গৌতম ব্রহ্ম: “এদিকে চারশো, ওদিকে চারশো…বডি হচ্ছে ওয়ার্ক অফ আর্ট। মাসলগুলো মন্দিরের কারুকার্য।” – ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর সেই সংলাপ মনে আছে? বডি বিল্ডার (Body builder)গুণময় বাগচীর বাইসেপ, ট্রাইসেপ, কোয়াড্রাসেপ? বহু মানুষ আজও সিনেমার ওই দৃশ্যটুকু বারবার রিওয়াইন্ড করে দেখেন। এককালে গুণময় বাগচীরা ছিলেন বাংলার গর্ব। ধীরে ধীরে তাঁরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস ছেড়ে নয়া বডি বিল্ডার হওয়ার কোনও আকুতি আর খুঁজে পাওয়া যায় না নতুন প্রজন্মের মধ্যে। কয়েকটা জেলায় দেহসৌষ্ঠবের প্রতিযোগিতা হয় ঠিকই, কিন্তু তার গুণগত মান তথৈবচ। টিমটিম করে কোনও মতে নিয়মরক্ষা।
অথচ, এই বাংলাই স্বাধীন ভারতকে প্রথম ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ উপহার দিয়েছে – বিশ্বশ্রী মনোতোষ রায়। ১৯৫১ সালে বিলেতের স্কালা থিয়েটারে আয়োজিত ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন তিনি। দেহসৌষ্ঠবের ময়দানে সাদা চামড়ার ‘সোয়ার্জেনেগার’দের একচ্ছত্র আধিপত্য চুরমার করে দেন। ‘পকেট হারকিউলিস’ মনোহর আইচও মিস্টার ইউনিভার্স হয়েছিলেন, এশিয়ান গেমসে তিনবার স্বর্ণপদকও জেতেন।
[আরও পড়ুন: চোখের জলে উইম্বলডনকে বিদায় সেরেনার, ‘ভয়ে’র অভিজ্ঞতা জানালেন ফেডেরার]
সেই সোনালি অতীতের ছায়াও এখন প্রায় গায়েব বাংলার মাটি থেকে। ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ হয়ে ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় যাঁরা যাচ্ছেন, সবাই ভিন রাজ্যের। অথচ একটা সময় বাঙালির পাড়ায় পাড়ায় গুণময় বাগচীরা দাপিয়ে বেড়াতেন, সর্বভারতীয় দেহসৌষ্ঠব প্রতিযোগিতায় রাজ করতেন। সেই আক্ষেপ প্রকট সত্যজিৎ রায়ের ‘গুণময় বাগচী’ তথা মনোতোষ রায়ের পুত্র মলয় রায়ের কণ্ঠে, “বাবার তৈরি জিমটা আমিই চালাই। দু’শোর মতো ছাত্র ছিল, করোনার জন্য সব চৌপাট। বডি বিল্ডার হওয়ার জন্য দু’জন এসেছিল, তারাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে।”
১ জুলাই থেকে রাজ্যে ফের জিমের দরজা খুলছে। কিন্তু দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সেগুলোর অধিকাংশ এখন কার্যত ভেন্টিলেশনে। অনেক প্রশিক্ষক বিকল্প পেশায় চলে গিয়েছেন। মলয়বাবুর কথায়, “করোনার জন্য সব নষ্ট হয়ে গেল। অর্থসাহায্য না পেলে বেশিরভাগ জিম বন্ধ হয়ে যাবে।” একই বক্তব্য ফিটনেস ট্রেনার শুভব্রত ভট্টাচার্যর। তিনি বলেন, “ জিমখানাগুলির সঙ্গে বহু মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে। ধুঁকতে থাকা জিমখানাগুলির কিছু সরকারি আনুকূল্য পাওয়া উচিত।” বঙ্গে এখন রাজ্যস্তরে সবমিলিয়ে দু’শোর মতো বডিবিল্ডার। কয়েক দশক আগেও ছবিটা অন্যরকম ছিল। হাজার হাজার ছেলে বডি বিল্ডিং করত। পাঁচবার ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ খেতাব জিতেছেন বঙ্গভূষণ তুষার শীল। মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় রানার্স হয়েছেন। তুষারবাবুর মন্তব্য, “মনোতোষ রায়, মনোহর আইচ কিংবা আমরা প্রাকৃতিক উপায়ে শরীরচর্চা করে বিশ্বশ্রী প্রতিযোগিতায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন বডি বিল্ডিং ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ আর বড় বড় যন্ত্রের খেলা। যার পকেটের জোর বেশি, সে তত দ্রুত সাফল্য পাবে।”
[আরও পড়ুন: পরিশ্রমের স্বীকৃতি, খেলরত্ন পুরস্কারের জন্য দ্যুতি চাঁদকে মনোনীত করল ওড়িশা সরকার]
সত্যজিৎ রায়ের গুণময় বাগচীও হতাশ। জানালেন, এখন বডি বিল্ডারদের একাধিক সংগঠন, রাজনীতি ঢুকে পড়েছে সর্বত্র। জানা গিয়েছে, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল বডি বিল্ডিং অ্যান্ড ফিজিক স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন’ ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান বডি বিল্ডার অ্যাসোসিয়েশন’ কর্তৃক স্বীকৃত হলেও ‘বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন’ এই সংস্থাকে মান্যতা দেয়নি। দিয়েছে অন্য একটি সংস্থাকে। ফলে সরকারি অনুদান ঠিক জায়গায় পৌঁছচ্ছে না। দলাদলির চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছেন গুণময় বাগচীরা।