সরোজ দরবার: কেরলের এক ছোট্ট কলোনি। বাসিন্দারা সেখানে সকলেই প্রায় দিনমজুর। গড় উপার্জন বেশি কী আর! তৃতীয় বিশ্বে দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের জীবন যেমন চলে, তেমনই। তবু তাঁরা জানেন অর্থনীতির মানচিত্র পেরিয়েও তাঁদের আছে আর-এক বিশ্ব। কল্পবিশ্ব নয়, বাস্তবেরই এক বিকল্প পৃথিবী। আর তাই চাঁদা দিয়ে তাঁরা সাজিয়ে তুলেছেন গোটা পাড়া। তাঁদের সেই অন্য বিশ্বে নক্ষত্র হয়ে শোভা পাচ্ছে আপনার অতিমানবীয় কাট-আউট। ওঁরা আপনাকে ভালবাসে। যেমন এই গ্রহের অগণিত মানুষের কাছে আপনিই ঈশ্বর-পৃথিবী-ভালবাসা।
প্রিয় মেসি, আপনি হয়তো জানেন সে-কথা, কিংবা জানেন না।
কলকাতা থেকে কাতার (Qatar World Cup) পাড়ি দিয়েছেন কেউ কেউ। আপনার ম্যাজিক দেখবে বলে। তিন দশকের ঊষরতায় আপনিই পারেন ফুল ফোটাতে। বাঁ-পায়ের শিল্পে পৃথিবীর বুকে সত্যি রূপকথা লেখার ক্ষমতা আপনার ছাড়া আর কার! এই বিশ্বাসে প্রতিদিন সূর্য ওঠে কত মানুষের! উদ্বাস্তু হওয়ার ভবিতব্য যার জন্য লিখে রেখেছে দুনিয়াদারির রাজনীতি, সেই খুদেও আপনার নাম লেখা প্লাস্টিকের জার্সিই গায়ে চাপায়। তার কতদূরে আরও এক খুদে তার ফুটিফাটা পোশাকের উপর লিখে রাখে ‘মেছি’। ক্লিন্ন জীবনের উপর জ্বলজ্বল করে হাতে-লেখা দশ নম্বর। এই ‘দশ’ নম্বরই তো তার রাজার চিঠি। আসলে এক মাসের বিশ্বকাপে জীবন তো বদলায় না। বদলে যায় শুধু জীবনের প্রচ্ছদ।
[আরও পড়ুন: ফুটবলারদের পুজো করা ‘ইসলাম বিরোধী’, মুসলিম সংগঠনের রোষানলে ফুটবলভক্তরা]
দৈন্য, ঈর্ষা, ক্ষুধা, মারী, হিংসায় অহরহ ঘুরপাক খাওয়া পৃথিবীটায় আচমকা যেন নেমে আসে সম্মিলনের বসন্ত। সেখানে রাত জাগার ক্লান্তি নেই। দৈনন্দিন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বেদনা যেন থেকেও নেই। থাকে শুধু সমষ্টির আনন্দ। একসঙ্গে হেসে-ওঠা, কেঁদে-ফেলার দিনগুলো আর রাতগুলো। প্রতিদিনের ভিন্নতা আর মতপার্থক্যের সিঁড়িগুলো কাঠিন্য হারিয়ে এমন এক সমতল ভূমির জন্ম দেয়, বহু তত্ত্ব, বহু আদর্শ সাধ্য-সাধনা করেও যা অর্জন করতে পারে না। ফুটবল তা পারে। একক ক্ষমতায় তা পারেন আপনিও। কে কার সমর্থক, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন! ফুটবলপ্রেমী জানে, সে-সব প্রশ্ন মহাবিশ্বে মিলিয়ে দিয়ে মাঠে নামছেন মেসি। এখনও এই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন আপনিই সেই শিল্প, সমস্ত ছদ্ম বৈরিতা খুড়কুটো হয়ে গেলে, যেখানে জেগে থাকে শুধু ভালবাসা-পৃথিবী-ঈশ্বর।
প্রিয় মেসি, আপনি হয়তো জানেন সে-কথা, কিংবা জানেন না।
আপনি কি ঈশ্বর হতে চেয়েছেন? উত্তর, না এবং না। স্বয়ং বুদ্ধকে একবার সারিপুত্ত বলেছিলেন, বুদ্ধই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। স্মিত হেসে বুদ্ধ শিষ্যকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অতীতের সব জ্ঞানীর জ্ঞানের মাত্রার কি তিনি খোঁজ নিয়েছেন? জানেন কি বর্তমানে সকল জ্ঞানীর কথা? সারিপুত্ত, প্রত্যাশিত ভাবেই, তা জানতেন না। জানা সম্ভব ছিল না বলেই। আমরা বুঝি, বুদ্ধ নিজে অবতার হতে চাননি, কিন্তু অবতার হওয়া থেকে নিষ্কৃতীও পাননি। তুলনা টানা অনর্থক, তবু এ-ও তো সত্যি যে, সর্বকালের সেরা হয়ে উঠার কথা আপনিও ভাবতে পারেননি। খ্যাতি-স্বীকৃতি-সম্ভ্রমের তুঙ্গে পৌঁছেও সবিনয়ে বলেছেন বারংবার, না আমি নিজেকে সর্বকালের সেরা বলেছি, না ভেবেছি, না ওই ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আর এইখানেই যে মস্ত গোলমালটা বেধে গেল। এই যে আপনি সন্ন্যাসী রাজা হয়ে উঠলেন, এই পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ, পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দে ক্লান্ত মানুষ, আপনাকেই ঈশ্বরের স্থান দিয়ে দিল মনের মন্দিরে। হোক না আপনার নব্বই মিনিটের গল্প, তবু সে-গল্প তো জীবনেরই ঘাম-রক্তের। এই গল্পটাকেই তো বহু দিন ধরে আপনি লিখে চলেছেন অতুলনীয় দক্ষতায়। এক দৌড়ে বদলে দিয়েছেন গল্পের প্লট, ঠিকানা-লেখা অ্যাসিস্টে কখনও বদলে দিয়েছেন গল্পের সমাপ্তি। প্রতি গল্পের শেষে অন্তরে অতৃপ্তি জেগেছে। আপনাকে নতুন করে পাওয়ার বাসনা ব্যাকুল হাওয়ার মতো ছুটেছে পৃথিবী এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। ঈশ্বর না হয়ে আপনি থাকেনই বা কেমন করে!
[আরও পড়ুন: এবার থেকে বিশ্বকাপে থাকবে ‘মারাদোনা দিবস’, ঘোষণা ফিফা প্রেসিডেন্টের]
ঈশ্বর আপনি হতে চাননি। কিন্তু প্রজাপতির ডানা ভাঙা এ-পৃথিবীর স্বপ্নেরা আপনার বাঁ-পাকে সম্বল করেই তৃপ্তি পায় ক্ষণিকের উড়ানের। সেই অপার্থিব আনন্দের ফেরিওয়ালা আপনি। গণমানুষের এই ঈশ্বর-স্বীকৃতি যে তাই সরিয়ে রাখা যায় না, সে কথা আপনিও জানেন। আর তাই জানেন, মানুষের ঈশ্বর হয়ে ওঠার কিছু দায় পূরণ করতে হবে আপনাকেই। বার্সেলোনার (Barcelona) মেসি, প্যারিস সাঁ-জা’র মেসি (Leo Messi), আর্জেন্টিনার মেসি যে আলাদা-আলাদা মানুষ তা তো নয়। এমন বিশ্বাস করতে মনও চায় না। তবু পরিসংখ্যান এমনই কাঠখোট্টা বেরসিক অথবা নিক্তির মাপে বাঁধা যে ওই কোপা ছাড়া আর কিছুই সে তুলে ধরতে পারে না। নেই বলেই পারে না। ঠিক এখানেই পৃথিবীটা দুলতে শুরু করে। মারাদোনার (Diego Maradona) একক দক্ষতার শিল্প নেহাত ইতিহাস তো নয়। এখনও তা মানুষের চোখেই ভাসে। কিংবা ৯ নম্বরের জার্সিতে ব্রাজিলের রোনাল্ডোর (Ronaldo) কীর্তিগাথা। কিংবা আপনারই সমসময়ে সাত নম্বর জার্সি গায়ে চাপিয়ে এই পৃথিবীর আর-এক মানুষ যেভাবে নিজেকে প্রতিদিন মেলে ধরছেন, তাও তো গল্পগাথা নয়। ফলত তুলনা, না চাইলেও যেন চলেই আসে। মনে হয়, যে অসামান্য প্রতিভার বিচ্ছুরণ আপনার সহজাত, যে রূপকথা আপনি লিখতে পারেন, নীল-সাদা জার্সিতে যেন তার দেখা মেলে না। ফুটবল দলগত খেলা। কোচের পরিকল্পনার উপর লক্ষ্যভদের প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে। তা ছাড়া পরিসংখ্যান আর খেলার কতটুকু জানে? সে শুধু কয়েকটা মুহূর্তকে মনে রাখে মাত্র। তা সত্ত্বেও ‘মেসি একা কী করবে?’ এ যেন আর কেবল রসিকতা নেই, হয়ে উঠেছে আক্ষেপ। এই আক্ষেপ ভুলতেই একটা অবিশ্বাস্য দৌড়ের প্রত্যাশায় হাপিত্যেশ করে আছে গোটা বিশ্ব। এ দায় আপনার, কেননা, প্রত্যাশার এই তুঙ্গ বিন্দুতে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব তো আপনারাই।
তবু সত্যিই মেসি একা কী করবে? এ প্রশ্ন ফুটবলে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। মেসি তখনই মেসি হয়ে উঠতে পারবেন, গোটা আর্জেন্টিনা (Argentina) দলটাই যদি সদর্থে আর্জেন্টিনা হয়ে ওঠে। সুতরাং প্রত্যাশার ভরকেন্দ্র একটু ঘুরে যাওয়াই শ্রেয়। তবু মেসি বলেই বারংবার তাঁর কাছে ফিরে সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার হিসেব-নিকেশ। মাসখানেকের মধ্যে বিশ্বপকাপ (FIFA World Cup) ফুরিয়ে যাবে। মেসিও হয়তো পরের বিশ্বকাপে আর থাকবেন না। জীবনের সমস্ত কুৎসিত হাঁ-মুখ তাদের স্বরূপ ধারন করে নিঃস্ব করবে দৈনন্দিনকে। সে ভবিতব্য মানুষ জানে। তারই ভিতর তাই প্রত্যাশা করে একটা মানুষকে, যিনি হয়ে উঠবেন এই পৃথিবীর অলীক মানুষ। হয়তো একক দক্ষতায়, নতুবা দলকে সঙ্গে টেনে এমন কিছু একটা করবেন, যা আরও কিছুদিন স্বপ্ন দেখার রসদ জোগাবে। দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে যে নীরবিন্দুর দেখা মেলে, সেই বিশ্বাস আরও গাঢ় করে তুলতে পারেন, এ পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা হাতে-গোনা। মেসি তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁকে ভর করে আশার উড়ান তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
[আরও পড়ুন: ১৯৫০ বিশ্বকাপের বদলা নিতে ব্যর্থ ইংল্যান্ড, প্রি-কোয়ার্টারের টিকিট কার্যত পাকা নেদারল্যান্ডসের]
আর সেই স্বাভাবিকতাকে রূপ দিতেই আর-একবার নামতে হবে আপনাকে। বিষাদের প্রতিমা হয়ে নয়, হেরে-যাওয়া পৃথিবীর করুণ আলো হয়ে নয়, আপনাকে নামতে হবে ঘাম-রক্ত-ধুলো-মাটির টাটকা জ্যান্ত মানুষ হয়ে। ঈশ্বর আপনি হতে চান বা না-চান, অগণিত মানুষের যন্ত্রণার উপশম হয়ে মানুষের ঈশ্বর আপনাকে আর একবার অন্তত হতেই হবে। হয়তো আসন্ন মেক্সিকো (Mexico) ম্যাচই সেই মঞ্চ। আমরা অপেক্ষায় থাকি। নশ্বর এ পৃথিবীতে ‘ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু’ শব্দটিতে আমরা বিশ্বাস করি, এখনও।
প্রিয় মেসি, আপনি হয়তো জানেন সে-কথা, নিশ্চয়ই জানেন।