অর্ণব আইচ: টিনটিন, শার্লক হোমস থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফেসবুকের যুগে ‘বইপোকা’ সৌমেন বাগের একমাত্র নেশা ছিল গল্পের বই। তাই মাঝে মাঝেই কলেজ স্ট্রিটে গল্পের বই কিনতে ছুটতেন ২৩ বছরের এই যুবক।
টেবিলের উপর দাঁড় করানো টিনটিনের কমিকস। সার দিয়ে রাখা একের পর এক গল্পের বই। যেন এখনই এসে একটি বই টেনে নিয়ে ডুবে যাবেন গল্পে। বুধবার বেহালার শীলপাড়ার ছোট ঘরটির মধ্যে সার দিয়ে রাখা গল্পের বইগুলো যেন হঠাৎ বড় ‘একা’ হয়ে গেল। সৌমেন আর বাড়ি ফিরে নাড়াচাড়া করবেন না তাঁর প্রিয় বইগুলো। মঙ্গলবার বিকেলে বই কিনে ফেরার পথেই মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয় সৌমেন বাগের। বন্ধু পাপাইয়ের বাইক করে নিজের গল্পের বই ও বোনের জন্য খাতা কিনে বাড়িতে ফিরছিলেন। এদিন বইগুলোর দিকে তাকিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা অনিতা বাগ। বারবার বলতে থাকেন, “একবারের জন্যও যদি জানতাম বন্ধুর বাইকে করে কলেজ স্ট্রিট যাবে, ওকে যেতে দিতাম না। ওকে এভাবে মরতে হত না।”
[ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার আরও একজনের দেহ, সেতু বিপর্যয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩]
তদন্তের পর পুলিশ জানিয়েছে, মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ার সময় সৌমেন বাইক থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন। কংক্রিটের একটি চাঙড় এসে তাঁর বুকের উপর পড়ে। চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল তাঁর। প্রাথমিক আকস্মিকতা কাটানোর পর উদ্ধারকারীরা কোনওমতে তাঁর বুকের উপর থেকে সেই চাঙড় সরান। এর পরও কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে ছিলেন যুবক। তাঁকে বসিয়ে জল খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার পরই মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুর পরও তাঁর চোখ খোলা ছিল। কপালে ছিল একটি চোট। এদিন তাঁর দেহের ময়নাতদন্ত হয়। মূলত অভ্যন্তরীণ আঘাতের ফলেই মৃত্যু হয় সৌমেনের। এখনও বন্ধু পাপাই গুরুতর আহত অবস্থায় ভর্তি হাসপাতালে।
[মাঝেরহাট সেতুভঙ্গে রাজ্যের দিকেই আঙুল তুলল রেল]
ছোটবেলা থেকে শীলপাড়ায় মামার বাড়িতেই মানুষ সৌমেন। মামিমা মমতা ঘোষ জানান, গত রবিবার জন্মাষ্টমীর দিনই ছিল সৌমেনের জন্মদিন। তাঁর জন্য পায়েস তৈরি করা হয়েছিল। যদিও জন্মাষ্টমী বলে মাংস রান্না না করায় আক্ষেপ ছিল তাঁর। যদিও জানা গিয়েছে, গত ১২ আগস্ট একটি রেস্তরাঁয় প্রাণের বন্ধু পাপাইয়ের সঙ্গে সেলিব্রেশন করেছিলেন সৌমেন। কয়েকদিনের মধ্যে ফের সেলিব্রেশন হওয়ার কথা ছিল। মঙ্গলবার সকাল এগারোটা নাগাদ সৌমেন মা ও মামিমাকে জানান, তিনি বন্ধুর সঙ্গে কয়েকটি গল্পের বই ও মামাতো বোন মৌমিতার জন্য খাতা কিনতে কলেজ স্ট্রিটে যাচ্ছেন। বিকেলে বোন মৌমিতা ফোন করেন দাদার মোবাইলে। এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি বলেন, তাঁর দাদা দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সরশুনা কলেজ থেকে বি কম পাস করে ওষুধের সংস্থার চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন সৌমেন। বেতনের বড় একটি অংশ চলে যেত গল্পের বই কিনতেই। প্রতিবেশী আবদুল কালাম বলেন, “ফেসবুকের যুগে যেখানে বহু যুবক বই পড়তেই ভুলে গিয়েছে, সেখানে সৌমেনের একমাত্র নেশা ছিল গল্পের বই পড়া।” বাবা প্রদীপ বাগ ছোট ব্যবসা করেন। তাঁর মায়ের আক্ষেপ, দুর্ঘটনা ঘটার পর ছেলের কেনা শেষ বইয়ের খোঁজ আর তিনি পাননি। হয়তো তা মিশে গিয়েছে ভাঙা ব্রিজের ধ্বংসস্তূপে। এলাকার বাসিন্দারাও ভাবতে পারছেন না যে এভাবে তাঁদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন পাড়ার ‘বইপোকা’।