিয়ে মরেছে। অনেকে বীজ বুনতে পারেনি। একই দশা ইসলামপুরেও।
এদিকে তীব্র গরম ও অনাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জলপাইগুড়ির তিস্তাপাড়ের একরের পর একর চাষের জমি। রোদে জ্বলে নষ্ট হয়েছে বাদাম, ভুট্টা, লঙ্কা। মাথায় হাত পড়েছে তিস্তাপাড়ের সারদাপল্লি, দক্ষিণ সুকান্ত নগর, মন্ডলঘাট এলাকার কৃষকদের। চাষের জমি খাখা করছে রোদে।শুকিয়ে লাল হয়েছে ভুট্টা গাছ। নেতিয়ে পড়েছে বাদাম ও লঙ্কা। জলপাইগুড়ি জেলায় এবার প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। শুধু জলপাইগুড়ি সদর নয়। রাজগঞ্জ, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, ক্রান্তি এলাকাতেও জলের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে ভুট্টা, লঙ্কা, বাদাম গাছ। সারদা পল্লির কৃষক বাবু বিশ্বাস জানান, স্যালো দিয়ে জল দিয়েও গাছ বাঁচানো যাচ্ছে না। রোদের তাপে নেতিয়ে পড়ছে গাছ। একরের পর একর ভুট্টা, বাদামের জমি নষ্ট হয়েছে বলে জানান তিনি। জলপাইগুড়ি কৃষি বিভাগের সহ কৃষি আধিকারিক শুভ দাস জানান, একে গরম আবহাওয়া। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি। শুধু পাট, ভুট্টা অথবা সবজি নয়। জলের অভাবে বোরো ধান চাষেও সমস্যা বেড়েছে। আলিপুরদুয়ার জেলা কৃষি অধিকর্তা নিখিল মন্ডল জানান, "বৃষ্টি না হওয়ায় বোরো ধানের ফলনে সমস্যা বেড়েছে। জলের অভাবে অনেক জায়গায় গাছ নষ্ট হয়েছে।" তবে গরমের জন্য ঠিক কত পরিমাণ চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই হিসেব এখনও কৃষিকর্তারা করে উঠতে পারেননি। তারা জানান, সমীক্ষা শুরু হয়েছে।