চারুবাক: 'স্বপ্ন! স্বপ্ন! স্বপ্ন! স্বপ্ন দেখে মন...'- মনের আর কী! স্বপ্ন দেখেই খালাস। সে তো বুদবুদের মতো। বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে পড়লেই ভেঙে যায়। তখন মাথার উপরে খোলা আকাশ, আর নিচে কঠিন ফুটপাত। যা বলে মন ভেঙে যাওয়ার গল্প। এমনই এক গল্প 'মনপতঙ্গ' নাম দিয়ে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরেছেন রাজদীপ পাল ও শর্মিষ্ঠা মাইতি। এর আগে পরিচালক জুটির তৈরি ‘কালকক্ষ’ ৬৯ তম জাতীয় পুরস্কারে পেয়েছে সেরা বাংলা ছবির সম্মান। তাই প্রত্যাশা তো বেশিই। 'পুষ্পা ২' ঝড়ে সিনেমা হল প্রাপ্তি হাতে গোনা। কিন্তু বাংলার এই ছবি তো বাস্তব জীবনের চালচিত্র।
এক কথায় রাজদীপ পাল ও শর্মিষ্ঠা মাইতি জুটির দ্বিতীয় ছবি 'মনপতঙ্গ'কে মন ভাঙার ছবি বলাই যায়। গ্রামের হিন্দু মেয়ে লক্ষ্মী (বৈশাখী রায়), আর মুসলিম ছেলে হাসান (শুভঙ্কর মহন্ত)। দুজন-দুজনকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু সমাজ তো মেনে নেবে না এই সম্পর্ক। গ্রাম থেকে পালিয়ে শহরে চলে আসে হাসান-লক্ষ্মী। ঠাঁই পায় গ্রামের পুরোনো বন্ধু বাপন ও তার স্ত্রী পিঙ্কির সংসারে। সংসার বলতে কলকাতার আকাশের চাঁদোয়ার নিচে ফুটপাত। এক কথায় পরিযায়ী বাসিন্দার জীবন। রাস্তার ধারেই প্রাতঃকৃত্যের বাধ্যতা, গঙ্গার জলে স্নান, আবার চাঁদের আলোয় শরীরী মাদকতা।
হাসান-লক্ষ্মীর চরিত্রকে শহরের প্রান্তিক জীবনযাত্রার সঙ্গে যেমন ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করে দিয়েছেন, তেমনই দুজনের স্বপ্নপূরণের পর্বগুলোকে বিভিন্ন স্তরে বেঁধেছেন রাজদীপ ও শর্মিষ্ঠা। তাতেই এসে পড়েছে ফুটপাথবাসীদের নিয়ে আপাত দৃশ্যে সহৃদয় অথচ ঘুষখোর পুলিশের আতাঁত, সীমান্ত পেরিয়ে অর্থ পাচারের চক্র চালানো মাঝ বয়সি চা দোকানের মালকিন জোছনা (সীমা বিশ্বাস)। ফুটপাথের পাশেই একটি আসবাবপত্রের শোরুমের বিকৃত যৌনচিন্তার দারোয়ান চরনদাস। লক্ষ্মী ও হাসান দুজনেই একে অপরকে সুখী করতে চায়, চায় মাথার ওপর একটা ছাদ। কিন্তু সেটা অর্জন করতে গিয়েই ঘটে চলে অমিতাভ নামের এক উচ্চবিত্ত চিত্রশিল্পী ও নিম্নবিত্ত চরণদাসের সঙ্গে কিছু নাটকীয় ঘটনা।
পরিচালক জুটি প্রধান দুটি চরিত্রের মাধ্যমে এই কলকাতা নগরীর অন্ধকার দিকটা যেমন উন্মোচন করেছেন, তেমনি উচ্চবিত্তের ভন্ডামির মুখোশটাও খুলে দিয়েছেন। ছোট্ট ছোট্ট আঁচড়ে তুলে এনেছেন সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও সম্প্রীতির কথা, পুলিশি অত্যাচারের কথা। এঁদের আগের ছবি 'কালকক্ষ' ছিল প্রতীকধর্মী ছবি, আর এই ছবি সহজ সরল পথের পথিক। সাধাসিধে ন্যারেটিভ দিয়ে সাজানো। কিন্তু শুধু চিত্রায়নে নয়, পরিচালক জুটি দুঃসাহসী হয়েছেন বক্তব্যেও। আমাদের কলকাতা শহরের কয়েক লক্ষ ফুটপাতবাসীর জীবন চিত্রের যে ডকুমেন্টেশন করা হয়েছে, সেটা একাধিকবার মৃণাল সেনের 'পরশুরাম' ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। এমন নাগরিক জীবন নিয়ে বাংলায় অতি সম্প্রতি ছবি দেখা যায়নি।
এই ছবির বড় প্রাপ্তি দুটি নতুন মুখের অভাবনীয় জীবন্ত অভিনয়। বৈশাখী রায় ও শুভঙ্কর মহন্ত একটিবারের জন্যও মনে করতে দেননি এটা তাঁদের প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ। সাবলীল তো বটেই, সীমা বিশ্বাস ও জয় সেনগুপ্তের পাশে দাঁড়িয়ে সমানে সমানে পাল্লা দিয়েছেন। বন্ধু বাপনের চরিত্রে পরিচিত মুখ অমিত সাহা, পিঙ্কির ভূমিকায় অনিন্দিতা ঘোষ, দারোয়ানের চরিত্রে জনার্দন ঘোষ, রুমি মডেলের চরিত্রে তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস, নিজেদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেছেন।
ছবিটি মুক্তির সন্ধ্যায় গ্লোব সিনেমা হলে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। অথচ পরদিন দেখলাম অজন্তা সহ উত্তরবাংলা ও শহরতলির আরও কয়েকটি হলে ছবিটি তো চলছে! এমনটা কেন ঘটল তার উত্তর কে দেবে? এধরনের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্যতিক্রমী ছবি পরিবেশক প্রদর্শক সবমহলের কাছ থেকেই উপযুক্ত সহযোগিতা আশা করে। বিশেষ করে তখন, যখন নিজরাজ্যেই বাংলা ছবি ওজনদার হিন্দি ছবির ধারে ও ভারে প্রায় একঘরে হতে বসেছে!
ছবি - মনপতঙ্গ
অভিনয়ে - বৈশাখী রায়, শুভঙ্কর মহন্ত, সীমা বিশ্বাস, জয় সেনগুপ্ত, অমিত সাহা, অনিন্দিতা ঘোষ, জনার্দন ঘোষ, তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস
পরিচালনায় - রাজদীপ পাল ও শর্মিষ্ঠা মাইতি