দুলাল দে, দোহা: শুরুতেই বলে ফেলা ভাল। মরক্কো ম্যাচের আগে পর্তুগাল শিবিরে যা পরিস্থিতি, তাতে শনিবার মরক্কোর বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালেও বেঞ্চে বসতে হচ্ছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে (Cristiano Ronaldo)। অন্তত এদিন পর্তুগালের প্র্যাকটিস দেখে তাই মনে হয়েছে। যদিও সাংবাদিক সম্মেলনে এসে মরক্কোর বিরুদ্ধে রোনাল্ডোর খেলা না খেলা নিয়ে পর্তুগিজ কোচ একটি শব্দ খরচ করেননি। শুধু পর্তুগিজ তারকার ফুটবলের প্রতি অবদানের কথা মনে করে সংবাদমাধ্যমের কাছে বারবার করে একটাই অনুরোধ করেছেন কোচ ফের্নান্দো স্যান্টোস (Fernando Santosh)। বলেছেন, “প্লিজ, আপনারা রোনাল্ডোকে একটু একা থাকতে দিন।”
শনিবার মরক্কোর বিরুদ্ধে খেলার আগে শুধুই দোহায় উপস্থিত পর্তুগাল শিবির কেন, বিশ্বজুড়ে রোনাল্ডো ফ্যানদের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন, সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে না হয় স্ট্র্যাটেজির প্রশ্ন ছিল। কিন্তু মরক্কোর বিরুদ্ধে? এবার কি তাহলে রাগ ভুলে স্যান্টোস শুরু থেকে খেলাবেন রোনাল্ডোকে? কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, কোনও রাগ থেকে নয়। দলের স্ট্র্যাটেজি এবং টেকনিক্যাল কারণেই মরক্কোর বিরুদ্ধেও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে প্রথম দলে রাখতে পারছেন না পর্তুগাল কোচ। এদিন প্র্যাকটিস দেখে যা মনে হল, তাতে সুইজারল্যান্ড ম্যাচে যে দলটা খেলেছিল, সেই দল থেকে অবশ্যই একটা পরিবর্তন হবে। তাতে অবশ্য রোনাল্ডোর প্রথম দলে ঢোকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। চোট পাওয়ার জন্য প্রথম দল থেকে বাদ পড়তে চলেছেন রুবেন ডায়াস। সেই জায়গাতেই সম্ভবত দলে ঢুকতে চলেছেন অ্যান্টনিও সিলভা। আর সবচেয়ে যেটা দলের জন্য স্বস্তিদায়ক খবর, রিজার্ভ দলের সঙ্গে প্র্যাকটিস করলেও রীতিমতো হাসিখুশিই লাগছিল সিআর সেভেনকে (CR7)। অন্তত তাঁকে কেন্দ্র করে পর্তুগাল শিবিরে দু’দিন ধরে যে ঝড়টা চলেছে, তা অনেকটাই এদিন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কারণ, শুরুতে রোনাল্ডোর বাদ পড়ার খবরটা পর্তুগাল শিবিরে অনেকটা অসময়ে বাজ পড়ার মতোই ছিল। পুরো পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রোনাল্ডোও এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন, ফলে স্বস্তি এসেছে পর্তুগিজ শিবিরেও।
[আরও পড়ুন: বাগদানের দিন প্রায় ১০০ জন মিলে তরুণী চিকিৎসককে অপহরণ! বাড়ি ভাঙচুর, ভিডিও ভাইরাল]
কিন্তু ভদ্রলোকের নাম তো ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। বিশ্বের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এহেন একজন ফুটবলারকে দলে থাকার পরেও যদি মাঠের বাইরে থাকতে হয়, তাহলে সুনামির মতো সমালোচনার ঝড় তো আছড়ে পড়বেই। আর তাই এদিন মরক্কো ম্যাচ নিয়ে প্রথাগত সাংবাদিক সম্মেলন করতে এলেও শুরু থেকে শেষপর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে নিয়ে একের পর এক বাউন্সার ‘ডাক’ করে যেতে হল ফের্নান্দো স্যান্টোসকে। একটা সময় নিজেই বললেন, “মরক্কো ম্যাচ নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনের নব্বই ভাগ অংশ কথা হল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে নিয়ে। এর থেকেই বোঝা যায়, রোনাল্ডো পর্তুগালের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কিছু হলে সমালোচনা তো হবেই।”
ক্রিশ্চিয়ানোকে বসিয়ে সুইজারল্যান্ডকে শুধু হারানোই নয়, অসাধারণ খেলেছে পর্তুগাল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, তাহলে কি রোনাল্ডো ছাড়াই এই দলটা আরও ভাল খেলতে পারে? কোচের সঙ্গে এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে এসেছিলেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের (ATM) ফরোয়ার্ড জোয়াও ফেলিক্স। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দিকেও ধেয়ে গিয়েছিল এই প্রশ্নটা। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটাকে ড্রিবল করে দিয়ে পর্তুগিজ স্ট্রাইকারের বক্তব্য হল, “আপনারা যতই বলুন, ক্রিশ্চিয়ানো কেন্দ্রিক এই ধরনের প্রশ্নের কোনও উত্তর আমি দেব না। অনেকদিন পর আমরা বিশ্বকাপের (FIFA World Cup 2022) কোয়ার্টার ফাইনালে। সমগ্র পর্তুগিজদের বলব, এই সময় আপনারা এমন কিছু আচরণ করবেন না, যাতে বিশ্বকাপে আমাদের দলের একতার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা তৈরি হয়।”
একটু আগেই সেই একই কথা বলেছেন স্যান্টোসও। তবে একইসঙ্গে তিনি পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেদিন রোনাল্ডো বাদ দেওয়ার পর শিবির জুড়ে কী হয়েছে। কারণ, পর্তুগিজ অধিনায়কের প্রথম দল থেকে বাদ যাওয়া নিয়ে যেভাবে চারদিকে একের পর এক খবর প্রচারিত হচ্ছে, তাতে সত্য ঘটনাটা সেদিন কী হয়েছিল, সেটা সবাইকে জানানো মনে করছেন পর্তুগিজ কোচ। আর তাতেই এদিন তিনি বললেন, “সুইজারল্যান্ড ম্যাচের দিন লাঞ্চের পর আমি ক্রিশ্চিয়ানোকে বলি, স্ট্র্যাটেজির কারণে ওকে সেদিন প্রথম দলে রাখতে পারব না। এমনিতে ম্যাচের দিন ক্লাসে ছাড়া টিম হোটেলে ওর সঙ্গে আলাদা করে কখনও কথা হয় না। কারও সঙ্গেই বলি না। কিন্তু লোকটার নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। শুধুই পর্তুগালের ক্যাপ্টেন নয়। পর্তুগাল ফুটবলে ওর অবদান অসীম। তাই ওর মতো কাউকে বাদ দেওযার সিদ্ধান্ত নিলে আমার মনে হয়েছিল, সবার আগে সেটা ওকেই জানানো উচিত। আর সেদিন লাঞ্চের পর আমাদের সেই প্রথম ওকে বাদ দেওয়া নিয়ে কথা হয়।”
[আরও পড়ুন: G-20 সম্মেলনে রাজ্যের ভাল দিক তুলে ধরার বার্তা মোদির, বৈঠকে বলার সুযোগ পেলেন না মমতা]
বাদ দেওয়ার খবর শুনে রোনাল্ডো কিছু বলেননি? স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন ব্যাপারটা? সাংবাদিক সম্মেলনে তখন স্যান্টোসের দিকে ঝাঁকেঝাঁকে ছুটে এল প্রশ্নের মালা। পর্তুগিজ কোচ অত্যন্ত শান্তভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন এদিন, “আজ পর্যন্ত দেখেছেন, যে ফুটবলার খেলার সুযোগ পায় না, সে ব্যাাপারটা খুব ভালভাবে নেয়? স্বাভাবিকভাবেই সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাদ যাওয়াটা রোনাল্ডোও খুব ভালভাবে নিতে পারেনি। খুবই আঘাত পায় এবং আমার কাছে জানতে চায়, সুইজারল্যান্ড ম্যাচের জন্য ওকে প্রথম দলের বাইরে রাখার সিদ্ধান্তটা দলের জন্য সত্যিই কি ঠিক নিচ্ছি আমি? আমি যখন ধরে ধরে ওকে টেকনিক্যালি ব্যাখ্যা দিই, তখন ভালভাবে বুঝে যায়, কেন আমি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। বাদ পড়ে হতাশ হলেও, ড্রেসিংরুমে ফুটবলারদের উৎসাহিত করেছে। প্রতিটি গোলের সময় সহ ফুটবলারদের সঙ্গে সেলিব্রেট করেছে। এমনকী মাঠে পৌঁছে রিজার্ভ দলের ফুটবলারদের সঙ্গে ওয়ার্মআপও করেছে। মিডিয়া পুরো ইস্যুটা ভুলভাবে প্রচার করে আমাদের দলে সমস্যা তৈরি করছে।”
এরপরেই রোনাল্ডোর দল ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি প্রসঙ্গে পর্তুগিজ কোচ বলেন, “সেদিন যখন লাঞ্চের পর ওর সঙ্গে কথা হয়। আমারকে একবারও জানায়নি এরকম কথা। আর রোনাল্ডো তো নিজেও তো সবটা বলেছে।” আর এরপরেই সংবাদমাধ্যেমের প্রতি স্যান্টোসের করুণ আবেদন, “ভুলে যাবেন না ওর নাম, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ফুটবলের প্রতি ওর অবদানের কথা মনে করে, ওকে একটু একা থাকতে দিন।” পর্তুগিজ কোচ যখন এভাবে বলছিলেন, মনে হচ্ছিল, সন্তানের সুরক্ষার জন্য বাবার করুণ আবেদন। কারণ, ১২ বছর বয়স থেকে রোনাল্ডোকে দেখে আসছেন তিনি। আর রোনাল্ডোও তাঁর ফুটবল কেরিয়ারে যে যে কোচদের সম্মান করেন, স্যান্টোস তাঁদের মধ্যে একজন। আর রোনাল্ডো বিদায়ের রাস্তাটা সেই ভালবাসার কোচের হাতেই একটা কণ্টকময় হয়ে উঠলে রোনাল্ডোই বা কীভাবে ভালভাবে থাকতে পারেন? এদিন প্র্যাকটিসে রিজার্ভ দলের সঙ্গে বল পাস করতে করতে যখন ক্রিশ্চিয়ানো হাসছিলেন, সেই হাসিতে কত যে অব্যক্ত বেদনা লুকিয়ে আছে, একমাত্র তিনিই জানেন। লোকটার নাম যে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। নাম তো শুনাহি হোগা।