ইন্দ্রজিৎ দাস: দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজোর রেশ ফিকে হতে না হতেই রাজ্যজুড়ে আলোর উৎসব, শক্তির আরাধনার প্রস্তুতি। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের প্রাচীন কালী মন্দিরগুলিতে ইতিমধ্যেই ধুমধাম শুরু হয়েছে। পিছিয়ে নেই শহর কলকাতাও। শহরের বেশ কিছু প্রাচীন কালীমন্দির এবং তাদের মাহাত্ম্যের কথা রইল এই প্রতিবেদনে।
ফিরিঙ্গি কালী, বউবাজার
বউবাজার থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের দিকে যে রাস্তা গিয়েছে, সেই রাস্তার ডান দিকে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। একসময় এই অঞ্চলটি ছিল শ্মশান। হোগলাপাতার একটি ঘরে ছিল শিবের অবস্থান। সামনে ছিল গঙ্গা থেকে আসা একটা খাল। এই শিবমন্দিরে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি আসতেন। একদিন এখানেই প্রতিষ্ঠিত হল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সিদ্ধেশ্বরী কালী। পর্তুগিজ অ্যান্টনি মায়ের পুজোর দায়িত্ব দিলেন শ্রীমন্ত পণ্ডিতকে। সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মূর্তিটি দেখার মতো। চোখে পড়ে দেবীর রুপোর মুকুটটি। ত্রিনয়নে কোনও উগ্রতা নেই। নানা অলংকারে দেবী সজ্জিতা। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন- সব ধর্মের মানুষ দেবীকে প্রণাম করেন, জানান তাঁদের অন্তরের কথা। মায়ের মন্দিরের পিছনে রয়েছে একটা কাঠচাঁপা গাছ, যার গোড়াটি মহাদেবের বাহন ষাঁড়ের মতো। অনেকেই মানতের জন্য এখানে কাপড় বেঁধে যান। প্রতিদিন মন্দির রাত ন’টায় বন্ধ হলেও দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন যতক্ষণ অমাবস্যা থাকবে মন্দির খোলা থাকবে। প্রতি বছর কালীপুজোর আগে মায়ের অঙ্গরাগ হয়। কালীপুজোর দিন মায়ের ভোগে থাকে গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, পাঁচ রকমের ভাজা, দু’রকমের তরকারি, পোলাও, চাটনি, পায়েস। এছাড়া থাকে দই, মিষ্টি। দেবীকে দেওয়া হয় নিরামিষ ভোগ।
বউ বাজারের ফিরিঙ্গি কালী।
[ইংরেজ সাহেবের হাতেই পত্তন কালচিনির হ্যামিল্টনগঞ্জের কালীপুজোর]
সিদ্ধেশ্বরী কালী, বেহালা
বেহালা ট্রাম ডিপোর কাছে ডায়মন্ড হারবার রোডের উপরেই সিদ্ধেশ্বরী মা কালীর মন্দির। ১১৭০ বঙ্গাব্দের ১২ জৈষ্ঠ্য ফলহারিণী কালীপুজোর দিন মন্দির স্থাপিত হয়। দেবী মাটির তৈরি। মাথায় রুপোর মুকুট। জিভটি সোনার। গলায় রুপোর মুণ্ডমালা। হাতে সোনার বালা। বিশেষ পুজোর দিনে মায়ের নিচের ডান হাতে রাখা হয় পানপাত্র, তাতে থাকে কারণবারি। এই মন্দিরে মহা ধুমধামের সঙ্গে হয় দীপান্বিতা কালীপুজো। ওইদিন মাকে দেওয়া হয় খিচুড়ি, পাঁচরকম ভাজা, লাবড়া, আলুর দম, নানা সবজির তরকারি, চাটনি, পায়েস। এছাড়াও মায়ের ভোগে থাকে রুই, কাতলা, ভেটকি, বাটামাছ ও পাঁঠার মাংস। কালীপুজোর দিন সারা রাত মন্দির খোলা থাকে। ভক্তরা দেখেন মায়ের পুজো। সকাল থেকে ভক্তরা আসেন মায়ের পুজো দিতে। প্রতি বছর কালীপুজোর আগে মায়ের অঙ্গরাগ হয়। এই মন্দিরে দীপান্বিতা কালীপুজো ছাড়াও ফলহারিণী কালীপুজো এবং রটন্তী কালীপুজোও মহা ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। আগে পুজোর সময় বলি হত। এখন তা বন্ধ। তবে কোনও ভক্ত প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এলে বলি হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মায়ের যখন আরতি হয়, ভক্ত থেকে শুরু করে পথচলতি সব মানুষ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে যান। আরতি দেখতে দেখতে মায়ের কাছে মনোবাসনাও জানিয়ে ফেলেন।
[ভাঙন রুখতেই পাগলি কালীর আরাধনায় মাতেন মালদহবাসীরা]
সিদ্ধেশ্বরী কালী, কুমোরটুলি
বহু বছর আগে কালীবর নামে এক সন্ন্যাসী কুমোরটুলি অঞ্চলে হোগলাপাতার ছাউনিতে শ্যামা মায়ের আরাধনা শুরু করেছিলেন। নিজেই সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি তৈরি করে পুজো করতেন। সেই সময় এই জঙ্গলময় অঞ্চল ছিল ডাকাতের অধীনে। দেবী সিদ্ধেশ্বরী হয়ে ওঠেন ডাকাতদের দেবী। শোনা যায়, দেবী সিদ্ধেশ্বরীর কাছে নরবলিও হত। পরে শম্ভুচরণ ও তারাচরণ নামে দুই ব্রাহ্মণ ছেলের হাতে মা সিদ্ধেশ্বরীর পুজোর দায়িত্ব এল। তাঁরা শ্যামা মাকে পারিবারিক দেবীরূপে গড়ে তুললেন। কাপালিক ও ডাকাতদের পুজিতা মা সিদ্ধেশ্বরী হয়ে উঠলেন গৃহীর ‘মা’। মা সিদ্ধেশ্বরী মাটির তৈরি মূর্তি। প্রতি অম্বুবাচীতে মাকে পুরোপুরি স্নান করানো হয়। অথচ আশ্চর্য, মাটির মূর্তি ধুয়ে যায় না। এই মন্দিরের দুয়ারে এসে আকুতি জানিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘ওরে এই মা সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন।’ একবার কেশবচন্দ্র সেনের রোগমুক্তির জন্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে ডাব আর চিনি মানত করেছিলেন। নাট্যসম্রাট গিরিশ ঘোষও আসতেন কুমোরটুলির সিদ্ধেশ্বরী মায়ের কাছে। তাঁর রচিত নাটক উৎসর্গ করতেন দেবীর চরণে। আদর করে দেবীকে বলতেন ‘উত্তর কলকাতার গিন্নি’। দীপান্বিতা কালীপুজোয় প্রায় সারা রাত মন্দির খোলা থাকে। ভক্তরা দেখেন মায়ের পুজো। কালীপুজোয় মায়ের ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদা ভাত, পাঁচ রকমের ভাজা, দু’রকমের তরকারি, মাছের ঝোল, চাটনি, পায়েস ও নানা রকমের মিষ্টান্ন। এছাড়াও মাকে দেওয়া হয় মাংস, যেটা পুজোয় বলি হয়।
[শ্যামাপুজো উপলক্ষে হিলিতে মিলিত হয় দুই বাংলা]
The post কলকাতার এইসব কালীবাড়ির ইতিহাস জানেন? আজ প্রথম পর্ব appeared first on Sangbad Pratidin.