ফারহান আখতার: শচীন তেণ্ডুলকর (Sachin Tendulkar) আর আমি প্রায় সমবয়সি। একই সময়ে এই মুম্বই শহরে বেড়ে উঠেছি। যখন আমাদের দেখা হয়নি, তখনও আমি শচীনের সঙ্গে এক রকমের আত্মিক নৈকট্য অনুভব করেছি। ব্যাপারটা কীরকম? একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমার মনে হয়, দশকের পর দশক আমার একটা অংশ হয়েই থেকেছেন শচীন। এটা তখনই সম্ভব, যখন একজন মানুষ আর-একজনের মানুষের সব কিছুতে মগ্ন হয়ে যেতে পারেন। বলা বাহুল্য যে আমি, আমাদের সময়কার অন্য অনেকের মতোই শচীনে বুঁদ হয়ে ছিলাম। যখনই শচীন ব্যাট (Batting) করতে নেমেছেন, আমিও মনে মনে ভাবতে শুরু করেছি যে, এরপর শচীন কী করবেন। অনেক সময় সেই অনুমান মিলেও গিয়েছে।
আমার মনে আছে, একবার আমরা বন্ধুরা মিলে খেলা দেখছি। আমি বললাম, শচীন এবার একটা ছয় মারবেন। শচীন তা-ই মারলেন। এরপর বললাম যে, সামনের দুটো ওভার উনি ধরে খেলবেন, হয়তো ১০-১২ রান হবে। দেখা গেল, তাই-ই হল। আসলে আমার অবচেতনেই যেন শচীন লুকিয়ে ছিলেন। এমনই ওঁর মহিমা যে আমরা সকলেই শচীনকে আমাদের চেতনার অংশ করে নিয়েছি। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, আমার মতো বহুজনের জীবনেই প্রযোজ্য। আর এই এতবড় আমাদের দেশ, এত অঞ্চল, এত ভেদাভেদ। কিন্তু ওই একটা নামে সকলেই যেন একসূত্রে বাঁধা। শচীন আমার কাছে জাতীয় সংহতিরই মূর্ত প্রতীক।
[আরও পড়ুন: অগ্নিগর্ভ সুদানে আটক বহু ভারতীয়, উদ্ধারকাজে নৌসেনা ও বায়ুসেনাকে পাঠাল কেন্দ্র]
সত্যি বলতে কী, শচীন আউট হয়ে গেলে আমাদের পেড়ে ফেলত অদ্ভুত এক ভয়। গলার কাছে দলা পাকানো অস্বস্তি। মনে হত, আত্মবিশ্বাস যেন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আমাদের উপশমের জন্যই তাই শচীনকে মাঠে থাকতে হতো। শচীন কি নিজের জন্য খেলতেন? মোটেও না। শচীন আমাদের জন্য ব্যাট হাতে দাঁড়াতেন। প্রতিবার ব্যাট তুলে নিতেন জনতার সেই অপূর্ব সমাবেশের জন্য, যাঁদের একযোগে আমরা ‘ভারতবাসী’ (Indians) বলে অভিহিত করি। শচীনের ব্যাট চলত এই ভারতবর্ষের জন্য।
শারজায় (Sharjah) সেই যে মরুঝড়ের সাক্ষী থাকলাম আমরা, তখন থেকেই যেন তৈরি হয়েছিল ‘শচীন’ নামের এই পরম নির্ভরতার আখ্যান। একটা মানুষ কিছুতেই হার মানতে নারাজ। তিনি তাঁর কাজটি করে চলেছেন। সেই যে শুরু হল, তারপর থেকে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ‘শচীন’ নামে এই আখ্যানের ভিতরই আমরা আশ্রয় খুঁজেছি, প্রশ্রয় পেয়েছি। শচীন হয়ে উঠেছেন বহুজনের স্বপ্নের সওদাগর। একটা জাতিকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, জাগিয়ে তুলেছেন একজন মানুষ। শচীন ক্রমে হয়ে উঠেছেন স্বয়ং ইতিহাস (History)।
[আরও পড়ুন: বকেয়া থাকায় চা দিতে অস্বীকার দোকানির, রাগের মাথায় কুপিয়ে খুন! গ্রেপ্তার ক্রেতা]
এই শচীনকে দেখে দেখে আমি অনেক কিছুই শিখেছি, যা আমার ব্যক্তিগত জীবনে খুব কাজে লেগেছে। ওঁর থেকে প্রথম যে জিনিসটা শেখার, তা হল, খেলার প্রতি ওঁর সততা। যে মানুষটার নাম শচীন তেণ্ডুলকর, তাঁর তো পা মাটিতে না-পড়ারই কথা। কিন্তু এখানেই আমাদের ভুল প্রমাণ করে দেন শচীন। দেখা যায়, তিনি শুধু মাটি স্পর্শ করে আছেন, তা-ই নয়, বরং তাঁর জীবনের দর্শন আরও গভীরে।